মাস্ক না পরলে ক্ষতি কতটা?
মাস্ক না পরলে ক্ষতি কতটা? - ছবি : সংগৃহীত
করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুর হার, আক্রান্তের সংখ্যাও। কিন্তু এতেও যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। বাইরে বেরোলেই গলায় মাস্ক ঝুলিয়ে রাখা মানুষ কিংবা মাস্ক ছাড়াই অকুতোভয় হয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষের দেখা মিলছে পথঘাটে। নিয়ম করে নাক ও মুখ ঢেকে মাস্ক পরছেন না অনেকেই। কিন্তু এতে হিতে বিপরীত হচ্ছে, বাড়ছে সংক্রমণের ভয়, এ কথা জানালেন মেডিসিনের চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়।
তবে মাস্ক পরলেও কোন মাস্কটা সঠিক, কোন মাস্ক পরা উচিত, কী ভাবে ব্যবহার করা উচিত, তা নিয়ে চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলল আনন্দবাজার ডিজিটাল। ভাইরাসের প্রবেশ আটকানোই হল মাস্কের মূল লক্ষ্য। কিন্তু কোন মাস্ক পরবে আমজনতা? মাস্ক কি ধোওয়া যায়? ক’টা মাস্ক ব্যবহার করবে মানুষ ? কী ভাবে?
মেডিসিনের চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলেন, আমেরিকায় গবেষণা হয়েছে মাস্ক নিয়ে। সে ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এন-৯৯ বা এন-৯৫ সবচেয়ে কার্যকর। তবে তার প্রয়োজন মূলত ডাক্তারদের । রোগীদের সংস্পর্শে আসতে হয় বা এরোসল তৈরি হয়, এ রকম জায়গায় এই দু’টি মাস্ক মূলত ব্যবহার করেছেন চিকিৎসকরা। এরপরেও সংক্রমিত হয়েছেন। মারাও গিয়েছেন অনেকে।
এই চিকিৎসকের কথায়, ভাইরাসের ধার এখনো কমেনি। সংখ্যা বাড়ছে রোজ। তাই মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। প্রত্যেকে এই মাস্ক পরতে পারলে ভালো, অন্ততপক্ষে নাক-মুখ ঢেকে থাকবে, এমন মাস্ক পরতেই হবে। মাস্ক না পরে রাস্তায় চলাফেরা মানে নিজেকে বিপদে ফেলা এবং অন্যের বিপদ ডেকে আনা। কারো পক্ষে একান্ত সম্ভব না হলে সুতির ত্রিস্তরীয় মাস্ক পরতে হবে। তাতে অন্তত সামান্য হলেও সংক্রমণ আটকাতে পারে।
সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসক অমিতাভ নন্দী বলেন, সুতির মাস্ক পরলে থুতু বা লালা আটকে যেতে পারে হাঁচলে বা কাশি হলে, ওইটুকুই। কিন্তু সূক্ষ্ম কোনো কিছুই আটকাতে পারবে না। কোনো কাজ হবে না ওই মাস্কে। তিনি বলেন, রাস্তাঘাটে যে হারে মাস্ক বিক্রি হচ্ছে তা একেবারেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুসারী নয়। বরং এ ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। তার মত, মাস্ক বানাতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা হু-র মান নির্ধারণ অনুযায়ী। রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া ইচ্ছেমতো মাস্ক নয়, বরং সারা বিশ্বজুড়ে যে সমস্ত মাস্ক ব্যবহারে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, সেই গুণমানের জিনিস দিতে হবে। কারণ মানুষকে সংক্রমণ থেকে বাঁচাবার অন্যতম উপায় এখন মাস্ক। অস্বীকৃত মাস্ক পরে ঘুরলে তা আরো বেশি বিপজ্জনক হতে পারে। তাই ত্রিস্তরীয় মাস্ক বা সার্জিক্যাল মাস্ক পরতে হবে।
অরিন্দমবাবু জানান, সার্জিক্যাল মাস্ক পরা সবচেয়ে ভালো হলেও এটি ডিসপোজেবল। কিন্তু সব মানুষের আর্থিক সঙ্গতি সমান নয়, প্রতিদিন একটি মাস্ক ব্যবহারের পর ফেলে দেয়ার স্বাচ্ছন্দ্য প্রত্যেকের নেই। অনেকে তাই তোয়ালে বা রুমাল বেঁধে নিচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে কতটা পরিচ্ছন্নতা বজায় রয়েছে, তা জানা নেই। তাই অপরিষ্কার হলে বিপদ আরো বাড়বে। মাস্কে থুতু কিংবা লালা লাগলে, মাস্ক পরে হাঁচলে তা পরমুহূর্তে বর্জন করতে হবে। তবে মাস্কে কর চাপিয়ে না দিয়ে তা সাধারণের জন্য গ্রহণযোগ্য করে তোলার কথাও উল্লেখ করেন অরিন্দমবাবু।
মেডিসিনের চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায়ের মতো জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামীর মত, এন-৯৫-এর মতোই কার্যকরী হলো এফএফপি-২ মাস্ক। সুবর্ণবাবু বলেন, এন-৯৫ সুরক্ষা দেয় ৯৫ শতাংশ, এফএফপি-২ ৯৪ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। পজিটিভ রোগীদের সংস্পর্শে এসেছেন, বা চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, টেকনিশিয়ানদের এই মাস্ক বাধ্যতামূলক। ইমারজেন্সি ডিউটিতেও এই মাস্ক ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ত্রিস্তরীয় সার্জিকাল বা মেডিক্যাল মাস্ক পরা বাইরে বেরোন যেকোনো মানুষের জন্য জরুরি। মাস্কে যাতে নাক থেকে চিবুক ঢাকা পড়ে সেটি দেখতে হবে। তবে বদ্ধ ঘরে বৈঠকের সময় বা রোজ অফিসে যাতায়াতের ক্ষেত্রে যেখানে ভিড় রয়েছে, সামাজিক দূরত্ব মানা যাচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে ত্রিস্তরীয় মাস্ক নয়, এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহার করতে হবে।
তার মত, একান্তই কাপড়ের মাস্ক ব্যবহার করলে তা ডিটারজেন্টে কেচে তিনটি মাস্ক এক দিন অন্তর ব্যবহার করা যেতে পারে। এন-৯৫ মাস্ক কিংবা এফএফপি-২ মাস্কের ক্ষেত্রে মোট পাঁচটি কেনা থাকলে ভালো। তা হলে প্রথম থেকে পঞ্চম নির্দিষ্ট করে নিলে প্রথম মাস্কটি ষষ্ঠ দিনে ব্যবহার করা যাবে। এ ভাবে মোট এক মাস বা তার একটু বেশি সময় এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাড়ি এসেই সংস্পর্শে আসে না বা হাত পড়বে না এমন জায়গায় মাস্ক খুলে ভাঁজ করে রেখে দিতে হবে। তবে আলমারিতে নয়। বাইরে থেকে দেখে মাস্কের চেহারার সামান্য বদল হলেও তা ফেলে দিতে হবে।
মাস্কের ডিজপোজাল কী ভাবে হবে?
১ শতাংশ হাইপোক্লোরাইট দ্রবণ বা এক লিটার পানিতে ৩০ গ্রাম ব্লিচিং পাউডার গুলে মাস্কগুলোকে ন্যূনতম ৩০ মিনিট রেখে জীবাণুমুক্ত করে তার পর ফেলে দিতে হবে।
মেডিসিনের চিকিৎসক কল্লোল সেনগুপ্তও এন-৯৫ মাস্কের পক্ষেই সওয়াল করে বলেন, কাপড়ের মাস্ক পরে খুব একটা লাভ নেই। কেতাদুরস্ত ফ্যাশন মাস্কেও কোনো রকম সুরক্ষা মিলবে না। থ্রি প্লাই বা ত্রিস্তরীয় মাস্কই পরতে হবে। তার মত, এন-৯৫ মাস্ক ব্যবহার করলে শুকনো কোনও জায়গায় রেখে (কাগজের ঠোঙা হলে ভাল) দিতে হবে ৯৬ ঘণ্টা থেকে ৭ দিন। তবে এই মাস্ক কোনো রাসায়নিক দিয়ে না ধুতে পরামর্শ দিয়েছেন কল্লোলবাবু। তা হলে সুরক্ষার বিষয়টাই থাকবে না। তিনিও সুবর্ণবাবুর মতোই পাঁচটি মাস্ক কিনে ব্যবহারের পক্ষপাতী।
ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক সুশ্রুত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত অবশ্য খানিকটা আলাদা। তিনি বলেন, ত্রিস্তরীয় মাস্ক না পেলে ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী নন এমন মানুষ সুতির মাস্ক ব্যবহার করতে পারেন, তবে তা মাত্র এক বার ব্যবহারযোগ্য। এন-৯৫ মাস্ক রোদে রেখে ৪৮ ঘণ্টা পর ব্যবহার করা যেতে পারে, জানান সুশ্রুতবাবু। সুতির মাস্ক হলে ডিটারজেন্ট দিয়ে ধুয়ে পরা যেতে পারে, তবে সে ক্ষেত্রেও এক দিন অন্তর এই হিসেবে মাস্ক পরতে হবে।
ক্রিটিক্যাল কেয়ার চিকিৎসক শ্যামাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিধি মানতে বলেন। যেমন—
১) প্রত্যেককে মাস্ক পরতেই হবে
২) মাস্ক হবে ত্রিস্তরীয়
৩) একান্তই সুতির মাস্ক পরা যায়, তবে এটা বিজ্ঞানসম্মত নয়। সার্জিক্যাল মাস্কই চিকিৎসাবিদ্যায় গ্রহণযোগ্য।
৪) মাস্ক যেখানে সেখানে খোলা যাবে না। খুব প্রয়োজন হলে মাথার পিছনে বা কানের পিছনের অংশ দিয়ে সন্তর্পণে খুলতে হবে।
৫) মাস্কের ভিতরে একেবারেই হাত দেওয়া যাবে না।
৬) যেখানে অনেক লোক রয়েছে বা এরোসল তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে এন-৯৫ পরা বাঞ্ছনীয় বলে জানান তিনি।
মেডিসিনের চিকিৎসক সুকুমার মুখোপাধ্যায় একইসঙ্গে বলেন, ত্রিস্তরীয় মাস্ক পরার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা ও হাত ধোওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।
মনে রাখতে হবে
এন-৯৫ মাস্ক বা এন-৯৯ মাস্কে জীবাণু সংক্রমণ রোধ হয় ৯৫ থেকে ৯৯ শতাংশ
এফএফপি-১-এর ক্ষেত্রেও তাই
ত্রিস্তরীয় মাস্কের ক্ষেত্রে যা ৮৮ শতাংশ
যদি ভিড় জায়গাতে না যান, সর্দি-কাশির সমস্যা না থাকে, তবে এন-৯৫ মাস্ক ডিটারজেন্টে পরিষ্কার করে তিন থেকে চার দিন অন্তর ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে বেশি দিন ধুয়ে ব্যবহার করলেও তা খারাপ হয়ে যাবে বলে মত সুকুমারবাবুর।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা