করোনার প্রতিষেধক ১৫৫ গবেষণাগারে
করোনার প্রতিষেধক ১৫৫ গবেষণাগারে - ছবি : সংগৃহীত
সারা বিশ্বে কোভিড সংক্রমিতের সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ ছাড়িয়েছে, মৃত ৬ লাখের বেশি। টিকার জন্য হাত পেতে আছে পৃথিবী। এই সঙ্গিন পরিস্থিতিতে বিশ্বের ১৫৫টি গবেষণাগারে কোভিড ভ্যাকসিন তৈরির অক্লান্ত চেষ্টা চলছে। এর মধ্যে ২৩টি জায়গায় গবেষকেরা পৌঁছে গেছেন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের তৃতীয় অর্থাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ে। কিন্তু, কতদূরে টিকা? সাধারণ মানুষের উৎকণ্ঠা শুধু নয়, বাণিজ্যমহলেরও সতর্ক নজর সেদিকে। অনেকেই মনে করছেন, আগামী বছরের মাঝামাঝি, বা বড়জোর শুরুতে বাজারে আসবে টিকা। গোল্ডম্যান স্যাকস এসময় আরেকটু বেশি আশাবাদী। জানাল, এবছরের শেষেই টিকা উৎপাদনে অনুমোদন মিলে যেতে পারে। আমেরিকায় এগিয়ে আছে আমেরিকার মডার্না, ফাইজার–বায়োএনটেক। এগিয়ে আছে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি–অ্যাস্ট্রাজেনেকাও।
অক্সফোর্ডের জোর
বিশ্বে সব থেকে বেশি নজর কেড়ছে অক্সফোর্ড। দুটি কারণে। এক, যেটুকু জানা গেছে, কোভিড–১৯ ভাইরাসকে জোড়া ধাক্কা দেয়ার ক্ষমতা রাখবে অক্সফোর্ডের জেনার ইনস্টিটিউটের তৈরি এই ভ্যাকসিন। প্রথমত, সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে দেহে অ্যান্টিবডি গড়ে তুলে এবং জীবাণুর যম ‘টি সেল’ তৈরি হতে সাহায্য করে। টি সেলের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু যেকোনো সম্ভাব্য কোভিড প্রতিষেধকেরই রোগ–প্রতিরোধ ক্ষমতার স্থায়িত্ব নিয়ে এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠে গেছে। কারণ একাধিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, প্রতিষেধক শক্তিহীন হয়ে পড়ছে দু–তিন মাসের মাথায়। সেখানে শরীরে বাড়তি ‘টি সেল’ মানে লড়াইটা আরও বেশি দিন জারি থাকবে। আর দ্বিতীয় কারণটি অনেকটাই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের খবর, কিন্তু বহু মানুষ তাতেই আশান্বিত যে, অক্সফোর্ডের গবেষকদের তৈরি ভ্যাকসিন কোনো বিত্তবান দেশের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত থাকবে না। বরং ছড়িয়ে দেয়া হবে সারা বিশ্বে। যেভাবে যক্ষ্মা বা পোলিওর টিকা ছড়িয়েছে এর আগে, বৃহত্তর মানবকল্যাণে।
প্রথম হতে চায় রাশিয়া
রাশিয়া জানিয়েছে, বিশ্বে প্রথম মানবদেহে করোনার টিকার পরীক্ষা ঠিকঠাক চললে আগস্ট মাসেই সেটি হাতে পাওয়া যাবে। রাশিয়ার ভেতরে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের জন্য চলতি বছরেই ভ্যাকসিনের ৩ কোটি ডোজ উৎপাদন হবে। এ ছাড়া বিশ্ব–বাজারের জন্য আরো ১৭ কোটি ডোজ। রাশিয়ার গামালেই ইনস্টিটিউট অফ এপিডেমিওলজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজি এই ভ্যাকসিনটি তৈরি করেছে। ১৮ জুন থেকে সেচেনভ বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়। ৩৮ জন স্বেচ্ছা–পরীক্ষার্থীর শরীরে প্রায় এক মাস ধরে প্রয়োগের পর ফলাফল দেখে রুশ বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত, ভ্যাকসিনটি মানবদেহের পক্ষে সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম। আপাতত ১০০ জনের শরীরের ওপর দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষা চলছে। আগস্টে রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দুটি দেশে কয়েক হাজার স্বেচ্ছা–পরীক্ষার্থীর শরীরে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হবে। তার ফলাফল দেখে আশ্বস্ত হলে আগস্টেই রাশিয়ায় এবং সেপ্টেম্বরে অন্যান্য দেশে ভ্যাকসিনটি পাঠানো হবে। তেমন হলে এটিই হবে বিশ্বের প্রথম কোভিড ভ্যাকসিন।
ভারতেও পরীক্ষা শুরু
ভারতে তৈরি কোভিড ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ শুরু হয়েছে এইম্স, পাটনায়। পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজি তাদের হায়দরাবাদের গবেষণাগারে কোভিড–১৯ ভাইরাসের একটি অংশ আলাদা করতে সফল হয়েছে। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ভাইরোলজির সহযোগিতায় যা থেকে ভ্যাকসিন তৈরি করছে হায়দরাবাদের ওষুধ সংস্থা ‘ভারত বায়োটেক’। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল মানবশরীরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে ভারত বায়োটেককে। সেই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য ১২টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করেছে আইসিএমআর। তার মধ্যে পাটনা এইম্স ও রোহতকের পিজিআইএমএস–এ গত সপ্তাহ থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে।
কোভ্যাকসিন সম্বন্ধে এখন পর্যন্ত যা জানা গেছে, এটি একটি ‘নিষ্ক্রিয়’ ভাইরাস। কাজেই মানবদেহে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে গিয়ে এর সংক্রামিত করা বা সংখ্যাবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা নেই। কিন্তু মানবদেহের রোগ–প্রতিরোধ ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই মৃত ভাইরাসের উপযুক্ত অ্যান্টিবডি গড়ে তুলতে পারে। এর আগে পশুদেহে এটি প্রয়োগ করে সুফল পাওয়া গেছে। এইম্স পাটনায় ১০ জন এবং রোহতক পিজিআইএমএস–এ তিনজনের শরীরে এটি প্রয়োগের পর কোনও জটিলতা দেখা দেয়নি। ফলে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশাবাদী। ১৪ দিন পর ফের এঁদের দেহে কোভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে। ১২টি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে দু’দফায় মোট ১,১২৫ জনের শরীরে এই টিকা পরীক্ষা করা হবে। প্রথম দফায় ৩৭৫ জন এবং তাতে সফল হলে দ্বিতীয় দফায় আরও ৭৫০ জন।
আইসিএমআর–এর প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল এন কে গাঙ্গুলির ধারণা, ২০২১–এর জানুয়ারি বা বড়জোর ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পাওয়া যাবে কোভিড–১৯–এর আপৎকালীন টিকা। ভারতের প্রথম সারির ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারী সংস্থা ভারত বায়োটেক কোভিডের টিকা নিয়ে কাজ করছে ফিলাডেলফিয়ার থমাস জেফারসন ইউনিভার্সিটির সঙ্গে।
সেই গবেষণা নিয়েই এমন মন্তব্য করেছেন এন কে গাঙ্গুলি। আইসিএমআর–এর সাবেক কর্তা বলেন, এমআরএনএ সিন্থেটিক ভ্যাকসিন দ্রুত তৈরি করা যায়। নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের দ্রুত অনুমতি পেলে, টিকা তৈরির সময়সীমাও দারুণভাবে কমিয়ে আনা যায়। ন্যাশনাল সেন্টার অফ বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রথাগত টিকার বিপরীতে এমআরএনএ টিকা খুবই সম্ভবনাময় বিকল্প। এই টিকার ক্ষমতা বেশি, এগুলি দ্রুত এবং কম খরচে তৈরি করে ফেলা যায় এবং দেয়াও সহজ।
সূত্র : আজকাল