ইরান-চীন সমঝোতায় বিপদে পড়বে মার্কিন ডলার
ট্রাম্প - ছবি : সংগৃহীত
আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যাপারটা কী তা কমিউনিস্টদের আজো ঠিকমতো বোঝা হয়নি। কারণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ব্যবস্থাটা ১৯৪৪ সালে আইএমএফÑ বিশ্বব্যাংকের প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের চালু হলেও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো এতে অংশ না নেয়ায় (আমেরিকাও নেতিবাচক মনোভাব রাখাতে যেমন, সুনির্দিষ্ট করে পোল্যান্ডের সদস্যের আবেদন না করে দিয়েছিল আমেরিকা) কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্ক ছাড়াই বিকশিত হয়েছে। এভাবে ১৯৯২ সালে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার আগে পর্যন্ত। এরপরে এরা সবাই সদস্যপদ নেয়। তত দিনে দুনিয়ার বাণিজ্যে কেনাবেচা প্রধাণত ডলারেই সম্পন্ন হওয়া শুরু হয়ে গেছে। প্রধান মানে? সত্তর ভাগের বেশি লেনদেন যদি কোনো একক মুদ্রায় সম্পন্ন হয় তাহলে সেটিই প্রধান আন্তর্জাতিক মুদ্রা ধরতে পারি।
এটা অনেকটা খুব চালু দোকানের খাবারের মতো। খুব চালু বলেই ওর খাবার সবসময় টাটকা ও ভেরাইটি থাকে। ফলে ওর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পারা যায় না। কিন্তু একবার যদি তার বিক্রি পড়ে যায় তবে দোকান শেষ। একইভাবে, ডলারের ক্ষেত্রে, ওর প্রতিদ্বন্দ্বী মুদ্রা গ্লোবাল লেনদেনের মুদ্রা হিসাবে একবার সত্তর ভাগের কাছাকাছি চলে গেলে ডলারের দফারফা হয়ে যাবে। এটাই ডলারের অবরোধ আরোপের ক্ষমতা ভেঙে দেয়া। এ দিকে চীনা ইউয়ান শর্ত পূরণ করাতে গত ২০১৫ সাল থেকে ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে আইএমএফের স্বীকৃতি পায়। আর সেই থেকে রাশিয়ার সাথে চীন পরিকল্পনা করে করে আগাচ্ছে। এখনকার মুল পরিকল্পনাটা হলো, চীনের জ্বালানি কেনাকেন্দ্রিক। বড় অর্থনীতি বলে চীনকে প্রচুর জ্বালানি কিনতে হয়।
মানেই তার এক বড় পেমেন্ট হলো জ্বালানির মূল্য শোধ করা। অতএব হিসাবটা হলো, এই পেমেন্ট যদি সে ডলারে না করে নিজ মুদ্রা ইউয়ানে করে তাহলে ওই ৭০% গ্লোবাল লেনদেন থেকে ডলারকে হটানোর পথে অনেক দূর আগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এত দিন এই পরিকল্পনা ছিল মধ্যপ্রাচ্য সৌদি-গালফকেন্দ্রিক, বাদশাহরা যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে রাজি হয় ভরসা করে; ইরানকে নিয়ে ভাবা হয়নি। কারণ ইরান আজকের হবু সম্পর্কের মধ্যে আসতে চায় এমন আগ্রহ আগে দেখায়নি। আর চীনের প্রস্তাব ছিল সামগ্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী, এখনকার হবু চুক্তির মতো হতে হবে এই শর্তের। ইরানের আগে অনাগ্রহটা কেন ছিল তা বুঝতে অপর বিরোধী নেতা আহমদিনেজাদের প্রতিক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে। তিনি বলছেন, এই চুক্তি হলে আমরা অনেক বেশি চীনা নির্ভরশীল হয়ে যাবো। বাইরে থেকে দেখলে তিনি সম্ভবত আগামী নির্বাচনে লড়ার কথা ভাবছেন। প্রশ্নাতীতভাবেই ইরান চীনা নির্ভরশীল তো হবেই। কিন্তু প্রশ্ন সেখানে নয়। প্রশ্ন হলো ইরানের হাতে এর বিকল্প কী আছে? ব্যাপারটা হলো পোলাও পাতে আসার অপশন যদি নাই থাকে তবে পোলাও খাবো কি না সেই বাছাবাছির অর্থ কী! যদিও ইলেকশনি ইস্যু হিসেবে দেখলে আহমদিনেজাদের বক্তব্যের গুরুত্ব আছে।
সেটি যাই হোক, এবারের সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসের শুরু থেকেই ট্রাম্পের যে কড়া অবরোধ এতে এক চীন আর ভেনিজুয়েলা ছাড়া কোথাও ইরানি তেল বেচা যায়নি। ভারত প্রথম কোনো তেল কিনেনি। তা-ও সেটি আবার কনসেশন রেটে আর নিজ নৌবাহিনী পাহারায় নিজ ট্যাংকার-ক্যারিয়ারে করে তা পাঠাতে এবার ইরানি-অফার ছিল তা সত্ত্বেও। ফলে ইরানের পাবলিক তাদের জীবনযাত্রায় আর কত গভীর চাপ, আর কত দিন সহ্য করতে পারা সম্ভবÑ এটাও মুখ্য বিবেচনার দিক হয়ে উঠেছে এখানে। সম্ভবত সে কারণে এর আগে সহসা ইরান রাজি হতে পারেনি। এবার বাধ্যবাধকতা বেশি অনুভব করে রাজি হয়েছে। এতে গালফ বাদশাহদের ইউয়ানের চীনা তেলের পেমেন্ট নেয়াতে রাজি করানো যতটা কঠিন ছিল এখানে সে কাজ অনেক সহজেই সম্পন্ন হয়েছে, দেখা যাচ্ছে।
কারণ খসড়া চুক্তিতে দেখা যাচ্ছে সব লেনদেন হবে চীনা ইউয়ানে, লেখা আছে। সুতরাং এটা একটা বিরাট অগ্রগতি। অর্থাৎ পালাবদলের ধাক্কা দেয়ার ক্ষেত্রে এক বিরাট পদক্ষেপ হয়েছে এটা। অর্থাৎ এই চুক্তির ইমপ্যাক্ট কেবল ইরানের কী লাভ-সুবিধা হলো ততটুকুতেই নয় বরং এক গ্লোবাল ক্ষমতায় প্রভাব প্রতিপত্তিতেও বড় ভূমিকা রাখবে।