ইরান-চীন জোটে সবচেয়ে বড় ক্ষতিগ্রস্ত হবে ভারত!
শি ও মোদি - ছবি : সংগৃহীত
ভারতে চিন্তাবিদরা এখন বিরাট প্রশ্নের সম্মুখীন যে, তাদের চিন্তার ক্ষমতা-সামর্থ্য কত সীমিত! এই চিন্তাবিদ বলতে নানান রঙের কথিত থিংকট্যাংক বা একাডেমিক বা কনসাল্টিং ফার্মের কথা বলছি। এক কথায় বললে, এই চুক্তি ভারতকে ভারতের স্বার্থ একেবারে ধসিয়ে দেবেÑ যেটার আগাম কোনো হদিস এই চিন্তাবিদরা ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের দিয়েছে প্রমাণ জানা যায় না। এই চুক্তির কারণে ভারত মূলত ইরান, আফগান বা সেন্ট্রাল এশিয়া জোনে ব্যবসা বাণিজ্য সহায় সমর্থনহীন অবস্থায় পড়বে। এ ছাড়া এই হবু চুক্তির আয়োজনের ফলে ভারতকে চীন এমন দুর্দশা পরিস্থিতিতে ফেলে দেবে যে, ভারতকে এখন খোলাখুলি চীন অথবা আমেরিকা কোনো একটা পক্ষ বেছে নিতে হবে। অর্থাৎ সেই সময় এসে গেছে যখন ‘এ-ও হয় ও-ও হয়’ বলে দু’দিকেই নৌকায় পা দিয়ে থাকার সুবিধা এনজয় করার দিন শেষ। এতে ভারতের আমেরিকা ক্যাম্পে গেলে হয়তো সামরিক দিকে কিছু সুবিধা হতে পারে। কিন্তু বাইরের অর্থনৈতিক সাহায্য সমর্থন পাওয়ার দিন শেষ হবে। আর যদি চীনের ক্যাম্পে মাথা নিচু করে ফেরে তবে চীনের টার্মে ফিরতে হবে। কম দরে বিক্রি হতে হবে।
যে কথাটা বলছিলাম ভারতীয় চিন্তার সামর্থ্যÑ এখন এটা ভারতের রাজনীতিক ও চিন্তাবিদদের জন্য প্রমাণ করা খুবই কঠিন যে, চীন-ইরান যে এমন একটা দীর্ঘস্থায়ী এলায়েন্স করে বসতে পারে তা তারা বিন্দুমাত্র আগে জানত। অর্থাৎ ইরানি তেল না কিনলে মুখ ঘুরিয়ে নিলে যে ভারতের বহুমুখী স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ হবে- সেটি তারা আগে দেখতেই পায়নি। তাদের চোখে মেরা ভারত মহান হয়েই ছিল বা অনেক ক্ষমতাবান হয়েই ছিল। তার মানে দাঁড়াল ভারতে শুধু উদ্বৃত্ত বা বিনিয়োগের বিপুল ঘাটতি আছে তাই নয়, চিন্তার সামর্থ্যরে দিক থেকেও পেছনে আছে। আমেরিকান থিংকট্যাংকের পাল্লায় পড়ে তাদের স্ব-ক্ষমতাটাও শেষ।
সর্বশেষ যেদিন ১৩ মে ২০১৯ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ এক দিনের সফরে এসেছিলেন এবং খুবই মনোক্ষুণœ হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন। কারণ এর আগেই ২ মে ২০১৯ থেকে ইরানের অনুরোধ ফেলে মাড়িয়ে ভারত ইরানি তেল কেনা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই অন্তত শেষবারের মতো শেষ কথা শুনতে এসেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ। এমনকি পরিষ্কার করে বলেছিলেন, এই আমেরিকান থিংকট্যাংকÑ সিএসআইএস-তোমাদের ডুবিয়ে ছাড়বে, এদের পাল্লায় পড়ো না। কিন্তু কেউ তার কথা শোনেনি। এমনকি পরের ২ অক্টোবর ২০১৯ এ আমেরিকায় মিডিয়াকে জয়শঙ্কর দাবি করে বুঝাচ্ছিলেন তেল কেনা বন্ধ করে দেয়ায় ইরান ভারতের ব্যাপারে হতাশ হয়নি। আরো সাফাই দিয়ে বলেছিলেন, ‘যার যার দেশের বাধ্যবাধকতা আছে আর (আরেক দিকের) সুবিধাও আছে।’ এর মানে তাহলে এখন চীন-ইরান নতুন চুক্তির পথে চলে যাওয়ায় নিশ্চয় ভারতের কোনো ক্ষতি বা অসুবিধা হয়নি, তাই নয় কি? তাহলে চার দিকে মিডিয়ায় ভারতের নাকিকান্না কেন?
যদিও বেশির ভাগ মিডিয়া ভারতের ক্ষতিটা কী হয়েছে সেটিও বোঝেনি। যেমন দ্য হিন্দু। এটাকে অনেক বুদ্ধিমান অগ্রসর মিডিয়া বলে মানুষ মানে। কিন্তু ওর শিরোনাম দেখুনÑ ‘ইরানে চাবাহার রেল প্রজেক্ট থেকে ভারতকে বের করে দিয়েছে ফান্ড দিতে ভারতের দেরি দেখে।’ কিন্তু ঘটনাটা কী এতই সহজ আর এতটুকুই! অথচ ওই রিপোর্টেই ভেতরে ওই চীন-ইরান চুক্তির সবকিছুর উল্লেখ আছে।
এর সোজা মানে হলো, পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদকে হতাশায় ফিরিয়ে দেয়াকে তারা দেখেছিল আমেরিকার সাথে ভারতের সম্পর্ক এত বিশাল কিছু আর এতে ভারতের জন্য অর্জন এতই বড় যে, ভারতের এর বিপরীতে ক্ষুদ্র ইরানের কথাগুলো নিয়ে ভাবা অপ্রয়োজনীয়, খুবই স্মল। কাজেই সব চীনের দোষ। যেমন দেখুন আরো কিছু মিডিয়ায় শিরোনাম : ‘চাবাহার প্রকল্পে ধাক্কা ভারতের, নেপথ্যে চিন’, ‘ইরানের একটি বড় প্রকল্প থেকে ভারতকে বাদ’, ‘চীন-ইরান দোস্তি, যুক্তরাষ্ট্রে অস্বস্তি’। অর্থাৎ এই চুক্তির বড় পিকচার বা গ্লোবাল প্রভাবের দিকটা কেউ আমল করতে পারেনি। নেহাতই একটা ইরানি প্রকল্প থেকে ‘চীনের প্রভাবে’ ভারতকে বের করে দেয়া হিসেবেই বুঝেছে। এভাবে চীনকে দোষারোপ করে নিজেদের চিন্তা করারও অযোগ্যতা তারা ঢাকতে চাচ্ছে। আবার ভারত আমেরিকান সখ্যকে অতিগুরুত্ব দিয়ে তারা বলতে চাচ্ছে ভারত ইরানি তেল কেনা বন্ধ করতে পারবে কিন্তু ইরান ভারতকে রেল প্রজেক্ট থেকে বাদ দিতে পারে না।
এর চেয়ে বরং কংগ্রেসে কিছু বুদ্ধিমান লোক আছে মনে হয়। তারা বলেছে,‘চীন বেটার ডিল দিয়ে ইরানকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে আর সরকার সেটি আগে বুঝতে পারেনি।’ কংগ্রেস অন্তত চীনকে দোষী করেনি। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখেছে।
যার চিন্তার সামর্থ্য যে মাপের আলটিমেটলি সে সেই খাপেই এসে আটকা পড়ে।