ইরানের নতুন চাল!
ইরানি নৌবাহিনী - ছবি : সংগৃহীত
ইরান-চীন নতুন অংশীদারিত্ব চুক্তি বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। এটি নতুন মাত্রা সৃষ্টি করতে চাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইরানের পরমাণু কর্মসূচি প্রশ্নে ২০০৬ সালে জাতিসঙ্ঘ যখন দেশটির ওপর অবরোধ আরোপ করার সময় দেশটির সাথে ভারত, জাপান ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সম্পৃক্ততা হ্রাস করার সময়ও চীন ওই দেশে তার উপস্থিতি জোরদার করেছিল। তবে এবারের সম্পৃক্ততার মাত্রা ও সময় বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ইরানের সাথে সঙ্ঘাতময় নীতি থেকে সরে এসে ভালোভাবে সম্পৃক্ততার নীতি গ্রহণ করেছিলেন এটা উপলব্ধি করে যে সিরিয়া-ইরাকে আইএসআইএসের সাথে লড়াইয়ে জয় পাওয়া যাবে না ইরান ছাড়া। ২০০৫ সালে ইরানের সাথে পি৫+জার্মানির যে পরমাণু চুক্তি হয়েছিল, তাতেও এই ধারণা কাজ করেছিল।
এর জের ধরে ২০১৬ সালের মে মাসে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইরান সফরের সময় পারস্য উপসাগরের বাইরে থাকা কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ চাবাহার বন্দর নিয়ে ভারত-ইরান চুক্তি হয়েছিল।এই চুক্তির মধ্যেই ছিল আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সাথে কানেকটিভিটি উন্নত করার জন্য চাবাহার-জাহেদান রেলওয়ে লাইন নির্মাণ।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালের মে মাসে ইরানের সাথে সাথে পরমাণু চুক্তি বাতিল করে দেশটির ওপর সর্বোচ্চ চাপ সৃষ্টির জন্য ব্যাপকভিত্তিক অবরোধ আরোপ করেন।
মোদির প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে খুশি করার চেষ্টা ও তাকে নাখোশ না করার ইচ্ছার ফলে ইরানের সাথে বাণিজ্য ও বয়কটে সামিল হয় ভারত।
ভারত আর সেইসাথে যুক্তরাষ্ট্রের দুই মিত্র সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে কৌশলগ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে। মোদি পরিকল্পিতভাবে আবু ধাবির ক্রাউন প্রিন্স শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ ও সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলেন।
এসব বিষয় লক্ষ্য করেছে ইরান। ২০১৯ সালের আগস্টে কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার ভারতের পদক্ষেপও নজরে রেখেছে ইরান। ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি কাশ্মিরের মুসলিমদের অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমরা ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার আশা করি, তবে চাই যে ভারত ন্যায়সঙ্গত নীতি অবলম্বন করবে।
ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানিও কাশ্মিরি মুসলিমদের পক্ষে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেন। অর্থাৎ ভূরাজনীতি ও বিজেপির ঘরোয়া রাজনৈতিক এজেন্ডা ভারত-ইরান সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলে।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের ইরান সময়র সময় ব্যাপকভিত্তিক সহযোগিতার প্রস্তাব দেয়া হয়।
তখনো ইরান বুঝতে পারছিল না যে নতুন প্রেসিডেন্টের অধীনে মার্কিন নীতি কেমন হবে। ট্রাম্প ইরানের বিরুদ্ধে পুরোপুরি সঙ্ঘাতময় নীতি গ্রহণ করেন এই মনে করে যে ইরান ভেঙে পড়বে।
মার্কিন অবরোধে ইরানি অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে থাকা অবস্থায় বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার জন্য চীনা ব্যাপকভিত্তিক সম্পৃক্ততার প্রস্তাবকে ইরান জীবন রক্ষাকারী বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে। এই প্রেক্ষাপটে ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জরিফ গত অক্টোবরে চীন যান চুক্তিটি চূড়ান্ত করতে।
তবে চীন ও ইরানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ বাড়ায় চুক্তিটি সই হতে দেরি হয়। চুক্তিতে প্রায় ১০০টি প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে তিনটি অবাধ বাণিজ্য জোন প্রতিষ্ঠা : উত্তর-পশ্চিম ইরানের মাকু, শাতিল আরবের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে আবাদান ও কাশম আইল্যান্ডে প্রতিষ্ঠা করা হবে এসব জোন। আর তা উপসাগরীয় অঞ্চলে বাণিজ্য ও ম্যানুফেকচারিংয়ে জিসিসির প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করবে।
এখন পাকিস্তানের গোয়াদরের পাশাপাশি ইরানের চাবাহারে চীনা উপস্থিতির ফলে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতকে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জে ফেলবে।
আর চীনের মহাদেশীয় প্রভাব এখন হিমালয় থেকে উপসারগ পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। অবশ্য এই চুক্তিটি পার্লামেন্টে পাস করাতে ইরানকে বেশ সমস্যায় পড়তে হবে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আহমদনেজাদ একে সন্দেহজনক চুক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন।