বদলে যাচ্ছে মধ্য প্রাচ্যের ভূ-রাজনীতি!
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ও রুহানি - ছবি : সংগৃহীত
ইরানের সাথে চীনের এই কৌশলগত সমঝোতার আরেকটি দিক হলো বেইজিং মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগতভাবে আরো সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের দুই প্রধান শক্তি সৌদি আরব ও ইসরাইলের সাথে চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও দেশ দু’টির কৌশলগত সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের সাথে। অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক স্বার্থে বেইজিং এ অঞ্চলে এক ধরনের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করলে মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের কৌশলগত সহযোগী হবে ইরান ও তার মিত্ররা।
চীনা ও ভারতীয় জ্বালানি বাজারগুলো সবসময় সৌদি আরবের আগ্রহের বিষয় ছিল। এই বাজারগুলোতে আরো সক্রিয় হওয়ার জন্য রিয়াদ জ্বালানি অবকাঠামোয় বিনিয়োগ করেছে এবং উভয় দেশকে একটি বিশেষ ছাড় দিয়েছে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের ২০১৯ সালে চীন সফরের সময় দুই দেশের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের জ্বালানি চুক্তি সই হয়েছিল। চুক্তির আওতায় আরামকো এবং চাইনিজ নরিনকো উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় চীনা শহর পাঞ্জিনে একটি শোধনাগার এবং একটি পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য ১০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর করে। এ ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতাগুলো চীন-ইরান কৌশলগত চুক্তি হলে কতটা আগাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এত দিন মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমেরিকার বিপরীতে কৌশলগতভাবে সক্রিয় ছিল রাশিয়া। বৈশ্বিক ফোরামে করোনা ইস্যুটিকে কেন্দ্র করে চীনবিরোধী প্রচারণা ও উদ্যোগ দিন দিন বাড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র্র। ইরানের সাথে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষরের পর এই প্রয়াস আরো জোরালো হতে পারে। সে ক্ষেত্রে মিত্র দেশগুলোর মধ্যেও এক ধরনের মেরুকরণ সৃষ্টি হবে।
অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা ও ট্রান্স এশিয়ান অঞ্চল
চীনে সরকারের যেকোনো উদ্যোগের অভ্যন্তরীণ সমালোচনার সুযোগ নেই। কিন্তু ইরানের অবস্থা ভিন্ন। চীনের সাথে এই অংশীদারিত্ব চুক্তির বিরুদ্ধেও সমালোচনা আছে। সাবেক ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ বলেছেন, ইরানি জাতি এই ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত চুক্তি মানবে না। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, জাতিকে না জানিয়ে কোনো গোপন চুক্তি করা হলে তা বাতিল হয়ে যাবে। অবশ্য ইরানের সরকার ঘোষণা করেছে চুক্তিটি সংসদে উপস্থাপন করা হবে। দেশটির ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ অনুমোদন করলে অবশ্য শেষ পর্যন্ত এর বাস্তবায়ন নিয়ে বড় কোনো সমস্যা হবে না। আর সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলি খামেনির অনুমোদনক্রমেই সরকার এ নিয়ে অগ্রসর হয়েছে বলে মনে হয়।
ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের আগে চীন ছিল ইরানের প্রধান তেল গ্রাহক, প্রতিদিন এক মিলিয়ন ব্যারেল ইরানি তেল কিনছিল বেইজিং। চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জ্বালানির জন্য নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে শক্তি সংগ্রহ করা এবং জ্বালানি সম্পদের বৈচিত্র্যকরণ বেইজিংয়ের জাতীয় জ্বালানি নীতিটির মূল বিষয়। নতুন কৌশলগত চুক্তি এটি বেশ খানিকটা নিশ্চিত করবে। একই সাথে চীন-রাশিয়ার প্রভাবাধীন ট্রান্স এশিয়ান অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য বাস্তবায়নেও তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি অর্জিত হতে পারে। নিরাপত্তা বিশ্লেষক আন্দ্রে করিবকোর ধারণা, ‘চীন-ইরান নতুন সম্পর্কের পর ইউএস-ইন্ডিয়ান রিমল্যান্ডের সমান্তরাল গতিতে ইউরেশিয়ান পশ্চাৎভূমিতে চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়াকে নিয়ে নতুন মাল্টিপোলার ট্রাইলেটারাল আত্মপ্রকাশ করবে। সিরিয়ায় আইআরজিসি ও হিজবুল্লাহর ওপর ইসরাইলি মিত্রের নিয়মিত বোমাবর্ষণ সত্ত্বেও চীনের দিকে ইরানের ঝুঁকে পড়াটা এই চার দেশ ও তুরস্ককে নিয়ে ‘গোল্ডেন রিং’ সৃষ্টির রুশ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নেই সহায়ক হবে।’
বলার অপেক্ষা রাখে যে, চীন-ইরান কৌশলগত সম্পর্কের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে এটি হতে পারে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, যার প্রভাব এই অঞ্চলের জন্য হবে অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী।