ইরান-চীন চুক্তিতে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ভারতে

মাসুম খলিলী | Jul 17, 2020 07:57 am
ইরান-চীন চুক্তিতে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ভারতে

ইরান-চীন চুক্তিতে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ভারতে - ছবি : সংগৃহীত

 

ইরান-চীন কৌশলগত চুক্তি ভারতের জন্য এক মহা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই চুক্তির খসড়া ফাঁসের পরপরই ভারতীয় পত্রিকা দি হিন্দুতে চাবাহার বন্দর সংযোগ নির্মাণের একটি ভারতীয় বিনিয়োগ প্রস্তাব ইরান বাতিল ঘোষণা করেছে বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। ইরানের চাবাহার বন্দর থেকে আফগানিস্তান সীমান্তের নিকটবর্তী জাহেদান পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের জন্য ভারত আর ইরানের মধ্যে যে চুক্তি হয়েছিল, সেখান থেকে ভারতকে বাদ দিয়েছে ইরান। প্রকল্প শুরুর জন্য অর্থায়নে ভারতের বিলম্বের বিষয়টি উল্লেখ করে ইরান সরকার বলেছে যে, তারা নিজেরাই এটির নির্মাণকাজ করবে।
মূলত চীনের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি ৪০০ বিলিয়ন ডলারের কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি চূড়ান্ত করার পর এ সিদ্ধান্ত নিলো ইরান। চীনের সাথে এ চুক্তিটি সেখানে ভারতের পরিকল্পনাকে অনিশ্চয়তায় ফেলতে পারে। ইরানিয়ান রেলওয়েজ এবং ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত ইন্ডিয়ান রেলওয়েজ কনস্ট্রাকশান লিমিটেডের মধ্যে যে রেলওয়ে প্রকল্পটি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, সেটি ছিল ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তির ব্যাপারে দেয়া ভারতের প্রতিশ্রুতি। আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার সাথে বিকল্প বাণিজ্য রুট গড়ে তোলার জন্যই এই রেলওয়ের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল।

২০১৬ সালের মে মাসে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তেহরান সফরকালে ইরানি প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এবং আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানির সাথে চাবাহার চুক্তি করেন। সে সময় ইরানের রেল মন্ত্রণালয়ের সাথে ভারতের আইআরসিওএনের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ভারত, ইরান আর আফগানিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুসারে ট্রানজিট আর পরিবহন করিডোরের অংশ হিসেবে চাবাহার-জাহেদান রেলওয়ে নির্মাণের কথা। এ প্রকল্পের জন্য সব ধরনের সেবা, পরিকাঠামোর কাজ এবং প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য ১.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারতের আইআরসিওএন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করলে দিল্লি এ ব্যাপারে বেশ খানিকটা পিছিয়ে যায়। তেহরান মনে করে যে ভারত কৌশলগতভাবে ইরানের বিপরীত পক্ষের সাথে সমীকরণের মিলিত হচ্ছে।

ইরান থেকে ভারত এলএনজি আমদানি করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত সেপ্টেম্বরে ভারতে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যেই বলেন যে তার দেশ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) দিয়ে চীনে এলএনজি পাইপলাইন বসানো নিয়ে আলোচনা করছে। এটি কার্যত ইরানের সিপিইসি-সমান্তরাল পাইপলাইন পরিকল্পনা ভারতের একই ধরনের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেবে এবং সেইসাথে সিপিইসিতে ইরানের স্বার্থ আঞ্চলিক একীভূত জোরদার করবে।

এ ছাড়া ইরানি নেতৃত্ব আরো হতাশ হয় গত ডিসেম্বরে ইসরাইলি একটি পরিকল্পনা প্রকাশের পর। তাতে ইসরাইল ও ইরানের কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্য প্রতিপক্ষের সাথে ট্রান্স-অ্যারাবিয়ান করিডোরের কথা ছিল। এই পরিকল্পনা হাতে পাওয়ার পর ভারতের আর নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর বা আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার চাবাহার করিডোরের পূর্ব শাখার ব্যাপারে আগ্রহ বহাল থাকেনি। ট্রান্স-অ্যারাবিয়ান করিডোরের মাধ্যমে ইউরোপের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ভারত বেশি গুরুত্ব দেয়। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মানে আন্তর্জাতিকভাবে ইরানের ক্রমবর্ধমান হারে একঘরে হয়ে যাওয়া।

বিষয়টি ধরতে পেরে রাশিয়াও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। তারা এখন যুদ্ধপরবর্তী আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে রুশ-পাক করিডোরের কথা চিন্তা করছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান হবে রাশিয়ার গ্রেটার ইউরেশিয়ান পার্টনারশিপের অংশ।

মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের পর থেকে ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক বেশ শীতল হয়ে পড়েছে। আর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত গভীর সম্পর্ক দিল্লির সাথে তেহরানের সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দিচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে অদূর ভবিষ্যতে ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা এক প্রকার শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আর চাবাহারের ঘটনাটিতে যে বার্তা পাওয়া যায় তা হলো ইরানের কৌশলগত অবস্থান ভারতের প্রতিকূলে চলে যেতে পারে। ইরানের চাবাহার বন্দর ভবিষ্যতে ভারত কতটুকু ব্যবহার করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হবে। তা ছাড়া চীনের সমর্থন পাকিস্তান-ইরান-তালেবান জোট ভারতের জন্য আরো উদ্বেগের কারণ হবে। ইরানে চীনের অবস্থান বাড়লে তা কেবল তেহরানের সাথে দিল্লির সম্পর্কের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে না, সেই সাথে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ওপরও তা অনুভূত হবে।

যুক্তরাষ্ট্র্র ছাড়াও ইসরাইল আর সৌদি আরবের সাথে ভারতের ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রভাবও পড়ছে দিল্লি-তেহরান সম্পর্কের ওপর। ইসরাইলের সাথে ভারতের ব্যাপকভিত্তিক কৌশলগত সম্পর্ক সৃষ্টির পর এমন অভিযোগও উঠেছে যে ভারতের মিশন ও স্থাপনা থেকে তেল আবিবের পক্ষে গোয়েন্দাবৃত্তি হয়েছে। এর আগে বেলুচিস্তান ও করাচিতে অন্তর্ঘাতী তৎপরতা চালানোর জন্য কুলভূষণ যাদব নামে এক ভারতীয় সেনাকর্মকর্তার বিচার করা হয়েছে। চীনের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক হওয়ার পর ইরানের মাটিকে কোনোভাবেই পাকিস্তানবিরোধী তৎপরতায় ব্যবহার হতে দেবে না তেহরান। এসব কারণে ভারতীয় কূটনৈতিক তৎপরতায় গোয়েন্দাবৃত্তির মতো কোনো কিছু না ঘটার ব্যাপারে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us