ওলি-প্রচণ্ড বিরোধের নেপথ্যে
ওলি-প্রচণ্ড - ছবি : সংগৃহীত
নেপালি ২০১৭ সালে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষের সাধারণ নির্বাচনে প্রায় দুই তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল নেপালের জনগণ। নতুন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার জন্য পরিস্কার সমর্থন ছিল কে পি ওলির প্রতি। সেটা তিনি করেছিলেন বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্য দিয়ে, এমনকি ভারতের মতো পক্ষ থেকেও অপ্রত্যাশিত সমর্থন পেয়েছিলেন তিনি।
নির্বাচনের বিজয় থেকে শুরু করে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেয়ার মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওলিকে তিনবার অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এবং নজিরবিহীন উদাহরণ হিসেবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বিশেষ সফরে কাঠমাণ্ডু এসেছিলেন এবং ভারতের পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
এই বার্তার অনেক ব্যাপক অর্থ ছিল, কারণ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ভারতের চাপিয়ে দেয়া ১৩৪ দিনের অর্থনৈতিক অবরোধকালে ভারতের বিরুদ্ধে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন ওলি। ২০১৫ সালের এপ্রিলের ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর নেপাল যদিও কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, এর পরও ওই অবরোধ আরোপ করেছিল ভারত।
ওলি এখনো ভারতের ব্যাপারে খুশি নয় কারণ নেপাল, ভারত আর তিব্বতের ত্রিদেশীয় সংযোগ পয়েন্টের ৩৭০ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে পুরনো সীমান্ত বিবাদটি নতুন করে উসকে উঠেছে। কিন্তু এবার দেশের ভেতরেই রাজনৈতিক সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হচ্ছে ওলিকে এবং ভারত-বিরোধিতার ফায়দা এবার উঠাতে পারেননি তিনি।
ক্ষমতাসীন নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (এনসিপি) ভেতরের ক্ষমতাধর নেতারা – যাদের মধ্যে সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কামাল দহল প্রচণ্ড, মাধব কুমার নেপাল এবং ঝালনাথ খানাল রয়েছেন – তারা ‘গেট আউট ওলি’ প্রচারণা শুরু করেছেন এবং দাবি করেছেন যাতে ওলি প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় প্রধান উভয় পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
প্রচণ্ড আর ওলি যথাক্রমে কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-মাওয়িস্ট সেন্টার এবং কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং তারা একত্র হয়ে নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি) গঠনের পরিকল্পনা করেন। দুটো শর্তে এই জোট হয়েছিল : ১. দলের কংগ্রেস অনুষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত তারা উভয়েই চেয়ারপার্সনের দায়িত্ব পালন করবেন এবং ২. তারা পালাক্রমে সরকারকে নেতৃত্ব দিবেন, এবং সেখানে সরকারের প্রথমার্ধের নেতৃত্ব দেন ওলি।
কিন্তু সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে ত্রিশ মাস চলছে (২০২০ সালের জুলাইয়ের হিসেব অনুযায়ী)। ওলি এটা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন না তিনি, এবং প্রচণ্ডকে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে হলে জনগণের সমর্থন পেতে হবে।
কিন্তু ওলির ব্যাপারে প্রচণ্ড শুধু একাই অখুশি নন। ওলি তার বড় প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তিব্বতের উচ্চ পাহাড়ি এলাকা থেকে নেপালের সমতল পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ, যেটার মধ্যে বুদ্ধের জন্মস্থান লুম্বিনিও সংযুক্ত থাকবে; রান্নার গ্যাস বিতরণের জন্য কেন্দ্রীয় বণ্টন ব্যবস্থা; এবং ভারতের সাথে জলপথে যোগাযোগ চালু। তাছাড়া বেশ কিছু বড় ধরনের কেলেঙ্কারিরও কেন্দ্রে রয়েছেন ওলি। এর মধ্যে রয়েছে সরকার নিয়ন্ত্রিত নেপাল এয়ারলাইন্সের জন্য বিমান ক্রয় এবং নেপাল ট্রাস্টের মালিকানাধীন বিশাল প্রাইম প্রপার্টি লিজ দেয়া।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই ওলি ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট, রেভিন্যু ইন্টেলিজেন্স, এবং আরও অনেক সংস্থাকে সরাসরি তার অধীনে নিয়ে আসার একটা প্রবণতা তৈরি করেছেন। মিডিয়া-বিরোধী ক্ষতিকর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে, যেখানে টেলিফোনে আড়ি পাতার অধিকার দেয়া হয়েছে রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে। সাংবিধানিক যে দুর্নীতিবিরোধী প্রতিষ্ঠান – সেই কমিশন অব ইনকোয়ারি ইনটু অ্যাবিউস অব অথরিটি এখন নির্বাহী বিভাগের অংশ হয়ে গেছে প্রায়।
১৪ বছর ধরে সিপিএন-ইউএমএলের নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাধব নেপাল প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, ওলি তাকে একটি জমির কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে আসছেন, যেখানে তার কোন দোষ নেই এবং ‘শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার’ কারণে এটা করা হচ্ছে।
তবে বিষয়টি ব্যক্তিগত ক্ষোভের জায়গা পেরিয়ে গেছে। ওলির পক্ষে বিপক্ষে দল সুস্পষ্টভাবে ভাগ হয়ে গেছে। প্রবল ক্ষমতাধর ৪৫ সদস্যের স্ট্যান্ডিং কমিটির দুই-তৃতীয়াংশই ওলির বিরুদ্ধে। স্ট্যান্ডিং কমিটির যে অধিবেশন প্রায় তিন সপ্তাহ আগে শুরু হয়েছে, সেটা এ পর্যন্ত চারবার মুলতবি করা হয়েছে, যাতে দুই নেতা বসে নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে ফেলতে পারেন।
প্রধানমন্ত্রীকে অবশ্যই সরকার ও দলীয় প্রধানের থেকে পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে – এই বিষয়টি বাদে অন্য যে কোন বিষয়ে আলোচনা হতে পারে – এই অবস্থানের পক্ষে-বিপক্ষে প্রচণ্ড এবং ওলি উভয়েই অনড় অবস্থান নিয়েছেন। এটা নিয়ে শুধু দলের মধ্যেই হতাশা সৃষ্টি হয়নি, বরং সরকারের মধ্যেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, কোভিড১৯ মহামারীর কারণে যে সরকার এমনিতেই পঙ্গু অবস্থার মধ্যে আছে।
১১ জুলাই ১১ জন দ্বিতীয় সারির নেতাদের জোরাজুড়িতে স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক এক সপ্তাহের জন্য মুলতবি করা হয়। দুই নেতাকে কাছাকাছি আনতে এবং তাদের ক্ষমতার লোভের কারণে জনগণ হতাশ হবে, যে জনগণ ত্রিশ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো তাদেরকে বিপুল জনসমর্থন দিয়েছিল – এই বিষয়টি উপলব্ধির মধ্যে আনতেই বৈঠক স্থগিত করার চাপ দেন তারা।
ওলি সম্ভবত ভেবেছিলেন যে, রাজনৈতিক ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে আবার, এবং ভারতের সাথে দ্বন্দ্ব তাকে এবারও সুবিধা দেবে। পুরো পার্লামেন্টের সবাই দলমত নির্বিশেষে ওলিকে ভূখণ্ডগত ইস্যুতে সমর্থন দিয়েছে, কিন্তু তাতে তার রাজনৈতিক কোনো সুবিধা হয়নি।
চীনের রাজনৈতিক সূচনা
কিন্তু নেপালের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে চীনের দৃশ্যমান প্রবেশের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নতুন বাঁক নিয়েছে। এপ্রিল মাস থেকেই নেপালে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত হাউ ইয়ানকি ধারাবাহিক কতগুলো বৈঠক করেছেন, যেগুলোর ব্যাপারে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। তিনি প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবি ভান্ডারি, প্রধানমন্ত্রী ওলি, এবং তার প্রতিপক্ষের তিন নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের সাথে ধারাবাহিক বৈঠক করেছেন।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রেসিডেন্ট ভাণ্ডারির মধ্যে ২৭ এপ্রিলের একটি টেলিফোন আলাপের বিষয়টিতে শুধু প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট শি অন্যান্য নেতাদের তুলনায় ওলির ব্যাপারে তার পছন্দের বিষয়টি প্রকাশ করেছেন। শি’র উদ্ধৃতি দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে যে সুস্পষ্ট প্রটোকল ভঙ্গ করে প্রধানমন্ত্রী ওলির সুস্বাস্থ্য ও সুখ কামনা করেছেন প্রেসিডেন্ট শি।
পরের সপ্তাহে ১ মে রাষ্ট্রদূত হাউ প্রচণ্ড আর মাধব নেপালের সাথে আলাদাভাবে বৈঠক করে ভারি বার্তা দিয়েছেন যে, সরকার স্থিতিশীল হলেই কেবল চীন-নেপাল সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির জন্য সেটা সবচেয়ে ফলপ্রসূ হবে।
আড়াই মাসের মাথায় এসে, বিরোধী পক্ষরা ওলির বিরুদ্ধে আবারো সোচ্চার হয়েছেন এবং সাবেক তিন প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রদূত হাউয়ের সাথে আলাদা বৈঠকে তাকে জানিয়েছেন যে, ওলি না থাকলেও নেপাল-চীন সম্পর্কের কোনো ক্ষতি হবে না।
অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, চীন এই বার্তাটাকে সত্য হিসেবে গ্রহণ করবে এবং নেপালের রাজনীতিকে নিজের মতো করে শান্ত হতে দেবে। এর অর্থ হলো সামান্য কিছু অতিরিক্ত সময় দায়িত্ব পালন করে তাকে পদত্যাগ করতে হবে, অথবা সেটাতে রাজি না হলে দল ভেঙ্গে দিতে হবে।
চীনা রাষ্ট্রদূত হয়তো অভ্যন্তরীণ বিবাদের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান নন, কিন্তু নেপালে প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা প্রতিপক্ষের কাছে চলে যাওয়ায় ভারত বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত। এর কারণ হলো নেপালের রাজনীতিতে ভারতের অতিরিক্ত নাক গলানো, বিশেষ করে ২০১৫ সালে ক্ষমতার পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্র আর ইইউয়ের সহায়তা নিয়ে নেপালের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের খুঁটিনাটি সিদ্ধান্তে হাত দেয়া। এর কারণেই চীনের দিক থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া এসেছে।
নেপাল বিপুল নির্বাচনী সংখ্যাগরিষ্ঠার বিষয়টি নিয়ে যে ঢোল পিটিয়েছিল যে এবার একটা স্থিতিশীল সরকার গঠিত হবে, কিন্তু এখন প্রমাণিত হলো যে, শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতিশ্রুতি দেয়া যায় না। সে জন্য একটি সুস্পষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা এবং সৎভাবে দলকে নেতৃত্ব দেয়ার প্রয়োজন। ওলি একনায়কতন্ত্রের দিকে যে যাত্রা শুরু করেছেন, সে ব্যাপারে চোখ বন্ধ রেখে ভুল করেছেন তার বিরোধী পক্ষ।
বর্তমান গ্রুপটি ক্ষমতা থেকে চলে গেলে নেপালি জনগণ চোখের পানি ফেলবে না। কোন এক পক্ষ জিতলে তারা উল্লাসও করবে না। তবে নেপালিরা যে শিক্ষাটা নেবে, সেটা হলো প্রতিশ্রুতি আর কর্মতৎপরতার মধ্যে মিল না থাকলে নির্বাচনী বিজয় আসলে অর্থহীন।
সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর