ইরানে জটিলতা, ভারতই দায়ী!

রুহানি ও মোদি - ছবি : সংগৃহীত
চাবাহার বিস্ময়
বহুল আলোচিত চাবাহার প্রকল্প থেকে ইরান কেন ভারতকে বাদ দিলো তার প্রকৃত কারণ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। আগামী সিকি শতকে ইরান ও চীন তাদের কৌশলগত অংশীদারিত্ব নিয়ে আলোচনা করতে থাকার প্রেক্ষাপটে এই ঘটনা ঘটে। এই গুঞ্জন রয়েছে যে ভূকৌশলগত মধ্য এশিয়া থেকে চীন তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে সঙ্কোচিত করার জন্য তেহরানকে এই সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করে থাকতে পারে।
প্রথমে ইরান ভারতকে আস্তাকুড়ে ফেলেছে না ভারত ফেলেছিল ইরানকে?
তথাকথিত ‘চীন হুমকি’র ধারণা কিংবা চীনকে একটি গুলি না ছুঁড়েই প্রতিদ্বন্দ্বীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনার একটিকে ভণ্ডুল করে দিতে পারার মতো চতুর হিসেবে চীনকে উপস্থপনা করার মধ্যে আসলে বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়ন করার সবচেয়ে নির্ভুল উপায়টি নেই। বাস্তবে, ভারতই ইরানকে আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছিল, ভারতকে ইরান নয়।ভারত অনেক দিন ধরেই কাজটি করেছিল। তবে গত দুই বছর ধরে ইরানকে যেভাবে অশ্রদ্ধা করছিল ভারত, তা বিবেচেনা করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
আমেরিকার অবরোধের কারণে ভারত তার প্রধান সরবরাহকারীর কাছ থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ সংগ্রহ করাই কেবল বন্ধ করেনি, একই সময় ইরানের ঘৃণিত শত্রু ইসরাইলের সাথেও সামরিক-কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করতে শুরু করেছিল ভারত।
সিপিইসি ফ্যাক্টর
ইরান থেকে ভারত এলএনজি আমদানি করার ব্যাপারে তেমন আগ্রহী না হওয়ার প্রেক্ষাপটে গত সেপ্টেম্বরে ভারতে নিযুক্ত ইরানি রাষ্ট্রদূত প্রকাশ্যেই বলেন যে তার দেশ চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) দিয়ে চীনে এলএনজি পাইপলাইন বসানো নিয়ে আলোচনা করছে। এটি বড় ধরনের একটি বিষয়। কারণ ইরানের সিপিইসি-সমান্তরাল পাইপলাইন পরিকল্পনা ভারতের একই ধরনের পরিকল্পনা ভণ্ডুল করে দেবে এবং সেইসাথে সিপিইসিতে ইরানের স্বার্থ আঞ্চলিক একীভূত জোরদার করবে।
ট্রান্স-আরব টার্নিং পয়েন্ট
ভারতের প্রতি নমনীয় ইরানি নেতৃত্বের একটি অংশের দিল্লির অনুরাগ শেষ হয়ে যায় গত ডিসেম্বরে ইরাইলি একটি পরিকল্পনা প্রকাশের পর। তাতে ইসরাইল ও ইরানের কয়েকটি মধ্যপ্রাচ্য প্রতিপক্ষের সাথে ট্রান্স-অ্যারাবিয়ান করিডোরের কথা ছিল। এই পরিকল্পনা হাতে পাওয়ার পর ভারতের আর নর্থ-সাউথ ট্রান্সপোর্ট করিডোর বা আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার চাবাহার করিডোরের পূর্ব শাখার ব্যাপারে আগ্রহ বহাল থাকেনি। ট্রান্স-অ্যারাবিয়ান করিডোরের মাধ্যমে ইউরোপের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে ভারত বেশি গুরুত্ব দেয়।আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন মানে আন্তর্জাতিকভাবে ইরানের ক্রমবর্ধমান হারে একঘরে হয়ে যাওয়া। একই ক্থা প্রযোজ্য ভারতের জন্যও।
বিষয়টি ধরতে পেরে রাশিয়াও পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ হতে থাকে। তারা এখন যুদ্ধপরবর্তী আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে রুশ-পাক করিডোরের কথা চিন্তা করছে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তান হবে রাশিয়ার গ্রেটার ইউরেশিয়ান পার্টনারশিপের অংশ।
ফলে অনিবার্য পরিণতি
সহজে বোধগম্য এসব কৌশলগত চেইন রিঅ্যাকশন অনেক বিশেষজ্ঞের ধরতে না পারার কারণ হয় তারা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর চালিকাশক্তির সাথে অপরিচিত ছিলেন কিংবা কোনো কোনো পক্ষের চাপে তথাকথিত ‘পলিটিক্যাল কারেক্টনেস’ অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে ভারত নিজেকে দায়ী করা ছাড়া আর কারো ওপর দোষ চাপাতে পারে না। গর্বিত ইরানি জাতিকে অপদস্ত করার পর ভারত এর চেয়ে ভালো কিছু করার আশা করতে পারে না।
আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইতোপূর্বে চাবাহার করিডোরের জন্য ভারতকে কিছু ছাড় দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তখন মনে হয়েছিল যে আফগানিস্তান থেকে সে সরে এলে ভারতের মাধ্যমে দেশটিতে তার অবস্থান ধরে রাখতে পারবে। আর সেজন্য চাবাহার বন্দরটি ভারতের প্রয়োজন। কিন্তু পরিবর্তিত অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, এটি তার স্বার্থ পূরণ করবে না। এ কারণে সে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে।যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই বিকল্প ব্যবস্থার দিকেই জোর দিয়েছে।
শেষ কথা
এসব ঘটনার প্রেক্ষাপটে সামান্য কিছু পর্যবেক্ষণের কথাই কেবল উল্লেখ করা যেতে পারে। ইউএস-ইন্ডিয়ান রিমল্যান্ডের সমান্তরাল গতিতে ইউরেশিয়ান পশ্চাতভূমিতে চীন, পাকিস্তান ও রাশিয়াকে নিয়ে নতুন মাল্টিপোলার ট্রাইলেটারাল আত্মপ্রকাশ করবে। সিরিয়ায় আইআরজিসি ও হিজবুল্লাহর ওপর ইসরাইলি মিত্রের নিয়মিত বোমাবর্ষণ সত্ত্বেও চীনের দিকে ইরানের ঝুঁকে পড়াটা এই চার দেশ ও তুরস্ককে নিয়ে ‘গোল্ডেন রিং’ সৃষ্টির রুশ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নেই সহায়ক হবে।
জিভিএস