টকশোয়ের রাজা-রানি
সাহেদ-সাবরিনা - ছবি : সংগৃহীত
‘তৈল’ যে কী পদার্থ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় তা কিঞ্চিৎ আন্দাজ করেছিলেন। সেকালে তিনি তৈল মর্দনের যে ‘মহিমা’ বর্ণনা করেছিলেন, একালেও তা অবিকল আছে। ‘বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান; যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হতে পারে।’
একসময় বিতর্ক ছিল ‘তৈলাধার পাত্র নাকি, পাত্রাধার তৈল’। এখন মনে হয়, টিভি চ্যানেলের টকশোই দুটো-তৈলাধার পাত্র এবং পাত্রাধার তৈল। নইলে টকশোবাজির এমন মহোৎসব ঘটল কিভাবে? এ যেন একমাত্র তেলের তেলেসমাতি।
টকশো মানে বুদ্ধিজীবীদের জ্ঞান-গরিমার উপস্থাপন। ‘জ্ঞানই শক্তি, জ্ঞানই পুণ্য’- এটাই হওয়া উচিত ছিল টকশোর উদ্দেশ্য-বিধেয়। তাতে অ-জ্ঞানীরা জ্ঞান ধারণ, দর্শন ও প্রবচন করতে পারত। কিন্তু আমাদের যেমন সবকিছুর মধ্যে ‘পলিটিক্স’ ঢুকে যায় তেমনি টকশো হয়ে দাঁড়ালো রাজনৈতিক বাহাস। রেসলিংয়ে যেমন একজন ঘায়েল হলে অপরজনের সমর্থকরা তালি বাজায়, এখানেও হলো তাই। রীতিমতো রেসলিং। কথার পৃষ্ঠে কথা। যুক্তির উল্টো যুক্তি। স্রেফ গলাবাজির প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা গলাবাজিতেই থেমে থাকেনি। তা ধরাধরি এবং মারামারির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যারা মেধায় হেরে যায়, হাত দিয়ে কথা কয়। গোশতের বস্তারা মাস্তানি দিয়ে জিততে চায়। অবশ্য এখন ‘মাস্তানবাদ’ই ক্ষমতার উৎস। ক্ষমতার মদমত্ততা সর্বত্র। ক্ষমতা এবং ক্ষমতাই অর্থ-বিত্ত-চিত্তের আধার। তাই টকশোতে ক্ষমতার সয়লাব।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে টকশো বা ‘কথা প্রদর্শনী’র অস্তিত্ব ছিল না। ‘তৃতীয় মাত্রার’ সুপরিচিত উপস্থাপকই সম্ভবত প্রথম টকশোকে শিল্পে উন্নীত করেছে। এরপর টিভি চ্যানেলের আধিক্য বেড়ে যাওয়ায়, টকশোর আধিপত্য বাড়ে। বাংলাদেশের জনচিত্তে বিদ্রোহী ভাব আছে। বিরোধী কথা শুনতে চায় তারা। তাই টকশোতে দেখা যায় বিরোধীদের বাহুল্য। নামীদামি বুদ্ধিজীবীদের অংশগ্রহণে জমজমাট হয়ে ওঠে টকশো। ভিন্নমত পোষণকারীরা ছিলেন টকশোর শ্রেষ্ঠাংশে।
এককতন্ত্রের মালিক-মোখতারদের পছন্দ হয়নি বহুতন্ত্রের কথা। টকশোতে কথন অথবা অতিকথনে রুষ্ট হন কর্তাব্যক্তিরা। টকশো যেহেতু নিশীথ রাতে প্রচারিত হয় বেশি, তাই সেটি কথিত হয় ‘নিশি কুটুমদের কারবার’ বলে। সবাই জানে, নিশীথ রাতে বিচরণ করে কারা? চোর-ডাকাত অথবা বেড়া-ভাঙা লোকেরা। সুতরাং তারা ওটাই। টকশো আয়োজকরা ব্যালেন্স করতেন। একজন এ পক্ষ অপরজন বিপক্ষ। মজা পেত মানুষ। ক্রমে ক্রমে বিরোধীদের জন্য ছোট হয়ে আসে টকশোর পৃথিবী। শুরু হয় একক বন্দনা। বক্তৃতা মানেই বন্দনা। পুঁথিপাঠ বা লোকানুষ্ঠান বন্দনা দিয়ে শুরু। বন্দনা দিয়েই শেষ। টকশোতেও প্রশংসা-প্রশস্তিই প্রতিপাদ্য হয়ে দাঁড়ায়। তাই অনিবার্য কারণেই তৈল সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা। টকশো পরিণত হয় তৈলজীবী সম্প্রদায়ের একক সম্পত্তিতে। সেখানে চলে তৈলসেবার প্রতিযোগিতা। বিরোধীরা বিতাড়িত হওয়ায় তৈল মর্দন প্রতিযোগিতা হয়ে ওঠে একই ঘরানার বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাবেক আমলা, মুক্তিযোদ্ধা এবং মহাজোটের মহানেতারা দখল করে ফেলেছেন টকশোর ময়দান। পদ-পদবি, গবেষণা-প্রেষণা এবং ব্যবসা-বাণিজ্য হাতিয়ে নেয়ার উপলক্ষ হয়ে ওঠে টকশো।
যে তৈলের যথার্থ ব্যবহার জানে সে হয় মহারাজ। ‘তাহার সব কাজই সোজা। তাহার চাকরির জন্য ভাবিতে হয় না- উকীলিতে পসার করিবার জন্য সময় নষ্ট করিতে হয় না, বিনা কাজে বসিয়া থাকিতে হয় না, কোনো কাজেই শিক্ষানবিস থাকিতে হয় না।’ শাস্ত্রী মহাশয় উল্লেখ করেছেন, ‘যে তৈল দিতে পারিবে, তাহার বিদ্যা না থাকিলেও সে প্রফেসর হইতে পারে, আহম্মুক হইলেও ম্যাজিস্ট্রেট হইতে পারে, সাহস না থাকিলেও সেনাপতি হইতে পারে...’। আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, লাইসেন্স না থাকলেও হাসপাতাল চলতে পারে। ডাক্তার না থাকলেও চলতে পারে চিকিৎসা, কিট না থাকলেও কোভিড-১৯ এর টেস্ট চলতে পারে। এইচএসসি পাস হলেও টকশোর বিজ্ঞ আলোচক এমনকি উপস্থাপক হওয়া যায়। সব সম্ভবের দেশে সবই সম্ভব। তবে একটি অনিবার্য শর্ত আছে।
তাকে অতি অবশ্যই ক্ষমতাসীন দলের কেউ হতে হবে। তাহলে ‘চাল মাটি আল, আল মাটি চাল’ অর্থাৎ সবকিছুই সম্ভব হবে। সবাই দেখে সবাই জানে- এ পরিচয় থাকলে কারো কিছু হয় না। ক্ষমতাসীন দলের ১৮ নাম্বার ওয়ার্ল্ডের ১৯ নাম্বার সদস্যও মনে করে সে সরকারের অংশ। প্রচলিত গল্পটি এরকম- এক লোকের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে তার শেষ ইচ্ছার কথা জিজ্ঞেস করা হয়। সে বলে আমার শেষ ইচ্ছা দলে যোগদান করা। ফাঁসিতে ঝোলানো লোকেরা বলে ওঠে, তা আগে বলবে তো! কার এ দুঃসাহস যে, তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলায়। শুধু গল্পে নয়, এই উদাহরণ বাস্তব। খুনের আসামি খালাস পেয়ে খুন করেছে। সুতরাং দল নামের তেলের মহিমা অতি অব্যর্থ। টকশোতে যে অনর্গল তেল বর্ষণ করেছে, তার কিছুরই অভাব থাকার কথা নয়। আমাদের এ সময়ের আলোচিত ব্যক্তি সাহেদ তার প্রমাণ দিয়েছেন।
এখন বহুলালোচিত সাহেদ করিমের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। যেমনটি করে থাকে বাউন্ডেলে বা স্কুল পালানো ছেলে। পরে তিনি কিভাবে এইচএসসি ‘পাস’ করলেন তা জানা যায়নি। তবে লুটপাটের হাতেখড়ি স্থানীয়ভাবেই। লোকজন জানায়, নানা পরিচয়ে নানা উপায়ে তিনি টাকা মেরেছেন। ২০০৯ সালে প্রতারণার অভিযোগে পুলিশ ও র্যাব তাকে গ্রেফতার করেছিল। কারণ চেক জালিয়াতি।
মামলা তদন্ত কর্মকর্তা ওই সময়ে বলেছিলেন, সাহেদ একজন পেশাদার প্রতারক। এখন দেখা যায়, শাহবাগ-লালবাগ-আদাবর-তেজগাঁওসহ বিভিন্ন থানায় তার নামে প্রতারণার মামলা আছে। প্রতারণার ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে সাহেদ শুরু করেন এলএলএম ব্যবসা। এখন ওই ব্যবসাটি প্রতারণার প্রতিরূপ বলেই পরিচিত। লোকজনের টাকা নিয়ে চম্পট দেন তিনি। ভুক্তভোগীরা তাগাদা দিলে ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে ছিলেন কয়েক বছর। পরে থানা আদালত ম্যানেজ করে দেশে ফেরেন। একমাত্র প্রতারণা, কারসাজি, মিথ্যাচার করে রাজনৈতিক প্রযতেœ ব্যাংক লোন নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের মতো আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। এ সময়ে পাওনাদারকে সন্ত্রাসী দিয়ে পেটান। সাহেদের টর্চার সেল রয়েছে। আরো রয়েছে প্রতারণার জন্য নারী বাহিনী। বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে সাহেদ করিম কখনো মেজর, কখনো সচিব, আবার কখনোবা প্রধানমন্ত্রীর এপিএস হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। সব মিলিয়ে তার বিরুদ্ধে সারা দেশে ৩২টি মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে। রিজেন্ট গ্রুপের ওয়েবসাইটে নিজেদের স্বাস্থ্য অধিদফতরের সহযোগী হিসেবে পরিচয় দেন তারা। কেউ অসুস্থ হলেই ফোন করার কথা বলা আছে সেখানে। চিকিৎসা হবে ‘বিনামূল্যে’। অথচ তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা জনপ্রতি নিয়ে তিনি প্রতারণা-প্রচারণায় উপার্জন করেছেন প্রায় চার কোটি টাকা। এরপর সাহেদ স্বাস্থ্য অধিদফতরে দাখিল করেছিলেন এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার ভুয়া বিল। করোনাভাইরাস পরীক্ষার নামে হাজার হাজার ভুয়া সনদ দিয়েছে রিজেন্ট হাসপাতাল।
করোনা আক্রান্ত রোগীকে ‘সুস্থ’ এবং সুস্থ মানুষকে ‘আক্রান্ত’ বলে সনদ দেয়া হয়েছে। এ ধরনের জালিয়াতির ফলে দেশে যে বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে তা সহজেই বোঝা যায়। রাজনীতিক জি এম কাদের বলেছেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বড় ক্ষতি হয়ে গেছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় হাসপাতালের দক্ষতা ও সক্ষমতা যাচাই না করে কী করে কোটি কোটি টাকার কারবার সাহেদকে দিয়েছিল তা এক বিরাট রহস্য। অভিজ্ঞ মহল মনে করে, এর পেছনে অবশ্যই রাজনৈতিক মদদ রয়েছে। ক্ষমতাবানরা এর পেছনে না থাকলে এতবড় দুঃসাহস সাহেদ দেখাতে পারতেন না। এখন খবর বেরুচ্ছে, উত্তরা ও মিরপুরে রিজেন্ট হাসপাতাল এবং রিজেন্ট গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ের তিনটি ভবনই বিভিন্ন ফন্দি করে ভাড়া নিয়েছেন সাহেদ। অথচ গত কয়েক বছরেও ভাড়া শোধ করেননি তিনি। ভুক্তভোগীরা আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তার বাড়িতে ও অফিসে তার সাথে আছে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মতো ব্যক্তিত্বদের ছবি। কাদের সাথে তার চলাফেরা তা বুঝিয়ে দিয়ে এবং প্রতারণা, ভীতি প্রদর্শন ও ব্ল্যাকমেইল করে তার ব্যবসা চালিয়ে গেছেন। নিজের স্ত্রীও তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ এনেছেন।
নীতিবাক্য বা মহৎ শব্দাবলি উচ্চারণে সাহেদের কমতি ও ঘাটতি ছিল না। রিজেন্ট বোর্ডের ওয়েবসাইটে তার বড় বড় বাণী আছে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ওই বাণী দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিশ^ায়নের এই তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ সময়েও তার মূল লক্ষ্য হলো মানবসেবা, ভোক্তাদের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন, দেশ ও দশের উন্নয়ন।’ অথচ এসবের আড়ালে তিনি আসলে মারাত্মক ধরনের ক্রিমিনাল। মানুষ মহৎ না হতে পারে, কিন্তু সে মহত্ত্বকে প্রতারণার পুঁজি করে না। তা যে করে, তাকে বিশেষিত করতে বিশেষণ কুলায় না। ‘চোর-চোট্টা, গুণ্ডা-পাণ্ডা, বাটপাড়-বদমায়েশ’- সব বিশেষণই যেন তার প্রাপ্য। সাহেদ যে নগ্ন চেহারা দেখিয়েছেন তা নগ্নতার চেয়েও ঘৃণ্য। এদের বলা হয় ‘হোয়াইট কালার ক্রিমিনাল’।
সাহেদের ব্যক্তিগত পরিচয়, প্রবণতা ও কর্মকাণ্ড দ্বারা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তিনি একজন নিকৃষ্ট প্রতারক। প্রতারণার বাহন ও কৌশল অনেক। কিন্তু এমন একটি ধারা ও কৌশলকে সে বেছে নিয়েছে যাকে লোকজন সচরাচর সম্মানের চোখে দেখে। সাম্প্রতিক টকশোর মর্যাদাহানি হলেও তার প্রচারণা ও প্রতারণার উদ্দেশ্য সফল। এসব টকশোই তার গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে অনেকেই বলেছেন, ‘টকশো ব্যক্তিত্ব’ হিসেবেই তারা তার মূল্যায়ন করেছেন। এইচএসসি পাস পেশা এবং পরিচয়ে এমন কিছু সাহেদ ধারণ করে না যাতে তাকে টকশোতে আমন্ত্রণ জানানো যায়। চ্যানেলগুলো থেকে পারিতোষিক নেয়ার পরিবর্তে উল্টো তাদের পারিতোষিক দেয়ার ‘বিনিময়ে’ তিনি আমন্ত্রিত হতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি অবশেষে ‘নতুন কাগজ’ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক হয়েছিলেন। নিজেকে উত্তরা মিডিয়া ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচয় দিতেন। অভিযোগÑ পুঁজিপতিরা এবং রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা গণমাধ্যমের পরিচয়কে তাদের দুষ্কর্মের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। সাহেদ এর বাস্তব প্রমাণ।
সবচেয়ে গুরুতর বিষয়টি হলো, তার রাজনৈতিক পরিচয়। সাহেদ করিম ফলাও করে বলতেন, তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য। ফেসবুকেও তাই রয়েছে। টেলিভিশন টকশোতে জোর গলায় সাহেদ কর্তৃত্বের সাথে বলতেনÑ ‘কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। রাজনৈতিক তকমা গায়ে দিলেই কেউ রেহাই পাবে না’। কে বা কারা দিয়েছে তাকে এই কর্তৃত্বের দোহাই? আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- সাহেদ এখন আর ওই কমিটির সদস্য নন। তবে অতীতে ছিলেন। উপ-কমিটির সাধারণ সম্পাদক বলেছেন, তিনি এখনো মাঝেমধ্যে সভায় এসে উপস্থিত হন। এ ধরনের পেশাদার প্রতারক কিভাবে একটি বড় দলের আন্তর্জাতিক উপ-কমিটির মতো মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে যেতে পারলেন তা এক বড় প্রশ্ন। তাহলে কি যে কেউ তার ধন-দৌলত ও প্রতারণা কৌশলে সবকিছু অর্জন করতে পারে? সেখানে কি কোনো হোমওয়ার্ক, মানে বাছ-বিচার হয় না? সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বর্তমান ও অতীত কি দেখা হয় না? এ ধরনের অর্জনের জন্য যে প্রতারণা কৌশল বা কৃত্রিম ইমেজ সৃষ্টি করতে হয় তা তিনি করেছেন। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা তাদের সাথে ছবি বা ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে তাকে কি সেই অন্যায় ইমেজ তৈরির সুযোগ করে দেননি? ক্ষমতাসীন দলে আজকাল যেন এরকম লোকেরই প্রাধান্য।
ইতোমধ্যে শহিদ ইসলাম নামের এক সংসদ সদস্য কুয়েতে কারারুদ্ধ হয়েছেন। তিনি জাতীয় পার্টির সাথে সমঝোতার টিকিটে ২০১৮ সালের নিশীথ রাতের নির্বাচনে জয়যুক্ত হন। লক্ষ্মীপুর-২ তার নির্বাচনী এলাকা। একজন কলামিস্ট খোলাসা করেছেন, তিনি আওয়ামী লীগার না হয়েও কিভাবে আওয়ামী লীগের মদদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। (সে সময়ে রসিকজনরা বলাবলি করছিল, একই ব্যক্তি একই সাথে দু’পার্টি-সরকারি ও পোষাবিরোধী দলের প্রধান ছিলেন। শহিদ ইসলামের বিজয় কি এর সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় না?)
যা হোক, এই সেদিন পাপিয়া নামের একজন ‘গডমাদার’-এর কাহিনী তোলপাড় তুলেছিল। গত বছর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে সম্রাটসহ যারা ধরা পড়েছিলেন, তাদের প্রায় সবাই ক্ষমতার রাজনীতির সাথে জড়িত। তাহলে মানুষ কি ভাববে ‘বার্ডস অব দ্য সেম ফেদার ফ্লক টুগেদার’? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হবে কি? ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির সময়েও বিজ্ঞজনরা বলছিলেন, রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতালের ছাপোষা লোকদের ধরা হয়েছে। আর সেই রাবণ-রাঘবের খোঁজ নেই? গুজব রটেছে, তিনি ওপারে গিয়েছেন। লোকজন বলাবলি করছেন, যাদের সাথে তার ছবি আছে এখন তারা পার পাওয়ার জন্য হয়তো তাকে ওপারে পাঠিয়েছেন। অথবা নিজেদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রেখেছেন। ‘অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে’, উভয়ই সমান অপরাধী। মনীষী অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ লিখে এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক করেছিলেন। আর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের উচ্চারণ ছিল, ‘তোষামোদি চাটুকার, সাবধান! সাবধান!’ আজ এই হোক আমাদের সমবেত সঙ্গীত। স্যামুয়েল জনসন (১৭০৯-১৭৮৪) হয়তো সাহেদ টাইপের রাজনীতিবিদদের সম্পর্কেই বলেছিলেন, ‘পলিটিক্স ইজ দ্য লাস্ট শেলটার অব দ্যা স্কাউন্ড্রেলস’।
আমরা শুরু করেছিলাম, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘তৈল শাস্ত্র’ নিয়ে। মানব হৃদয়ের সব আবেদন নিবেদন, ভক্তি-শ্রদ্ধা, সৌজন্য-শিষ্টাচার, নম্রতা-আনুগত্য, ¯েœহ-মমত্বÑ সব কিছুকে শাস্ত্রী মহাশয় তৈল চর্চায় একাকার করেছেন। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, ‘বাঙ্গালীর বল নাই, বিক্রম নাই, বিদ্যাও নাই, বুদ্ধিও নাই। সুতরাং বাঙ্গালীর একমাত্র ভরসা তৈল।’ তাই আমাদের সব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজনীতি তৈলনীতিতে পর্যবসিত। আমাদের টকশো, আমাদের হাসপাতাল, করোনাভাইরাসে আমাদের সার্ভিস এবং অর্থের তীব্র আকাক্সক্ষায় প্রতারণা, প্রচারণা, মিথ্যাচার ও দুর্নীতি সবকিছুই ‘তৈলাধার পাত্র তথা পাত্রাধার তৈল-এ নিমজ্জিত’। সব শেষে শাস্ত্রীর বয়ানেই বলি, ‘এক তৈলে চাকাও ঘোরে আর তৈলে মনও ফেরে।’
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়