সব সামলাতেন 'আধুনিক' স্ত্রী সাবরিনা!
সাবরিনা - ছবি : সংগৃহীত
সেবা নয় প্রতারণার মাধ্যমে টাকা বানানোর উদ্দেশ্যেই জেকেজি হেলথ কেয়ার করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী আরিফ চৌধুরী। তার প্রতারণার কাজ সহজ করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরসহ সব দফতর সামলাতেন আধুনিক স্ত্রী ডা: সাবরিনা চৌধুরী। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে তার প্রতিষ্ঠানকে প্রজেক্ট পাইয়ে দেয়া, তা বাস্তবায়নের জন্য মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট, টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও টেকনিশিয়ানদের ব্যবহার করার সব দায়িত্ব ছিল সাবরিনার ওপর। এমনকি যে শর্তে জেকেজি স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে প্রজেক্ট নিয়েছিল তার উল্টো করার পরও অধিদফতরকে ম্যানেজ করার দায়িত্বেও ছিলেন এই সাবরিনা। অন্য দিকে সাবরিনাকে সহযোগিতা করেছেন বিএমএর একজন নেতা।
সদ্যবরখাস্ত হওয়া ডা: সাবরিনাকে গ্রেফতারের পর মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের বিভিন্ন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। এ দিকে ডা: সাবরিনার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটি তদন্তের জন্য ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার তেজগাঁও থানা থেকে মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। এরপরই সাবরিনাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানা থেকে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এর আগে গত সোমবার জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডা: সাবরিনাকে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ।
পুলিশ বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে জেকেজি হেলথ কেয়ারকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার কথা স্বীকার করেছেন ডা: সাবরিনা। তবে ওই প্রতিষ্ঠান থেকে তিনি আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন এমন কথা স্বীকার করেননি। এ ক্ষেত্রে পুলিশ জেকেজি হেলথ কেয়ারের সাবরিনার স্বামী আরিফ চৌধুরীর বক্তব্য গ্রহণ করবে। প্রয়োজনে তাদের দু’জনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলেও জানা গেছে।
ডিবির তেজগাঁও বিভাগের ডিসি গোলাম মোস্তফা রাসেল জানান, জেকেজির মাধ্যমে যেসব রোগী করোনার টেস্ট রিপোর্ট নিয়েছেন তাদের খোঁজ নেয়া হচ্ছে। একটা তালিকা তৈরি করে কার শারীরিক অবস্থা কেমন রয়েছে, কে কতটা ক্ষতির শিকার হয়েছেন সেসব ব্যাপারে খোঁজ নেয়া হতে পারে। এ ছাড়াও ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে তাদের কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে তাও জানার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, মামলাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, করোনায় সরকার স্বাস্থ্য খাতে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা দেয়। এই সুযোগে অবৈধ পন্থায় বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফন্দিতে নামেন আরিফ চৌধুরী। একপর্যায়ে তার জেকেজি হেলথ কেয়ারের নামে বিনামূল্যে করোনা টেস্টের অনুমোদন নেয়। এরপর শুরু হয় প্রতারণা। প্রতিষ্ঠানটির একটি ল্যাপটপ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী তারা ২৭ হাজার রোগীকে করোনা টেস্টের রিপোর্ট দিয়েছে। এর মধ্যে ১১ হাজার ৫৪০ জনের করোনার নমুনা আইইডিসিআরের মাধ্যমে সঠিক পরীক্ষা করানো হয়েছিল। বাকি ১৫ হাজার ৪৬০টি রিপোর্ট পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটির ল্যাপটপে তৈরি করা হয়। তাদের হটলাইন নম্বরে ফোন করলে প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতেন। আবার অনেকে জেকেজির বুথে এসে নমুনা দিতেন। তাদের মাঠকর্মীরা ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে করোনা উপসর্গ দেখা দেয়া মানুষের নমুনা সংগ্রহ করত।
সূত্র জানায়, জেকেজির প্রকল্প হাতিয়ে নেয়া, সেটি বাস্তবায়নের জন্য সব টেকনিক্যাল কাজ ডা: সাবরিনা করতেন। এমনকি সাবরিনার ডাকে সাড়া দিয়েই তিতুমীর কলেজে তাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে যান স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কিন্তু তারা যে মানুষের সাথে প্রতারণা করছে সে ব্যাপারে কোনো খোঁজ রাখেননি ওই কর্মকর্তারা। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যখন তাদের প্রতারণা সম্পর্কে জানতে পারে তখন থেকেই অভিযুক্তরা বিভিন্নভাবে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। তাদের দাবি ছিল যেসব অপকর্ম হয়েছে তা জেকেজির চাকরিচ্যুত কর্মচারীরা করে গেছে।
পুলিশ আরো জানায়, জেকেজি হেলথ কেয়ারে যেসব কর্মী কাজ করত, তাদের অনেকেই টেকনিক্যালি দক্ষ ছিল না। কিন্তু তাদেরকে নামে মাত্র প্রশিক্ষণ দিয়ে মাঠে ছেড়ে দেয়া হয়। আর এই প্রশিক্ষণ ও লোক সরবরাহ কাজে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের কার্ডিয়াক সার্জন ডা: সাবরিনা জড়িত ছিলেন। জেকেজির চেয়ারম্যান হিসেবে বিভিন্ন মহলে মক্তব্যও দিয়েছেন তিনি। তবে এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিত তথ্য পেতে ডা: সাবরিনাকে জিজ্ঞাসাবাদের পাশাপাশি মামলার অপর আসামিদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
প্রসঙ্গত, প্রতারণা ও করোনা রিপোর্ট জাল-জালিয়াতির অভিযোগে গত রোববার দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ তেজগাঁও বিভাগের ডিসি কার্যালয়ে ডাকা হয় সাবরিনাকে। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে জেকেজির রিপোর্ট জালিয়াতির সাথে তার সম্পৃক্ততা পাওয়ায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে একই মামলায় গ্রেফতার হন আরিফ চৌধুরী।