ইরান-চীন মিত্রতায় বিপদে ভারত!

রুহানি ও শি - ছবি : সংগৃহীত
ওপেন সোর্স ডোমেইনগুলোতে এখন সহজলভ্য তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তেহরানে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সফরের সময় হওয়া চুক্তির ভিত্তিতে চীন ও ইরান ২৫ বছর মেয়াদি একটি ব্যাপকভিত্তিক অংশীদারিত্বে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। ওই সফরের পর ইরানি প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন যে দুই দেশের সম্পর্কে নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে যাচ্ছে এবং আগামী ১০ বছরের মধ্যে তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ৬০০ বিলিয়ন ডলারে যাবে।
ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ জারিফের ২০১৯ সালে চীন সফরের সময় চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং লি ২০১৬ সালের চুক্তির আলোকে ২৫ বছর মেয়াদি চীন-ইরান কৌশলগত অংশীদারিত্ব রূপরেখা উপস্থাপন করেন বলে সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি নথিতে দেখা গেছে।
প্রেসিডেন্ট শি তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আলোকেই ইরান-চীন কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি করতে চাচ্ছেন।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ইরানের পরিবহন অবকাঠামো আধুনিকায়নের জন্য চীন ১২০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়েঅগ করবে। এর শুরু হবে তেহরানকে চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের উরুমকির সাথে সংযুক্তকারী ২,৩০০ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণের মাধ্যমে। এই রাস্তা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) সাথে যুক্ত হবে। সিপিইসি আবার নতুন সিল্ক রোডের অংশ। এটি কাজাখস্তান, কিরজিগস্তান, উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তান এবং সেখান থেকে তুরস্ক ও চূড়ান্ত পর্যায়ে ইউরোপকে যুক্ত করবে।
চীনা বিনিয়োগে তেহরানকে মোশাদের সাথে যুক্তকারী রেললাইন আধুনিকায়নের একটি প্রকল্পও রয়েছে। এছাড়া তেহরান-কোম-ইসফাহান দ্রুতগতির রেললাইন নির্মাণের একটি প্রকল্পও আছে। এই রেললাইনটি তাবরিজ পর্যন্ত সম্প্রসারণের কথা রয়েছে। এখানে তেল, গ্যাস ও পেট্রোক্যামিকেলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে।
ইরানের পেট্রোক্যামিক্যাল, তেল ও গ্যাস শিল্পেও বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বাধীন অর্থনৈতিক অবরোধের কারণে এসব শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইরানে নিজের প্রকল্পগুলো সুরক্ষিত রাখতে ইরানে ৫ হাজার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন। চুক্তি অনুযায়ী, মার্কিন অবরোধ উপেক্ষা করে ইরান থেকে তেল আমদানি বাড়াবে চীন।
কৌশলগত অংশীদারিত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সহযোগিতা। এর মধ্যে রয়েছে অস্ত্র উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়। চীনকে ইরানি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহার করতেও দেবে ইরান।
তবে ইরানে এই অংশীদারিত্ব চুক্তির বিরুদ্ধে সমালোচনাও আছে। সাবেক ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমদিনিজাদ বলেছেন, ইরানি জাতি এই ২৫ বছর মেয়াদি কৌশলগত চুক্তি মানবে না। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, জাতিকে না জানিয়ে কোনো গোপন চুক্তি করা হলে তা বাতিল হয়ে যাবে।
ইরানি জনসাধারণের একটি অংশের মধ্যে বিরোধিতার পাশাপাশি আরেকটি সমস্যা আছে চীনের। তা হলো মার্কিন অবরোধ। ইরানের সাথে সম্পর্ক জোরদার করলে মার্কিন অবরোধের মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে চীনের।
চীন গত এক দশকে বছরে ২০০ বিলিয়ন ডলার করে বিদেশে বিনিয়োগ করে যাচ্ছে। সিপিইসিতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে ৬০ বিলিয়ন ডলার। এই প্রকল্প কাঙ্ক্ষিত সুফল দেবে কিনা তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না।
তবে ভারতীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইরান-চীন সম্পর্ক দুচিন্তার কারণ। এতে করে কৌশলগত অবস্থান ভারতের প্রতিকূলে চলে যেতে পারে। ইরানের চাবাহার বন্দর ভবিষ্যতে ভারত কতটুকু ব্যবহার করতে পারবে, তা নিয়েও সংশয়ের সৃষ্টি হবে। তাছাড়া চীনের সমর্থন পাকিস্তান-ইরান-তালেবান জোট ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ হবে।
মার্কিন অর্থনৈতিক অবরোধের পর ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক বেশ শীতল হয়ে পড়েছে।আর ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত গভীর সম্পর্ক দিল্লির সাথে তেহরানের সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দিচ্ছে। এখন যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাতে করে অদূর ভবিষ্যতে ইরানের সাথে ভারতের সম্পর্ক উষ্ণ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
ইরানে চীনের অবস্থান বাড়লে তা কেবল তেহরানের সাথে দিল্লির সম্পর্কের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে না, সেইসাথে আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর ওপরও তা অনুভূত হবে।
লেখক : সাবেক কর্মকর্তা, ভারতীয় সেনাবাহিনী
ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস