কে এই অলি
অলি - ছবি : সংগৃহীত
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি সাধারণ নির্বাচনে ২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার জিতে তার সমর্থক পরিধি আরও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। নেপাল ১৩ প্রধানমন্ত্রী এপর্যন্ত ২৫টি সরকার উপহার দিয়েছেন। দুই থেকে আড়াই বছরই বেশিরভাগের আয়ু। দ্য হিন্দুকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অলি সম্প্রতি দাবি করেছিলেন, জাতীয় সংসদের আস্থা ভোটে তিনি কেবল ৮৮ ভাগ ভোটই লাভ করবেন না। এমনকি এর বাইরে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশ সদস্য তাকেই ভোট দিতে আগ্রহী । কিন্তু শুধু দলীয় বিধিনিষেধের কারণে তারা তাকে ভোট দিতে পারছেন না।
রাজনীতির অলিগলি অলির চেনা। গোড়া থেকেই তার দলের অভ্যন্তরে তার কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার একটা প্রবণতা ছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি সবসময়ই নেপালি রাজনীতির জনপ্রিয়তার শীর্ষে আসার চেষ্টা করেছেন। এবং এতকিছুর পরেও সেই ধারাটা হোঁচট খেতে খেতে হলেও এগিয়ে যাচ্ছ।
তার ডাকনাম ধ্রুব। পূর্বাঞ্চলীয় নেপালের ঝাপা এলাকায় তিনি শৈশবে বেড়ে ওঠেন। তিনি মানুষ হয়েছিলেন নানীর কাছে । কারণ স্মল পক্সে তার মা যখন মারা যান, তখন তার বয়স মাত্র ৪। এবং একজন কিশোর হিসেবে ওই অঞ্চলের ‘ঝাপা বিদ্রোহ’ কিংবা কৃষক বিদ্রোহে তিনি আলোচিত হন। সেটা ১৯৬৭ সাল। ভূ–স্বামীদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল । তার বয়স যখন ১৮ তখনই তিনি নাম লিখিয়েছিলেন কমিউনিস্ট পার্টিতে এবং তার পরপরই তিনি জীবনে প্রথম গ্রেপ্তার হওয়ার স্বাদ পান। পরবর্তীকালে তাকে দেখা হয়, তিনি একজন ‘উগ্র জাতীয়তাবাদী।’ এর একটা কারণ হয়তো এই যে, একসময় তিনি বামপন্থী রাজনীতিতে সক্রিয় হন । নেপালি অভিজাত শ্রেণীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। আর তখন থেকেই বলা শুরু হয় যে, তিনি আসলে ভারতীয় নকশাল আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন । এবং তিনি অনেকটা ঘনঘন কারাগারে যাওয়া-আসার উপরেই থেকেছেন। জেলজীবন তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের একটা উল্লেখযোগ্য সময়। হিসেব করলে সময়টা ১৪ বছরের বেশি হবে । এবং তার সহযোগীরা বলছেন,তিনি কারাগারে বসে যে রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন, তারই প্রতিফলন ঘটছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার দৈনন্দিন কর্মে।
অলিকে জানেন কয়েক দশক ধরে এমন একজন সাংবাদিক তার সম্পর্কে বলেছেন, তিনি যে কারো চেয়ে নিজের উপরই সবথেকে বেশি আস্থা রাখেন। এমনকি কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি যদি একা হন, তাহলেও তিনি তার সংকল্পে অবিচল থাকার চেষ্টা করেন ।
তিনি স্বশিক্ষিত। শিক্ষা নিয়েছেন কারাগারে। কখনো কোন শিক্ষাগত ডিগ্রী নেননি। কিন্তু কারাগারে বসে অধ্যায়ন করেই তিনি দর্শন এবং ইতিহাস শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। তিনি ইংরেজি লিখতে পারেন না । কিন্তু বলতে পারেন অনর্গল।
তিনি কি ভারতপন্থী?
প্রশ্ন উঠেছে অলি ভারতপন্থী কিনা? একজন ভারতীয় বিশ্লেষক সুভাষিনী হিন্দুতে লিখেছেন, ১৯৮৭ সালে কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে গঠন করেছিলেন একটি ফ্রন্ট । আর সেই ফ্রন্টের রাজনীতি পঞ্চায়েত শাসনামলের পতন ঘটিয়েছিল । এর পরেই তিনি নেতৃত্ব দেন সিপিএন– ইউ এম এল রাজনৈতিক জোটের। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা লাভ করার সুযোগ পেয়েছিলেন । কারণ ওই সময় তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। এবং মজার বিষয় হলো , তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতেই ভারতের সঙ্গে মহাকালী পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। অথচ এই চুক্তিকে কেন্দ্র করে নেপালি রাজনীতিতে ঝড় উঠেছিল । আর সেই ঝড়ে তার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোটে ভাঙন ধরে। কারণ তাদের জোটের একটি অংশ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, ভারতের সঙ্গে যে মহাকালী চুক্তিটি করা হলো, সেটি বৈষম্যমূলক। সেটা ভারতের পক্ষেই গেছে । কিন্তু সেই সময় দেখা গেছে, অলি সেই চুক্তির পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।
আর তখন তাকে একজন ভারতপন্থী হিসেবে দেখা হতো। আজকের নেপালি রাজনীতিতে অনেকে চিন্তাই করতে পারবেন না, সেই নেতা নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়ন থেকে চার মাসের অর্থনৈতিক ব্লকেড শেষ করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ পর্যন্ত বনে গেছেন ভারত বিরোধী হিসেবে।
প্রশ্ন হলো করোনাকালের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় নেপালের রাজনীতিতে সর্পিল রাজনীতি কোন দিকে যাচ্ছে?
কী ঘটতে যাচ্ছে
অলির সমর্থকদের মতে তিনি সমকালীন রাজনীতির সবথেকে মেধাবী নেতা। বহু বছর ধরে তারা তাকে দেখে এসেছেন। তিনি তার নেতৃত্বের গুণাবলীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চলেছেন । ৬৬ বছর বয়সে যদিও তার নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে তার কিডনি প্রতিস্থাপনের মতো ঘটনাও আছে। ২০০৭ সালে দিল্লির একটি হাসপাতালে তিনি কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করেছিলেন কিন্তু ভারতীয় ভাষ্যকারগণ মনে করেন, সবথেকে কৌতুহলী স্ববিরোধিতা হলো, তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের জায়গা। আদর্শিকভাবে নিশ্চয়ই তিনি ১৯৭০ দশকের সেই তরুণের ভূমিকায় নিজেকে দেখতে চান না।
সেদিক থেকে আগামী ২২ এপ্রিল ( কেউ লিখেছে ১৭ এপ্রিল) তারিখটি নেপালের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে নেপালি কমিউনিস্ট পার্টি মাওবাদীদের সঙ্গে একীভূত হবে। তৈরি হবে একটি ইউনিট। ঐক্যবদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল। সমালোচকরা অবশ্য বলেন, অলি তার কমিউনিস্ট নীতি আদর্শের মধ্যে ধর্ম মিশিয়ে একটা ককটেল তৈরি করেছেন । তাকে সর্বদাই ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে সরবে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায় । এবং তিনি যখন ওই উপসনালয়গুলোতে কথা বলেন তখন তার কণ্ঠে অবিশ্রান্তভাবে ঝরে পড়ে সংস্কৃতির শ্লোক । যখন তাকে সম্প্রতি ভারতীয় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেছিলেন, তার সামনে এখন চ্যালেঞ্জ কি? অলি বলেছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত তার উপরে পশুপতিনাথের আশীর্বাদ রয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি কোনো কিছুকেই পরোয়া করেন না ।