ব্যর্থতা আড়াল করতে চীনের সাথে বৈরিতা!
নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
গত ছয় মাস ধরে চীনের জন্য তীব্রভাবে ও বিস্তৃতভাবে সমস্যা সৃষ্টি করে চলেছে ভারত। ১৯৬২ সালের সশস্ত্র সঙ্ঘাতের পর দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে গেছে।
ভারতর সৃষ্ট সমস্যাগুলোর মধ্যে রয়েছে : সামাজিক পর্যায়ে চীনা পণ্য বয়কটের ডাক। কৌশলগত মহলে চীনা হুমকি নিয়ে সোরগোল। ভারতীয় ও চীনা অর্থনীতিতে আলাদা করা। তারপর ৫৯টি চীনা মোবাইল অ্যাপসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এছাড়া চীন-ভারত সীমান্তে প্রায়ই সামরিক উত্তেজনা সৃষ্টি করা। এটি সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয় সাম্প্রতিক ব্যাপক সামরিক শক্তি বৃদ্ধিতে।
অনেকেই প্রশ্ন করেন : গত দুই বছরে দুই দেশের নেতারা সফলভাবে দুবার অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন, ভবিষ্যতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ঐকমত্যে পৌঁছেছেন, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো একসাথে মোকাবেলায় একমত হয়েছেন। কিন্তু তারপর হঠাৎ করে বিপরীত হলো কেন এই সম্পর্ক?
আমার দৃষ্টিতে এর কারণগুলো নিম্নরূপ :
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার প্রথম ৫ বছরে ভারতের অর্থনীতিতে সাফল্য আনতে পেরেছিলেন। কিছু লুকোচুরি থাকলেও বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ ভাগের বেশি, যা ভারতের ইতিহাসে আশ্চর্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
কিন্তু গত বছর দ্বিতীয় মেয়াদে প্রবেশ করার পর থেকে নরেন্দ্র মোদির জাতীয়তাবাদী নীতি, যেমন রাম মন্দির নির্মাণের ঘোষণা, অভিন্ন সিভিল কোড প্রবর্তন, নাগরিকত্ব আইন সংশোধন ইত্যাদি বিষয়গুলো সঙ্ঘাত তীব্র করছিল, বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে মতপার্থক্য বাড়িয়ে দিচ্ছিল। ফলে সামাজিক অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছিল।
চলতি বছর কোভিড-১৯-এর বিস্তার ভারতে ঘটে দ্রুততার সাথে। এখন মনে হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। এই মহামারিতে সবচেয়ে ভয়াবহভাবে আক্রান্ত চারটি দেশের একটি হচ্ছে ভারত। কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ করতে ভারত কঠোর লকডাউন করেছে। এতে করে কোটি কোটি শ্রমিক দৈনন্দিন আয় থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্ষুধায় থাকছে। বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, লকডাউনের ফলে অন্তত ৫ কোটি লোক ভারতে চাকরি হারিয়েছে। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে, লকডাউনের ফলে ৪০ কোটি লোক ভয়াবহ দারিদ্র্যের শিকার হয়েছে।
অর্থনীতিতে মারাত্মক ধসের সৃষ্টি হয়েছে।ওইসিডির হিসাব অনুযায়ী, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি বছর হতে পারে মাইনাস ৩.৭ ভাগ। আর মহামারিটি যদি আরো বিস্তৃত হয়, তবে তা মাইনাস ৭.৩ ভাগও হতে পারে। একইসাথে কংগ্রেসের নেতৃত্বে বিরোধী দলগুলো নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীণ বিজেপির ওপর ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণ চালাচ্ছে।
ফলে মনে হচ্ছে, অর্থনৈতিক কার্ডটি খেলে রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার কোনো আশঅ নেই। ফলে স্মার্ট নরেন্দ্র মোদি রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী ফ্যান্টাসির পথ ধরেছেন। এ কারণে ভারত এখন পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের সাথে ব্যস্ত রয়েছে, উত্তর ও পূর্ব দিকে যথাক্রমে চীনা ও নেপালি ভূখণ্ড দখল করার চেষ্টা করছে।
ভারতের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে,যখনই কোনো ঘরোয়া সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, তখনই ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাইরের কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে জনসাধারণের মনোযোগ সরিয়ে ফেলেছে।
অন্যান্য পথ সৃষ্টি
মোদি ২০১৪ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে জিডিপিতে ভারতের ম্যানুফেকচারিং শিল্পের অবদান ১৮ ভাগ থেকে ২০২২ সাল নাগাদ ২৫ ভাগে উত্তীর্ণ করবেন বলে জানান। কিন্তু এই খাতে অগ্রগতি না হয়ে বছরের পর বছর তা হ্রাস পেতে থাকে। এখন ম্যানুফেকচারিং শিল্প ১৪ থেকে ১৫ ভাগে নেমে এসেছে, যা গত ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
আবার করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় ভারতের ম্যানুফেকচারিং শিল্প ভয়াবহ অবস্থায় পড়েছে। বিশেষ করে মোদি সরকার যে চারটি খাতে বিশেষভাবে আশাবাদী ছিলেন সেখানেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে। এগুলো হচ্ছে মোবাইল ফোন, বস্ত্র, ইলেকট্রনিক্স ও অটো পার্টস।
আঞ্চলিক প্রধান্য বিস্তারের স্বপ্ন
দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে নয়া দিল্লির বিশেষ প্রাধান্যবিশিষ্ট এলাকা বিবেচনা করা হয়। তবে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) ফলে চীনের ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগ বেড়ে গেছে। ভারত প্রকাশ্যেই চীনের বিআরআইয়ের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। দেশটি মনে করে, দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর ভারত মহাসাগরে ভারতের প্রাধান্য ভেঙে দিতেই চীনা এই উদ্যোগ।
কিন্তু চীনকে একাকী সামাল দেয়ার শক্তি না থাকায় নয়া দিল্লি এখন চীনকে সংযত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত জোট গড়ছে। এটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বৃহ্ত্তর স্বস্তি এনে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় তার কক্ষপতে ভারতকে রাখতে।
শেষ কথা
দীর্ঘ সময় ধরে ভারতের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ার স্বপ্ন লালন করেছে চীন। গত ৪০ বছরে ভারত ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক বিপুলভাবে উন্নত হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১৯৮০-এর দশকের প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার থেকে ৯২.৬৮ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। উভয় পক্ষের চেষ্টাতেই তা হয়েছে।
চনি ও ভারতের মধ্যকার সহযোগিতা উভয় দেশের জন্যই কল্যাণকর।এই সহযোগিতা ক্ষতিগস্ত হওয়াটা ভারতের স্বার্থের অনুকূল নয়।
৪০ বছর আগে চীন ও ভারতের অর্থনীতি প্রায় একই অবস্থায় ছিল্ কিন্তু এখন ভারতের জিডিপি ও মাথাপিছু ডিজিপি চীনের এক পঞ্চমাংশের চেয়েও কম। চীনের দুটি সুবিধা এছ : পুঁজি ও প্রযুক্তি। ভারত যদি সফল হতে চায়, তবে চীনের সহযোগিতা ছাড়া তা সম্ভব হবে না। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত করতে চাইলে ভারত ও চীনের মধ্যকার ব্যবধান আরো বাড়বে। আর তাতে শেষ পর্যন্ত ভারত অনেক পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
লেখক : ভিজিটিং প্রফেসর, সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটি, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড ল