ভারত-চীন উত্তেজনা : বিরোধের বীজ অনেক গভীরে

মাসুম খলিলী | Jul 09, 2020 10:43 pm
মোদি ও শি

মোদি ও শি - ছবি : সংগৃহীত

 

এ কথা সত্যি যে, চীন ও ভারতের বিরোধের যে উপাদান তা ঐতিহাসিকভাবে গভীরে প্রোথিত। চীন রাষ্ট্রের স্বীকৃত সীমানা কমিউনিস্ট বিপ্লবের আগে নির্ণিত না থাকায় দেশটির ভূ-সীমানার দাবি সুনির্দিষ্ট নয়। যার ফলে সীমানাবিরোধ বিভিন্ন মধ্য এশিয়ান প্রজাতন্ত্র, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, জাপান থেকে ভারত, নেপাল মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় সব প্রতিবেশীর সাথে রয়েছে। অন্য দিকে ভারত রাষ্ট্রের স্থল সীমানায় থাকা সব দেশের সাথেও কম-বেশি বিরোধ রয়েছে দিল্লির। 

ভূমি বিরোধ এতটাই জটিল বিষয় যে, এগুলোর সহজেই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে বিরোধের বিষয়গুলোকে স্থিতাবস্থায় রেখে সহযোগিতার বাকি ক্ষেত্রগুলোকে নিয়ে সামনে এগোনো যায়। এ প্রক্রিয়ায় রাশিয়াসহ বেশ ক’টি দেশের সাথে সীমান্ত বিরোধের আপাত অবসান ঘটিয়েছে চীন। ভারতের সাথেও একই পথে হেঁটে বেইজিং অর্থনৈতিক ও অন্যান্য আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রটিকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ধারাতে ছেদ পড়ে ভারতের কৌশলগত নীতি পরিবর্তনের পথে এগোনোর কারণে।

কী সেই পরিবর্তন?
১৯৪৭ সালে ভারত যখন স্বাধীনতা লাভ করে তখন যে চারটি নীতিকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করে তার অন্যতম ছিল সমাজতন্ত্র। ভারত অন্য কয়েকটি দেশকে নিয়ে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন গড়ে তুললেও স্নায়ুযুদ্ধ সময়ে দেশটি জাতীয় প্রতিরক্ষা কৌশলে সোভিয়েত বলয়ের সাথে যোগসূত্র রক্ষা করে। ভারতের প্রতিরক্ষা সম্ভার ছিল মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এর মিত্র দেশগুলোর। এর বিপরীতে পাকিস্তান ছিল মূলত আমেরিকান বলয়ে। চীন তার নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখে আর ষাটের দশকে সোভিয়েতের সাথে ভৌগোলিক ও আদর্শগত সঙ্ঘাত তৈরি হয় বেইজিংয়ের। এই বাস্তবতায় ’৮০-র দশকের শেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগ পর্যন্ত ভারত সোভিয়েত ধারায় ছিল।

নতুন মেরুকরণ
স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পুরো বিশ্ব ব্যবস্থায় বেশ খানিকটা পরিবর্তন আসে। সোভিয়েত বলয়ের অনেক দেশই তখনকার একক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র্রের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে তোলার প্রচেষ্টা নেয়। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রও সোভিয়েত বলয়ের অনেক দেশের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করে। এমনকি রাশিয়ার পুনরুত্থানের আগ পর্যন্ত সোভিয়েত বলয়ে ছিল এমন বেশ কয়েকটি দেশকে ন্যাটোর সদস্য করে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৯০ এবং ২০১০-এর দশকের পুরো সময়টা স্নায়ু যুদ্ধোত্তর একটি অবয়ব গ্রহণের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এ সময় চীন বিশ্ব ব্যবস্থার সাথে সমন্বিত করে ধীরে ধীরে নিজেকে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে থাকে। একই সাথে নিজেকে উন্নত সামরিক-বেসামরিক প্রযুক্তি অর্জনের দিকে নিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের বিপরীতে সীমান্ত বিরোধের অবসান ঘটিয়ে রাশিয়ার সাথে কৌশলগত অক্ষ তৈরি করে।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তির এর বিপরীত পদক্ষেপটি ছিল উদীয়মান পরাশক্তি চীনকে ঘিরে একটি প্রতিরোধ বলয় নির্মাণ করার, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হয় ভারত ও জাপানকে। এশিয়ার নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নেতৃত্বে নিয়ে যাওয়ার প্রলোভন সামনে নিয়ে আসা হয়। আর একই সাথে সোভিয়েতকেন্দ্রিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে পশ্চিমকেন্দ্রিক ভারতীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরির জন্য নানা উদ্যোগ নেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি ছিল এ ক্ষেত্রে একটি তাৎপর্যপূর্ণ পদক্ষেপ। একই সাথে ইসরাইল এবং ফ্রান্স ব্রিটেনের সাথে ভারতের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা চুক্তি ও সমঝোতা হয়।

কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার এ ক্ষেত্রে কিছুটা ধীর পদক্ষেপে এগোচ্ছিল। কিন্তু এর পরে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপির সরকার তার নিজস্ব ডকট্রিনের সাথে এই পরিবর্তনকে একাত্ম করে এই পথে দ্রুত ভারতকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়। আর এই সমঝোতার অংশ হিসেবে নরেন্দ্র মোদিকে অনেক বড় নেতা এবং বিজেপিকে ভারতের উল্লেখযোগ্য দলে পরিণত করার জন্য সব ধরনের সহায়তা পশ্চিমা রাষ্ট্রশক্তি ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দেয়া হয়।
বিপরীত দিকে রাশিয়ার জন্য ভারত ছিল এক বড় প্রতিরক্ষা বাজার। রাশিয়া এবং চীন দুই দেশই চায় এশিয়ায় ভারত পশ্চিমের টুলস না হয়ে এশীয় সহযোগিতার একটি অংশ হোক। এর অংশ হিসেবে ব্রিকস, নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক এবং সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার কাঠামো নির্মাণও এগিয়ে নেয়া হয়। স্থিতাবস্থাকে ভিত্তি ধরে সীমান্ত বিরোধের বিষয়গুলোর সাময়িক নিষ্পন্ন হয়, এরপর এই সমস্যা আর মাথা ছাড়া দেয়নি।

সঙ্কট চীনবিরোধী অক্ষে যোগদান
নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর ভারতকে দ্রুত আমেরিকান বলয়ের সাথে একাত্ম করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়, বিশেষত চীনের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র জাপান অস্ট্রেলিয়া ভারত ভিয়েতনাম প্রভৃতি রাষ্ট্রের সমন্বয়ে একটি প্রতিরক্ষা জোট গঠনের উদ্যোগ নেয়ার ফলে চীনের সাথে ভারতের পুরনো সমঝোতা ভেঙে পড়তে থাকে। একই সময়ে ভারত নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হওয়া এবং পরমাণু প্রযুক্তি রফতানিকারক দেশে পরিণত হওয়ার প্রচেষ্টা নিলে চীন তার বিরোধিতা করে। ফলে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব আরো বাড়তে থাকে।

সর্বশেষ চীনের কৌশলগত ‘ওয়ান বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের সক্রিয় বিরোধিতার ফলে দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব আরো বেড়ে যায়। ভারত এই প্রকল্পে যোগদানের ব্যাপারে শুধু অস্বীকৃতিই জানায়নি একই সাথে এই প্রকল্পকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য গোপন উদ্যোগ গ্রহণ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আফগান সশস্ত্রবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ভারতের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা আর এর মাধ্যমে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বেলুচিস্তান করাচি এবং খায়বার পাখতুন খোয়ায় সন্ত্রাসী তৎপরতায় ইন্ধন প্রদান আর সর্বশেষ কাশ্মিরের বিশেষ মর্যাদা একতরফাভাবে বাতিল করে দেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক হিসেবে দেখতে থাকে বেইজিং।

একই সময়ে ভারতীয় সংসদে আজাদ কাশ্মির এবং বেল্ট ও রোড প্রকল্পের চীন পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর অতিক্রমকারী গিলগিট-বাল্টিস্তান আর আকসাই চীনকে ভারতের ভূমি বলে সংসদে দাবি করা চীনের উৎকণ্ঠা ও সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে তুলে। এই সময়টাতে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখা পার হয়ে ভারতীয় সামরিক তৎপরতা চালানোকে চীন পাকিস্তান উসকানিমূলক ও উদ্বেগজনক হিসেবে চিহ্নিত করে। অতি সম্প্রতি করাচি ও বেলুচিস্তানে অন্তর্ঘাতী তৎপরতার সাথে ভারতের গোপন সম্পৃক্ততার তথ্য আসে তাদের কাছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us