চীন-ভারত যুদ্ধ কেন এখন হবে না?
ট্যাঙ্ক - ছবি : সংগৃহীত
তুমুল উত্তেজনার মধ্যেও চীন ও ভারত সাময়িকভাবে হলেও সমঝোতা করেছে অপ্রত্যাশিতভাবে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, চীন এবং ভারত কোনো দেশের জন্য পরস্পরের সাথে যুদ্ধ করার জন্য এখনকার সময় উপযুক্ত পরিবেশ নয়। ভারত এখন সবচেয়ে দ্রুত করোনা সংক্রমণের একটি দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটির প্রতিরক্ষা বাজেটের বড় অংশ উন্নত প্রযুক্তি সংগ্রহে ব্যয় করার কারণে সেনাবাহিনীকে যুদ্ধসক্ষম রাখার জন্য যে গোলাবারুদ ও রশদপত্র প্রয়োজন তার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। একান্ত মিত্র দেশ বলতে কোনো রাষ্ট্র ভারতের চার পাশে এখন সেভাবে নেই।
কিস্তান কৌশলগতভাবেই চীনা মিত্র, নেপাল চীনের অধিক নিকটবর্তী একটি দেশে পরিণত হয়েছে, শ্রীলঙ্কার সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে, বাংলাদেশ চীন-ভারত সঙ্ঘাতে নিরপেক্ষ ভূমিকার বিষয়ই বিবেচনায় রেখেছে। এ অবস্থায় কোনো প্রতিবেশী দেশ ভারতের পাশে দাঁড়ানোর মতো নেই। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল দিল্লির পাশে দাঁড়াতে পারে। এরপরও এই সময় চীনের মতো দেশের বিরুদ্ধে সামরিক সঙ্ঘাত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে ভারতের জন্য।
অন্য দিকে, চীনও এখন করোনার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বেশ চাপের মধ্যে রয়েছে। হংকং ও তাইওয়ান ইস্যুও বেইজিংয়ের চাপের একটি কারণ হয়ে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের করোনাউত্তর সম্ভাব্য বাণিজ্য যুদ্ধের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। চীন নিজেকে অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার যে পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই সময় যুদ্ধে জড়ানোর জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। কিন্তু নিজের দোরগোড়ায় ক্রমবর্ধমান বৈরিতা তৈরি হওয়ার বিষয় মেনে নেয়াও দেশটির পক্ষে কঠিন। ফলে জবাব পাল্টা জবাবের বিষয় এখন ঘটছে।
এ কারণে ভার্স্ক ম্যাপলোক্রফটের এশিয়া ফর রিস্ক ইনসাইটের প্রধান মিহা রিবার্নিক লিখেছেন, ‘ভুল গণনার ঝুঁঁকি একদিকে সরিয়ে রাখলে আমরা বিশ্বাস করতে পারি যে যুদ্ধের দামামাকে এড়িয়ে নেয়ার খুব একটা ক্ষুধা তাদের নেই। এর পরও, মোদি বা শি কেউই অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘকালীন সার্বভৌমত্বের বিরোধের বিষয়টি পুরোপুরি শেষ করতে পারবেন না। আর আমরা আশা করতে পারি যে বিতর্কিত সীমান্ত অঞ্চল বরাবর উত্তেজনা বছরের বাকি সময় অব্যাহত থাকবে, উভয় পক্ষই পুরোপুরি পেছনে আসতে রাজি হবে না, তবে এটার আরো বৃদ্ধি করার ব্যাপারেও তারা উৎসাহী হবেন না।’
ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের পান্তের বক্তব্যটিও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার মতো তুলনামূলকভাবে উচ্চতর মৃতের সংখ্যা খুব দীর্ঘ সময়ের জন্য, বিশেষত অর্থনৈতিক ফ্রন্টে, ভারত-চীন সম্পর্কের ডিনামিকসকে পরিবর্তন করতে পারে। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, চীন যদিও ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং চীনা প্রযুক্তির ভারতীয় প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে তবুও নয়াদিল্লি তার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারে। ভারত সম্ভবত জাপান, অস্ট্রেলিয়া এবং ভিয়েতনামসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য ‘সমমনা’ দেশের সাথে তার সম্পর্ক আরো জোরদার করবে।
অন্য দিকে চীনের প্রভাবশালী পত্রিকা গ্লোবাল টাইমসে প্রতিবেশী অনেক দেশের সাথে ভারতের সাম্প্রতিক উত্তেজনাপূর্ণ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণ রেখায় পাকিস্তানের সাথে ভারত গুলিবিনিময় করেছে। ভারত-নেপাল সীমান্ত বিরোধও বেড়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি ভারতের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসী এবং এমনকি সাম্প্রতিক দুঃসাহসিক পররাষ্ট্র কৌশলগুলোর একটি অনিবার্য ফলাফল। এই জাতীয় আগ্রাসী মনোভঙ্গি কেবল স্বাধীনতার পর থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করার কৌশলগত লক্ষ্যেই হচ্ছে তা নয়। বরং এটি দেশের ভেতরে জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থান এবং সুবিধাবাদের কারণেও ঘটেছে। দেশটি তীব্রতর চীন-মার্কিন প্রতিযোগিতা থেকে মুনাফা পেতে চায়।
পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়, এই পরিস্থিতিতে, কিছু ভারতীয় এখনো বিশ্বাস করে যে বিদেশে শক্তি দেখিয়ে তারা ঘরোয়া দ্বন্দ্ব এবং জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে ঘনীভূত করতে পারে। তবে ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, অর্থনৈতিক বিকাশ থেকে সরে এসে শূন্য জাতীয়তাবাদ অবশেষে নিজেকে ক্লান্ত করে তোলে। স্থিতিশীল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উভয় দেশের অভিন্ন স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। যদি নয়াদিল্লি কৌশলগত আগ্রাসনের পথে অব্যাহতভাবে যেতে থাকে, তবে এটি চূড়ান্তভাবে তার দীর্ঘমেয়াদি বিকাশকে ক্ষুণœ করবে এবং তার প্রাচীন প্রতিবেশী চীনের সাথে একটি স্থিতিশীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।