চীনের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাত : বেকায়দায় পড়বে ভারত!
চীনের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাত : বেকায়দায় পড়বে ভারত! - ছবি : সংগৃহীত
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪ হাজার ফুট ওপরে চীন ও ভারতের মধ্যকার উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয় ১৫ জুন। সৈন্যরা সৈন্যরা গালওয়ান ভ্যালির ঢালে হাতাহাতি লড়াইয়ে মত্ত হয়, মারা যায় ২০ ভারতীয় সৈন্য, আহত হয় আরো অনেকে। চীনারাও হতাহতের শিকার হয়। চার দশকের মধ্যে এটি ছিল সবচেয়ে প্রাণঘাতী সঙ্ঘাত।
বৃহত্তর কাশ্মির অঞ্চলের অংশ লাদাখের ওপর উভয় দেশেরই দাবি রয়েছে, এখানে ১৯৬২ সালে ৩২ দিনের রক্তাক্ত যুদ্ধ হয়েছিল। ফলে এখানে সাম্প্রতিক যে সঙ্ঘাত হয়েছে, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে পুরো অঞ্চলে। শান্ত থাকার আহ্বান সত্ত্বেও এশিয়ার এই দুই শক্তি পরে যাবে না, বরং উভয় দেশই এখানে তাদের সামরিক শক্তি বাড়িয়ে যাচ্ছে।
গালওয়ান ভ্যালি
গালওয়ান ভ্যালির সঙ্ঘাত হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র এসোসিয়েট ও উপপরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে বলেন, সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য অনুযায়ী, চীনা সৈন্যরা ভারতের দাবি করা এলাকা থেকে প্রত্যাহার হয়নি। এই আঞ্চলিক বিশ্লেষক আরো বলেন, কিভাবে ঘটনার সূত্রপাত, তা স্পষ্ট নয়।... হতে পারে ভারতীয় সৈন্যরা চীনা তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল, তারপর আদিম অস্ত্র দিয়ে মারাত্মক লড়াই শুরু হয়ে যায়।
সৈন্যরা লাঠি, পাথর দিয়ে লড়াইয়ে নামে, ঘুষাঘুষি তো ছিলই। কুগেলম্যান বলেন, সহিংসতায় কয়েকজন সৈন্য মারা যায়, বাকিরা ঠাণ্ডা পানিতে পড়ে প্রাণ হারায়। কোনো ধরনের গুলি বিনিময় না হওয়া সত্ত্বেও এত হতাহত নৃশংস একটি ঘটনা।
প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, উভয় পক্ষ ১৯৯৬ সালের বন্দুক ও বিস্ফোরক ব্যবহার না করার সমঝোতা অনুসরণ করে গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকে।
এক বিবৃতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, আলোচনার জন্য সেখানে অবস্থানরত চীনাদের ওপর ভারতের ফ্রন্ট লাইন সৈন্যরা আক্রমণ করেছিল।
আর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, গালওয়ানে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের ভারতীয় অংশে চীনারা একটি কাঠামো নির্মাণ করতে গেলে লড়াই শুরু হয়।
ভারতের ইকোনমিস্ট পত্রিকার প্রতিরক্ষা সম্পাদক শশাঙ্ক যোশীর বক্তব্য অনুযায়ী, চীনা সৈন্যরা ৬ জুনের সমঝোতা লঙ্ঘন করে গালওয়ান নদীর দক্ষিণ তীরে একটি তাঁবু নির্মাণ করেছিল। চীনারা বলতে থাকে, এটি তাদের অংশ। ভারতের একটি ইউনিট তাঁবুতে আগুন ধরিয়ে দেয়, এরপর চীনা সৈন্যরা বিপুল সংখ্যায় আক্রমণ চালায়।
ব্রিটিশ সাংবাদিক মনে করেন, মূল কারণ ছিল প্রত্যাহার বাস্তবায়ন প্রশ্নে অনৈক্য। গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদক হু জিজিন তার জবাবে বলেন, সংঘর্ষের জন্য ভারতীয় সৈন্যরা দাযী। তারা চীনা সৈন্যদের তাঁবু জ্বালিয়ে দিয়েছিল।
উত্তেজনা আরো বাড়বে?
দুই পক্ষ মে মাসের প্রথম দিক থেকে সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। কুগেলম্যান বলেন, আমরা পরিস্থিতির তীব্রতা দেখছি।
তিনি বলেন, ভারতে জনসাধারণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্রোধের ফলে কোনো না কোনোভাবে প্রতিশোধ নিতে নয়া দিল্লির ওপর চাপ বাড়ছে। তবে ভারত অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী হওয়ায় তারা সামরিক বদলা নেয়ার ঝুঁকি গ্রহণ করবে না।
তিনি বলেন, জাতীয়তাবাদী উত্তেজনা ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো থাকায় এই উত্তেজনা প্রশমিত হতে সময় লাগবে।
ভারতের বৃহত্তম বিরোধীদল কংগ্রেসের প্রচল চাপের মুখে জাতির উদ্দেশে দেয়া বক্তৃতায় তিনি এটিকে বড় ঘটনা হিসেবে নাকচ করে দেন এবং তাদের ভূখণ্ডে কোনো ধরনের চীনা অনুপ্রবেশ ঘটেনি বলে জানান।
কুগেলম্যানের মতো যোশীও মনে করেন, গালওয়ানে চীনারা অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ায় ভারত সামরিকভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের দিকে যাবে না।
তিনি বলেন, নয়া দিল্লি প্রতিশোধ নেবে কূটনৈতিকভাবে। তবে এলএসি বরাবর সমরসজ্জা বাড়বে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা মোশাররফ জাইদি বলেন, গালওয়ান ভ্যালির ঘটনা নয়া দিল্লির জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে।
পাকিস্তান ফ্যাক্টর
কুগেলম্যানের মতে, চীনের প্রধান মিত্র ও ভারতের প্রধান শত্রু এই সমীকরণে ভূমিকা রাখবে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে পাকিস্তান ও ভারত চারটি যুদ্ধ করেছে। ২০১৯ সালেও তারা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছিল। ওই সময় পাকিস্তানের আকাশসীমা লঙ্ঘনের পর ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুটি বিমান ভূপাতিত করে পাকিস্তান।
যোশী বলেন, লাদাখের ওপর ভারতের দাবির প্রতিবাদ করছে পাকিস্তান। এখন এতে চীনও সামিল হলো। তিনি বলেন, সিয়াচেন হিমবাহ দখলের ভারতের প্রয়াসে সহায়তা করেছিল উত্তর লাদাখের সৈন্যরা। এমনকি দৌলত বেগ ওলদির বিমানঘাঁটিও সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল।
ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৮৪ সালে গোপন অভিযান চালিয়ে সিয়াচেন হিমবাহের কয়েকটি চৌকি দখল করে কারাকোরাম পর্বত শৃঙের দিকে অগ্রসর হয়। এর ফলে পাকিস্তান বাধ্য হয় উত্তর কাশ্মিরের কৌশলগত অবস্থঅনে তার সৈন্যদের নিয়ে আসতে।
এখন পূর্ব লাদাখে চীনা সেনাবাহিনীর ভূমিকার কারণে ভারত দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের ঝুঁকিতে রইল।
ইকোনমিস্টের প্রতিরক্ষা সম্পাদক বলেন, ভারত যদি পাকিস্তানের সাথে থঅকা এলওসি এবং চীনের সাথে থাকা এলএসিতে সৈন্য বিভক্ত করে ফেলে তবে পাকিস্তানের জন্য সামরিক চ্যালেঞ্জটি সহজ হয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্র এবং এশিয়ায় চীনা প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকে ঝোঁকে, তবে পাকিস্তানের সাথে চীন তার সম্পর্ক আরো জোরদার করার সুযোগ দেখতে পাবে।
জাইদি অতীতের একটি উদাহরণ টেনে এনে বলেন, ২০ বছর আগে কার্গিলে পাকিস্তানের হাতে একই ধরনের লজ্জায় পড়েছিল ভারত।
আঞ্চলিক কেন্দ্র ও বাণিজ্য
দুই প্রতিবেশী বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলোর অন্যতম হওয়ায় কুগেলম্যান বলেন, এই পরিস্থিতির সবচেয়ে বড় শিকার হবে অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
চীন ও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বিশ্বে অন্যতম বৃহত্তম।
তিনি বলেন, এখন ভারতীয় অর্থনীতি সঙ্কটে থাকায় অর্থনৈতিক সহযোগিতায় সমস্যা হলে ভারতের জন্য খারাপ ফল হতে পারে। তিনি বলেন, ম্যানুফেকচারিং ও টেলিকমের মতো কিছু শিল্পে চীন ব্যাপক ভূমিকা পালন করছে।
কুগেলম্যান বলেন, ভারত এখন তাইওয়ানের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াতে চাইতে পারে। তাছাড়া কোয়াড গ্রুপের সাথেও অংশীদারিত্ব বাড়াতে পারে।
তবে তিনি বলেন, চীনের সাথে বাণিজ্যিক বিরোধে গেলে তা ভারতের জন্যই ক্ষতির কারণ হতে পারে। তিনি বলেন, চীনের সাথে বাণিজ্য করে ভারত বরং লাভবানই হচ্ছিল।
সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যে নিরাপত্তার উদ্বেগের কথা বলে ২৯ জুন নয়া দিল্লি ব্যাপক জনপ্রিয় টিকটক, উইচ্যাটসহ চীনভিত্তিক ৫৯টি মোবাইল ফোন অ্যাপ নিষিদ্ধ করে।
তিনি বলেন, ভারত-চীন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটি একটি বিশেষ মুহূর্ত।ভারত সম্ভবত ভারতে চীনা বিনিয়োগের ব্যাপারেও সতর্ক হবে।
কুগেলম্যান বলেন, এতে করে বেইজিং ভারত সীমান্তে চাপ বাড়াতে পারে, সেইসাথে দক্ষিণ এশিয়া ও ভারত মহাসাগরে তার কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রয়াস জোরদার করতে পারে। জিজিন বলেন, সামরিকভাবে চীনকে হারাতে পারবে না ভারত এবং ভারতের দুর্বল অর্থনীতি চীনের ওপর অবরোধও আরোপ করতে পারবে না।
একইভাবে জাইদি বলেন, এই অঞ্চলে চীনা পদক্ষেপের জবাবে ভারতের হাতে বিকল্প আছে সামান্যই।
এক্সপ্রেস ট্রিবিউন