ভারত-চীন : কৌশল আর দু’টি যুদ্ধ

জয়ন্ত প্রসাদ | Jul 07, 2020 10:11 pm
কৌশল আর দু’টি যুদ্ধ

কৌশল আর দু’টি যুদ্ধ - ছবি : সংগৃহীত

 

১৯৫৯ সালে ভারত-চীন সম্পর্কের নিদারুণ অবনতি ঘটেছিল। তখন ভারত জানতে পারে, তার নিজের ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দু’টি। চীন ও পাকিস্তানের ব্যাপারে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ওয়েইন উইলকক্স এক নিবন্ধে প্রশংসনীয়ভাবে বলেছেন, ভারতকে তার অস্তিত্বের জন্য সব ধরনের ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাবানে গত মে মাসে ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসেজে জোর দিয়ে বলেছেন, ভারতের সেনাবাহিনী যুদ্ধের উভয় ফ্রন্টেই সজাগ রয়েছে।

কৌশল আর দু’টি যুদ্ধ
যখনই ভারত ভুলে গেছে যে, তার দু’টি প্রতিপক্ষ আছে এবং এই ভুলে যাওয়ার কারণে তার পাহারা ঢিলে করে দিয়েছে, তখনই ভারতকে দিতে হয়েছে বিরাট মাশুল। এর বিপরীতে, যখনই ভারত উভয় প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সম্ভাব্য হুমকির যথাযথ গুরুত্ব দিয়েছে, তখনই ভাল করেছে। এরই সুস্পষ্ট নজির হলো, ১৯৬২ ও ’৭১ সালের যুদ্ধ।

১৯৬২ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু আর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি কে কৃষ্ণমেনন উভয়েই বিশ্বাস করতেন, ‘ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি প্রধানত আসে পাকিস্তানের কাছ থেকে।’ ১৯৭১ সালে, তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে চীনের সম্ভাব্য পদক্ষেপ গ্রহণ করাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই ভারত তখন ‘শান্তি, মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি’র আকারে একপ্রকার ‘বীমার নীতি’ গ্রহণ করেছিল। চুক্তিটি হয়েছিল ভারত সরকার এবং ইউনিয়ন অব সোভিয়েট সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস সরকারের মধ্যে।

আগের ভুল থেকে আজকে শিক্ষা নিতে হবে। চোখ-মুখ বুজে মনে করা হয়, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে হুমকি বিদ্যমান। একই সাথে, কিছুটা নিশ্চিত থাকা হয় যে, চীন তেমন কিছু করবে না। এর কারণ অংশত হলো, দেসাং, চুমার ও দোকলামে দু’দেশের মুখোমুখি অবস্থান থেকে সৃষ্ট উত্তেজনার নিরসন হয়ে গেছে। চীনের উহানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং (এপ্রিল, ২০১৮) এবং পরে তালিমনাড়–র মামাল্লাপুরামে (অক্টোবর, ২০১৯) এ দু’নেতার আলোচনার ঘটনা তাদের আরো ‘অন্ধ’ করে ফেলেছিল যারা নয়াদিল্লিতে বৈদেশিক ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত নীতির পরিকল্পনা তৈরি করার কাজে জড়িত।

১৯৬২-এর শিক্ষা
১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ পর্যন্ত দু’দেশের আন্তঃযোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারত বিনিময় ব্যতীত বন্ধুভাবাপন্নতা এবং শক্তি ব্যতীত দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক খারাপ হচ্ছিল। তবুও নেহরু বা কৃষ্ণমেনন কেউই ভাবেননি, এ দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।

সমকালীন পর্যবেক্ষকদের একজন হলেন রাজ থাপার। ‘সেমিনার’ নামক জার্নালটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, কৃষ্ণমেনন কাশ্মির ফ্রন্ট থেকে একটি মাত্র ভারতীয় সৈন্যকেও সরিয়ে আনার ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। মেননের দৃঢ়বিশ্বাস ছিল, সুযোগ পেলেই পাকিস্তান ভারতের ওপর হামলা করবে। কৃষ্ণমেননের অপরিবর্তনীয় বিশ্বাস ছিল, চীন নয়Ñ বরং পাকিস্তানই ভারতের জন্য হুমকি। তার এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে যাতে অন্যরাও একমত হন, এ জন্য তিনি যতটা সম্ভব, করতে প্রস্তুত ছিলেন।

কৃষ্ণমেনন পাকিস্তানে সে সময় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার রাজেশ্বর দয়ালকে বললেন, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে এক দল ভারতীয় সিনিয়র আর্মি অফিসারকে যেন তিনি ব্রিফ করেন। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণমেননের বৃহত্তর পরিকল্পনার অংশ হচ্ছে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বিপদের কথা তুলে ধরাÑ এই হুঁশিয়ারি পেয়ে রাষ্ট্রদূত দয়াল সংশ্লিষ্ট সভায় জানান, পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রস্তুতির ব্যাপারে কোনো কিছুই তিনি বের করতে পারেননি। সাক্ষ্যপ্রমাণে জানা যায়, এটা শুনে মেনন দৃশ্যত হয়েছিলেন বিরক্ত।

প্রধানমন্ত্রী নেহরুও এই মত পোষণ করতেন যে, ভারতের জন্য চীনের চেয়ে বড় হুমকি পাকিস্তান। তিনি ও কৃষ্ণমেনন উভয়ে নিজ নিজ দৃষ্টিভঙ্গিকে এ ক্ষেত্রে জোরদার করে তোলেন। ’৬২ সালের যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই নেহরু পার্লামেন্টে স্বীকার করেছিলেন, ‘পাকিস্তানের বিপরীতে আমাদের দুর্ভাগ্যজনক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে ভারতের প্রতিরক্ষা কার্যক্রম গড়ে উঠেছে।’ তদানীন্তন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সাথে নিজের সুস্পর্কও তাকে করেছিল বিভ্রান্ত। এ ক্ষেত্রে নেহরু ভুলে গিয়েছিলেন, নেতাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কদাচিৎ তাদের দেশের নিরাপত্তা স্বার্থের ব্যাপারে পূর্বাভাস দিয়ে থাকে।
১৯৬২ সালে ভারত আত্মসন্তুষ্টি ও ভুল বিবেচনার শিকার হয়েছিল। এর কারণ এটা ছিল না যে, চীনের পক্ষ থেকে হামলার ব্যাপারে কোনো হুঁশিয়ারি পাওয়া যায়নি। ভারতের নেতারা স্থির নিশ্চিত ছিলেন যে, চীনারা ভারতকে আক্রমণ করবে না। আসলে প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুই প্রতিরক্ষামন্ত্রী কৃষ্ণমেনন এবং ভারতের সেনাবাহিনী প্রধানকে বলেছিলেন, ‘আমার কাছে এ মর্মে নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে যে, ভারত শক্তি প্রদর্শন করলেও চীনা বাহিনী প্রতিরোধ
করবে না।’ তদুপরি, ’৬২ সালের যুদ্ধের আগের বছর কৃষ্ণমেনন এটা ক্রমাগত অস্বীকার করেন যে, চীনের সাথে ভারতের কোনো সমস্যা আছে। তার কথা ছিল, ‘ভারত সরকার ভারতীয় ভূখণ্ড বলে মনে করেÑ এমন কোনো জায়গা চীন দখল করে রাখেনি।’ আগ্রাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অফিসারদের উদ্দেশে বক্তৃতাকালে মেনন ঘোষণা দেন, ‘ভারতের ভূখণ্ডের কোনো অংশে চীনাদের কোনো আগ্রাসন, হামলা, দখল কিংবা অনুপ্রবেশ সম্পর্কে আমার জানা নেই।’

পূর্ণ আগ্রাসন
১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ভারত-চীন সীমান্তজুড়ে একই সময়ে হামলা চালায়। এতে বোঝা যায়, তারা আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছে বহু দিন ধরে। লাদাখের গালওয়ান উপত্যকা থেকে দৌলত বেগ ওলদির উত্তর পর্যন্ত, ভারতের ১৩টি সম্মুখসারির ফাঁড়িতে চীনা বাহিনীর হামলা ঘটেছিল। একই সাথে, চীন পূর্ব সেক্টরে ভারতীয় বাহিনীর ওপর হামলা চালায় নামকা চু নদী বরাবর এবং খিনজেমানেতে। এভাবে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত অঞ্চল (ঘঊঋঅ বা অরুণাচল)-এর সীমান্তবর্তী পাঁচ ডিভিশনের চারটিতেই চীন হামলা চালিয়েছিল। আক্রান্ত এই চারটি ডিভিশন হলো কামেং, সুবানসিরি, সিয়াং ও লোহিত।

তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর জীবনীতে লেখক প্রফেসর সর্বপল্লী গোপাল উল্লেখ করেছেন, ১৯৬১ সালের নভেম্বরে ভারত-চীন সীমান্তের ব্যবস্থাপনার জন্য নেহরু নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি তা করেছিলেন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে। গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন ‘সীমান্তে যেখানে ভারতের কেউ নেই, সেখানে চীনারা অগ্রসর হবে এবং সীমান্তের যেখানে ভারতের লোকজন কায়েম রয়েছে, চীনারা সে জায়গা থেকে সরে থাকবে।’ এ অবস্থায় মনে করা হয়েছিল, একটি মাত্র অবস্থানেও ভারতের বিরুদ্ধে চীন তৎপর হওয়ার কথা থাকলেও তারা ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো কিছুই করবে না। প্রফেসর গোপাল আরো মনে করেন, ভারতের একজন জেনারেলের হুঁশিয়ারির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নেহরু সম্ভবত ছিলেন বেখবর। সেনাবাহিনীর এই জেনারেল বলে দিয়েছিলেন ‘ভারত-চীন সীমান্তের কোথাও হামলা সহ্য করার ক্ষমতা ভারতের নেই।’

আধিপত্যের লক্ষ্যে চৈনিক অভিযাত্রা
ভারত কেন চীনের আগ্রাসনের টার্গেট হয়েছিল, তা নিজেরা স্মরণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। নেহরু ১৯৬৪ সালে মৃত্যুবরণ করার মাত্র ৯ দিন আগে সম্প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘চীন এশিয়াকে প্রধানত এ কথা বুঝাতে ভারত সীমান্তে হামলা করেছিল যে, আমরাই এশিয়ার প্রভু এবং এ মহাদেশের যেকোনো ব্যক্তি বা দেশ তা যেন মনে রাখে।’ এর কয়েক মাস আগে নেহরু তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন ফিটজেরাল্ড কেনেডিকে লিখেছিলেন, চীন নেতৃত্ব দখল করতে তৎপর কেবল এশিয়ার জন্য নয়; ‘বিশ্বনেতৃত্ব অর্জনের পথে তাদের সর্বপ্রথম পদক্ষেপ হিসেবে।’ চীনের লক্ষ্য ভারতের ভূখণ্ড দখল করাই নয়, প্রকৃত উদ্দেশ্য হলোÑ ‘ভারতের ওপর রাজনৈতিক সমাধান চাপিয়ে দেয়া যাতে ভারত চীনের বিশ্বনীতির সাথে খাপ খাইয়ে নিজের নীতিগুলোকে পুনর্বিন্যাস করে নেয়।’

যদিও এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, ভারত আজো দু’ফ্রন্টে ধাঁধার মোকাবেলা করে চলেছে। বর্তমানে বিরাজমান সঙ্কটের ব্যাপারে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। ইতোমধ্যে ভারতের অবশ্যই উচিত নিজের করণীয় কাজগুলোর ভারসাম্যপূর্ণ মূল্যায়ন। চীনের মতিগতির ওপর নজরদারির পাশাপাশি, চীনের বিরুদ্ধে আকস্মিক ও প্রচণ্ড হামলা চালিয়ে অতীত ভ্রান্তির প্রতিকারের প্রলোভনকে প্রতিরোধ করতে হবেই। এ জন্য প্রয়োজন ধৈর্য ও অধ্যবসায়সহকারে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।

[ভারতের ঞযব ঐরহফঁ.পড়স এর সৌজন্যে]
লেখক : ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসেজের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বপালনকারী সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক।

ভাষান্তর- মীযানুল করীম


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us