ফাইভ আইজ কি ভারতকে নেবে?
ফাইভ আইজ - ছবি : সংগৃহীত
ভারতের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা টাইমস অব ইন্ডিয়া সম্প্রতি একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যেখানে তথা-কথিত চীনা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য ভারতকে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
নিবন্ধে দাবি করা হয়েছে যে, “এই সঙ্ঘাতের থিয়েটারকে আরো প্রশস্ত করা ছাড়া ভারতের সামনে আর কোনো উপায় নেই”। এতে আরো বলা হয়েছে যে, ভারতের উচিত ‘ফাইভ আইজ নেটওয়ার্কে’ যোগ দেয়া কারণ চীনের ব্যাপারে ‘গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় করাটা এখন অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ'।
ফাইভ আইজ হলো অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে গঠিত গোয়েন্দা জোট।
সাম্প্রতিককালে ভারতীয় মিডিয়া এবং সেখানকার কৌশলগত বলয়ে এ ধরনের মতামত খুবই নিয়মিত হয়ে উঠেছে। এতে চীনের বিরুদ্ধে ভারতীয় কট্টরপন্থীদের মনোভাব উঠে এসেছে যারা বাইরের শক্তির সাহায্য নিয়ে চীনকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই ব্যক্তিরা বর্তমান ভারত-চীন সীমান্ত বিবাদের বিষয়টিকে ব্যবহার করে তাদের ইস্যুগুলোর ব্যাপারে উত্তেজনা তৈরি করছে।
কিন্তু ভারত সরকার তাদের মতামত গ্রহণ করবে কি না, এটা স্পষ্ট নয়। বিগত দিনের ভারতের পররাষ্ট্র নীতির দিকে তাকালে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্র নীতির দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, নয়াদিল্লী ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। কিন্তু ভারত কখনো ওয়াশিংটনের দিকে পুরোপুরি ঝুঁকে ছিল না। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মতো পরাশক্তিগুলোর মধ্যে ভারত সবসময় একটা ভারসাম্য বজায় রেখে এসেছে।
ভারত যদি সত্যিই ফাইভ আইজ গোয়েন্দা জোটের সাথে যুক্ত হয়, তাহলে সেটা ভারতের স্বার্থের জন্য ভালো হবে না। নয়াদিল্লি একটা প্রধান বিশ্বশক্তি হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু জোটের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ছোট ভাইয়ের ভূমিকা পালন করাটা ভারতের কাম্য নয়। সে কারণে এই প্রস্তাব এবং এই ধরনের অন্যান্য প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে ভারতের মধ্যেই অনেকে বিরোধিতা করবেন, যারা এগুলোকে স্বাধীনতা ও স্বায়ত্তশাসনে ছাড় দেয়ার সমতুল্য মনে করে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারতকে এ ধরনের চীন-বিরোধী জোটে গ্রহণও করে, তাতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে ভারতের কোন উপকার হবে না, কারণ চীন এ সংক্রান্ত নীতিগুলো সংশোধন করে নেবে।
তাছাড়া, রাশিয়ার সাথেও ভারতের বর্তমান সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ। ভারত যদি ফাইভ আইজ জোটে যোগ দেয়, তাহলে এটা প্রকাশ্যেই ঘোষণা দেয়া হবে যে, চীন-ভারত সম্পর্ক শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। এর আরেকটি অর্থ হলো রাশিয়া আর ভারতের মধ্যে ‘বিশেষ ও সুবিধাপ্রাপ্ত কৌশলগত অংশীদারিত্বের’ অবসান ঘটেছে। মোদি প্রশাসনের জন্য এটা করাটা কঠিন হবে, এবং ভারতের জাতীয় স্বার্থের জন্যও সেটা অনুকূল হবে না।
কিন্তু ভারত সরকার যদি জোটে যোগ দিতেও চায়, এই সম্ভাবনা খুবই কম যে ফাইভ আইজ জোট তাকে গ্রহণ করবে। এই জোটের উৎস হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময় যখন মিত্র দেশগুলো আটলান্টিক চার্টার গ্রহণ করেছিল। ফাইভ আইজের সদস্য দেশগুলো কঠোরভাবে অ্যাংলো-স্যাক্সন ঐতিহ্যের দেশগুলোর মধ্যে সীমিত। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মিত্র দেশগুলোরই এমনকি এই জোটে যোগ দেয়ার অধিকার নেই।
ভারতের জনগণ অ্যাংলো-স্যাক্সনদের বংশধর নয়, বা আমেরিকার মিত্রদেরও বংশধর নয়। জোটের অন্যান্য দেশগুলোর সাথেও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা চুক্তি নেই তাদের। ভারত আর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট থেকে দেখলে, তাদের সম্পর্কটা আসলে একটা খেলার মতো, যেখানে দুই দেশ একে অন্যকে ব্যবহার করে থাকে। আসলে বাণিজ্য আর আদর্শের ক্ষেত্রে দুই দেশের মধ্যে মারাত্মক মতপার্থক্য আছে। বিশেষ করে মোদির ধর্ম নীতির ব্যাপারে ওয়াশিংটনের সমালোচনা দিন দিন বেড়েই চলেছে, এবং দুই দেশই পরস্পরের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন ভারতের পক্ষে ফাইভ আইজ জোটে যোগ দেয়ার চিন্তা করাটা কঠিন। এই প্রস্তাবটি সম্ভবত কিছু ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনৈতিক ভাষ্যকারের দিবাস্বপ্ন মাত্র।
সূত্র : এসএএম