অহঙ্কার কেন পরিহার করবেন?
মসজিদের মিনার - ছবি : সংগৃহীত
অন্তরে অহঙ্কার বা আত্মপ্রশংসার বীজ বপন সব উত্তম কাজের বীজ মূলোৎপাটন করে দেয়। অহঙ্কারের কারণে সব ভালো আমল নষ্ট হয়ে যায়। আত্মপ্রশংসা বা আত্মগর্ব তাকওয়া বা খোদাভীতির পরিপন্থী।
অহঙ্কার জাগ্রত হওয়া শেষ পর্যন্ত ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বয়ে আনে না। বরং যারা নিজেদের আত্মা শুদ্ধ করেছে তারাই সফলকাম হয়েছে। আল্লাহ্ বলেন, ‘অবশ্যই তারাই সাফল্য লাভ করবে যারা আত্মশুদ্ধি করবে।’(সূরা আল-আ’লা : ১৪) আত্মোপলব্ধি বা আত্মার শুদ্ধতা তখনই সম্ভব যখন কেউ আত্ম অহঙ্কারে পর্যবসিত হয়ে নিজের ক্ষতি বা অন্যের ক্ষতি সাধন না করে। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আত্মপ্রশংসার কারণ হয়ে থাকে অহমিকা বা আত্মগর্ব। রাসূল সা: বলেছেন, তোমরা পরস্পর প্রশংসা করা থেকে বেঁচে থাকো। কেননা, তা হচ্ছে নিজেকে জবাই করা। (ইবন মাজাহ ্ :৩৭৪৩) এখানে তিনি নিজের প্রশংসা শুনতে অপরের সরাসরি প্রশংসা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, প্রশংসার পরে আত্ম অহমিকা চলে আসে, যা একজন মানুষকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়।
আল-হামীদু বা প্রশংসিত একমাত্র তাঁর নাম যিনি এ বিশ্বজাহানের মালিক। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘ইজ্জত তাঁর লুঙ্গি ও অহঙ্কার তাঁর চাদর, অতএব যে আমার সাথে (আমার চাদর নিয়ে) টানাহেঁচড়া করবে আমি তাকে শাস্তি দেবো।’ (সহিহ হাদিসে কুদসি-১৪০) এখানে আল্লাহ্ নিজেই বলেছেন, অহঙ্কার হচ্ছে আল্লাহর চাদর বা আবরণ, যা অন্য কারো জন্য জায়েজ নয়। বরং এটা ধারণ করা তাকওয়ার পরিপন্থী।
রাসূল সা: বলেন, আমি কি তোমাদের জাহান্নামি লোকদের পরিচয় বলব না? যারা রূঢ় স্বভাব, অধিক মোটা এবং অহঙ্কারী তারাই জাহান্নামি। (সহিহ বুখারি-৪৯১৮) অর্থাৎ অহঙ্কারী ব্যক্তিরা জাহান্নামীদের দলভুক্ত। তিনি আরো বলেন, যার অন্তরে অণু পরিমাণ অহঙ্কার বা গর্ব জায়গা নেবে সে জান্নাতে যেতে পারবে না। অথচ আমরা নিজেদের মাঝে অহর্নিশ আত্মপ্রশংসা নিয়ে গর্বিত হয়ে থাকি। নিজেদের আমলগুলো ভার্চুয়াল জগতে এবং সমাজে শো-অফ করে থাকি, যা অনেক সময় ছোট শিরকের পর্যায়ে পড়ে।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, আমি তোমাদের ওপর যা ভয় করি তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছে শিরকে আসগর (ছোট শিরক)। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল সা: শিরকে আসগর কী? তিনি বললেন, রিয়া (লোক দেখানো আমল), আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তাদের (রিয়াকারীদের) বলবেন, যখন মানুষকে তাদের আমলের বিনিময় দেয়া হবে, তোমরা তাদের কাছে যাও যাদের তোমরা দুনিয়াতে দেখাতে, দেখো তাদের কাছে কোনো প্রতিদান পাও কিনা। (সহিহ হাদিসে কুদসি, হাদিস নং ৭) লোক দেখানো আমল এক ধরনের অহঙ্কার, যা ব্যক্তি তার আমলের কারণে করে থাকে এবং অন্যের কাছে প্রশংসা কুড়ায়। এ অহঙ্কার সবচেয়ে ভয়াবহ পর্যায়ের যা শিরক। আর সব গুনাহ্ মাফ করলেও শিরকের গুনাহ্ মাফ করা হবে না।
অহঙ্কার ও নিজকে বড় মনে করার মূল কারণ পরকালে অবিশ্বাস ও পার্থিব বিলাস-সামগ্রীর আতিশয্যে মত্ত থাকা। যা ফেরাউনের দল-বল করেছে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘কিন্তু তারা (ফিরাউন ও তার পারিষদবর্গ) অহঙ্কার করল এবং তারা ছিল উদ্ধত কওম।’ (২৩:৪৬)
মূলত আত্মপ্রশংসা এবং নিজেকে ত্রুটিমুক্ত মনে করা বৈধ নয়। ইহুদিরা নিজেদের পবিত্র বলে বর্ণনা করত। তারই পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন, ‘আপনি কি তাদের দেখেননি, যারা নিজেদের পবিত্র মনে করে? বরং আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে পবিত্র করেন। আর তাদের ওপর সুতা পরিমাণ ও জুলুম করা হবে না।’ (সূরা আন-নিসা : ৪৯)
এতে প্রতীয়মান হয় যে, কারো পক্ষে নিজের কিংবা অন্য কারো পবিত্রতা বর্ণনা করা জায়েজ নয়। এই নিষিদ্ধতার কয়েকটি কারণ রয়েছে- এখানে ইহুদিদের বলা হয়েছে, তারা নিজেদের প্রশংসায় কোনো প্রকার কসুর করত না। তারা নিজেদের আল্লাহর সন্তান-সন্ততি ও তাঁর প্রিয়পাত্র বলে দাবি করত। (তাবারি)
দ্বিতীয়ত, শেষ পরিণতি সম্পর্কে শুধু আল্লাহই অবগত যে, তা পবিত্রতা কিংবা পরহেজগারীর মধ্যেই হবে কিনা। কাজেই নিজে নিজেকে পবিত্র বলে আখ্যায়িত করা তাকওয়ার পরিপন্থী। আল্লাহ্ বলেছেন, ‘যারা নিজদের সালাতে বিনয়াবনত।’ (সূরা আল-মুমিনুন : ০২)।
নিষিদ্ধতার আরো এক কারণ এই যে, অধিকাংশ সময় এ ধরনের দাবি করতে গিয়ে মানুষের মনে এমন ধারণা সৃষ্টি হতে থাকে যে, সে লোক আল্লাহ্ তায়ালার দরবারে এজন্য প্রিয় যে, সে যাবতীয় দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত। অথচ কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা।
নিষিদ্ধতার আরেক কারণ হলো, মানুষ জানে না তার কৃত আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হচ্ছে কিনা। কেননা, আয়েশা রা: বলেন, ‘আর যারা তাদেরকে যা দেয়া হয়েছে তা দেয় এমতাবস্থায় যে, তাদের অন্তর ভীতসন্ত্রস্ত এ জন্য যে তারা তাদের রবের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে।’ (সূরা আল-মুমিনুন : ৬০) এ আয়াত নাজিল হলো, আমি রাসূল সা:কে জিজ্ঞেস করলাম তারা কি ওই সম্প্রদায় যারা মদ খায় এবং চুরি করে? তিনি বললেন, না, হে সিদ্দিকের মেয়ে! তারা হলো ওই সব ব্যক্তি যারা সালাত-সাওম আদায় করে এবং ভয় করে যে তাদের কাছ থেকে এটি কবুল করা হবে কিনা।’ (তিরমিজি : ৩১৭৫) আবদুল্লাহ বিন মাসউদ রহ: বলেন, সেদিন আমি অত্যন্ত লজ্জিত হয়েছি, যেদিনের সূর্য ডুবে গেছে। আমার আয়ু কিছুটা হলেও ফুরিয়ে গেছে; অথচ আমার আমলের কোনো উন্নত হয়নি।’ সালাফারা তাদের আমল কবুলের আতঙ্কে সারাদিন এক হাজার রাকাত নফল নামাজ আদায় করেও এমন ভাবতেন যে, তাদের আমল কবুল হবে কিনা। তাদের আমলের কারণে আত্ম অহঙ্কার করার কোনো লেশ মাত্রও ছিল না।
অহঙ্কারী ব্যক্তির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কঠিন শাস্তির ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ‘আর যারা হেয় জ্ঞান করেছে এবং অহঙ্কার করেছে, তিনি তাদের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দেবেন এবং তারা তাদের জন্য আল্লাহ ছাড়া কোনো অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাবে না।’ (৪:১৭৩) আর আল্লাহকে ইবাদাতে অস্বীকৃতি জানানোর শাস্তি চিরস্থায়ী লাঞ্ছনা। তাঁকে সিজদাহ্ করতে কৃপণতাও অহঙ্কারের অন্তর্ভুক্ত। ‘নিশ্চয় যারা আল্লাহর ইবাদতে অস্বীকার ও অহঙ্কার প্রদর্শন করে, তারা অচিরে লাঞ্ছিত অবস্থায় জাহান্নামে প্রবেশ করবে।’ (সূরা গাফির ৪০:৬০)
রাসূল সা: বলেছেন, তিনটি কাজ মানুষকে রক্ষা করে এবং তিনটি কাজ মানুষকে ধ্বংস করে। রক্ষাকারী কাজ তিনটি হচ্ছেÑ ১. প্রকাশ্যে ও গোপনে আল্লাহকে ভয় করা ২. সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টিতে হক কথা বলা এবং ৩. সচ্ছলতায় ও অসচ্ছলতায় মধ্যম পন্থা অবলম্বন করা। আর ধ্বংসকারী কাজ তিনটি হচ্ছেÑ ১. প্রবৃত্তির অনুসরণ করা ২. কৃপণতাকে মেনে নেয়া এবং ৩ আত্ম-অহঙ্কার করা। আর এটিই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন। (বায়হাকি, মিশকাত হা/৫১২২, সনদ হাসান)
আত্ম-অহঙ্কার বা আত্মপ্রশংসার ফলে মানুষের দুটি দিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমত, আধ্যাত্মিক ক্ষতি- অন্তর এবং পরকালের ক্ষতির মাধ্যমে আধ্যাত্মিকভাবে মানুষ ধ্বংসের দিকে যায়। দ্বিতীয়ত, পার্থিব ক্ষতি- সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাহীন ক্ষতি পরিলিক্ষত হয়। কারণ, আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারি যে, অন্যান্য ব্যক্তি যখন অহঙ্কারপূর্ণ কথাবার্তা বলে বা চলাফেরা করে তখন আশপাশের সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ দিক থেকে বিবেচনা করলে, আমরা আত্ম-অহঙ্কার থেকে নিজেদের বিরত রাখতে সক্ষম হবো। আর আল্লাহর ভীতি বা তাকওয়া অবলম্বন করতে পারব।
লেখিকা : কবি, সাহিত্যিক ও ইসলামী গবেষক