ওয়েব সিরিজের নামে কী চলছে
ওয়েব সিরিজ - ছবি : সংগৃহীত
আমাদের একটি নিজস্ব সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধ আছে। এটা অনেকে মানতে নারাজ। বিশ্বের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হলে নাকি পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুকরণ করতে হবে। পৃথিবীর যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ সর্বাধিক ধর্মপ্রাণ। এ দেশের নাগরিকদের অন্তরে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ বিদ্যমান। যে দেশের রাজধানী শহরকে মসজিদের শহর বলা হয়, যে দেশের মানুষ আজানের শব্দ শোনে জমির আইলে দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করে, সে দেশে ওয়েব সিরিজের নামে নগ্নতা, অশ্লীলতা চলতে পারে না। করোনায় নিষ্ঠুরতায় ক্ষতবিক্ষত বিশ্বময়, সেখানে ওয়েব সিরিজের নোংরামি সাধারণ মানুষের উদ্বেগকে আরো এক ধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। যুবসমাজের চরিত্র ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে ওয়েব সিরিজ। অনলাইলে এবং অনলাইন টেলিভিশনে সম্প্রচারের জন্য যে ধারাবাহিক ভিডিও নির্মাণ করা হয় সাধারণ অর্থে সেটাকেই ওয়েব সিরিজ বলা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনেক আগ থেকেই ওয়েব সিরিজের প্রচলন থাকলেও বাংলাদেশে ২০১৭ সালে এর যাত্রা শুরু। সম্প্রতি তিনটি ওয়েব সিরিজের নগ্নতা, অশ্লীল দৃশ্য এবং সংলাপ ফলাও করে প্রচার হওয়ায় সর্বত্র নিন্দার ঝড় বইছে।
আমাদের পোশাক, আমাদের ভাষা, আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের চলাফেরা সবকিছুই প্রমাণ করে, আমরা প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলাম না। কিন্তু আমরা ধার্মিক ছিলাম। আমরা নষ্ট ব্যভিচারী জাতি ছিলাম না। কিন্তু এখন এক শ্রেণীর নির্মাতা আমাদের নষ্ট জাতিতে পরিণত করতেই তথাকথিত ওয়েব সিরিজের যৌনতার বিকাশ ছড়িয়ে দিয়েছে। অশ্লীল ও আপত্তিকর দৃশ্যের জন্য ওয়াহিদ তারিকের বুমেরাং, সুমন আনোয়ারের সদরঘাটের টাইগার ও শিহাব শাহীনের আগস্ট ১৪Ñ এই তিনটি সিরিজ মুক্তির পরপরই অশ্লীলতার দায়ে বিতর্কিত হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অশ্লীলতার দায়ে যেমন সিনেমা ডুবেছে এবার টেলিভিশনের নাটকও ডুববে। টেলিভিশনে নিজস্ব সংস্কৃতি বজায় রেখে অভিনয় করা একশ্রেণীর অভিনয়শিল্পীকে ওয়েব সিরিজে অশালীন দৃশ্যে অভিনয় করতে দেখা গেছে। ওইসব সিরিজে অভিনয় করেছেন শহীদুজ্জাম সেলিম, আজাদ আবুল কালাম, মৌটুসী বিশ্বাস, শ্যামল মওলা, হিল্লোল, ইমি অর্ষা, ফারহানা হামিদ, আবু হুরায়রা, শতাব্দী ওয়াদুদ, তাসনুভা তিশা, মনিরা মিঠু, শাওন, তানুভীর প্রমুখ। ১৪ আগস্ট সিরিজের গল্পে তুশির বন্ধুদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক, বাসায় একা নীল সিনেমা দেখার উত্তেজনাসহ কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য রয়েছে। এ চরিত্রে অভিনয় করেছেন তাসনুভা তিশা।
বুমেরাং সিরিজে হিল্লেøাল ও অর্ষার বিছানায় যৌন-উত্তেজক বিতর্কিত দৃশ্য রয়েছে। সদরঘাটের টাইগার সিরিজে শ্যামল মাওলা ও ফারহানা হামিদ অভিনয় করেন। এ সিরিজের বেশির ভাগ সংলাপে একাধিকবার অশালীন শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিটি ওয়েব সিরিজ যৌনতায় ভরা। কাহিনী নয়, যৌনতাকে পুঁজি করেই সিরিজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ একশ্রেণীর নির্মাতা সাফাই গেয়ে বলেছেন, এটা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে। আমার প্রশ্ন, ওইসব নির্মাতাদের কাছে নষ্ট নোংরা অশ্লীল ইতিহাস জাতির কী প্রয়োজন মেটাবে? যৌনতা জীবনেরই অংশ। কিন্তু তা প্রকাশ্যে চর্চার বিষয় নয়। নাটক সিনেমায় কাহিনীর প্রয়োজনে যৌনতার কোনো প্রয়োজন নেই। মা তার সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন। কাহিনীর দোহাই দিয়ে এমন দৃশ্য দেখানোর মানে কী? নিশ্চয় একটা কুমতলব আছে? এরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ পেতে হলে আমাদের উচিত সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে ফিরিয়ে আনা। আর এ কাজটি করতে পারে রাষ্ট্র।
আজ আমরা ঘরে-বাইরে ভয়ঙ্কর এক ষড়যন্ত্রের শিকার। অথচ আমরা মুক্তির পথ খুঁজছি না। আমরা নীতিবাক্য বলছি। কিন্তু লুকিয়ে থাকা অসভ্যতাকে দূরীভূত করতে পারছি না। যুবসমাজকে বলছি আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। অথচ যুবসমাজের চরিত্র ধ্বংসের সব মাধ্যমকে উন্মুক্ত করে দিচ্ছি। যারা ওয়েব সিরিজের নির্মাতা তাদের বিনয়ের সাথে বলব, আপনারা ওয়েব সিরিজের নামে কী বানাচ্ছেন? তা কি একবার ভেবে দেখেছেন। রাতে ঘুমানোর সময় চোখটা দুই মিনিট বন্ধ করে একটু চিন্তা করুন তো? আপনারা যা নির্মাণ করছেন তা কি সভ্যসমাজে মানায়। আপনারা তো পারতেন বিপথগামী রাতজাগা তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করার প্রয়াসে সততা, নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত হয় এমন সিরিজ তৈরি করতে? এমনিতে দেশব্যাপী সক্রিয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। তারা এসব যৌনতানির্ভর ওয়েব সিরিজ দেখে যৌন হয়রানি ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে না তার গ্যারান্টি কী? যতই এইটটিন প্লাস লেখা থাকুক না কেন, খোলামেলা যৌনতার আকর্ষণে তারা ওয়েব সিরিজে আসক্ত হবে। নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশি।
যেসব সার্ভিস প্রোভাইডার এ ধরনের ওয়েব সিরিজ প্রচার করার সুযোগ করে দিয়েছে, তাদের আদৌ কোনো লাইসেন্স আছে কি না তা রাষ্ট্রের খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবি নিজেদের প্লাটফর্ম এবং নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ওয়েব সিরিজের নামে সেন্সরবিহীন কুরুচিপূর্ণ ভিডিও কনটেন্ট ওয়েবে আপলোড ও প্রচার করায় সরকার কোম্পানি দুটির কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে। একশ্রেণীর নির্মাতা বলছেন, গল্পের প্রয়োজনেই এমন দৃশ্য ও সংলাপের ব্যবহার। এমন বাস্তবতায় ওয়েব সিরিজে প্রদর্শিত অশ্লীল ও আপত্তিকর দৃশ্য বাদ দেয়ার আহ্বান জানিয়ে সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো: তানভীর আহমেদ। বাংলাদেশে ২০১২ সালের প্রণীত এ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী এ ধরনের অশ্লীলতা প্রচারের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর কারাদণ্ডের বিধান আছে। অথচ প্রয়োগ নেই বলেই অশ্লীলতার রাশ টেনে ধরা যাচ্ছে না। ওয়েব সিরিজে যারা অশ্লীল অভিনয় করেছেন, তাদের বাবা-মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়ে কিংবা বন্ধু শুভাকাক্সক্ষী কি নেই? এরকম অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করে কিভাবে তাদের সামনে দাঁড়িয়েছেন? পশুর তো লজ্জা আছে। বিবেক কি একটুও নাড়া দেয়নি।