হাজরে আসওয়াদ : জান্নাতি পাথর
হাজরে আসওয়াদ - ছবি : সংগৃহীত
হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর একটি নাম, একটি ইতিহাস। বিশ্ব মুসলিম নর-নারীর কাছে অতি মূল্যবান এ পাথরটি হজ ও ওমরাহ আদায় করার সময় স্পর্শ ও চুম্বন করা সুন্নাত। মহানবী সা:-এর সুন্নাতের অনুসরণে সাহাবিরাসহ অদ্যাবধি সব হজ ও ওমরাহ আদায়কারী তা স্পর্শ ও চুম্বন করেছেন বা চেষ্টা করেছেন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে হাজরে আসওয়াদ
হাজরে আসওয়াদ একটি প্রাগৈতিহাসিক ইসলামী নিদর্শন এবং জান্নাতের একটি মূল্যবান পাথর। হজরত আদম আ: জান্নাতে থাকাকালীন এই সুন্দর ও মনোহর পাথরটিকে খুবই পছন্দ করতেন। মহান আল্লাহর নির্দেশক্রমে হজরত আদম আ: পৃথিবীতে অবতরণকালে সেই পছন্দনীয় পাথরটি দুনিয়াতে নিয়ে আসেন। হজরত নূহ আ:-এর ভয়াবহ বন্যার সময় হজরত জিব্রাইল আ: পাথরটি আবু কুবাইস পাহাড়ে সংরক্ষণ করে রাখেন। হজরত ইব্রাহিম আ: কাবাঘর নির্মাণ করলে তাওয়াফ করার স্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে হজরত ইসমাইল আ: একটি পাথর তালাশ করার সময় জিব্রাইল আ: ওই পাথরটি এনে দেন। অতঃপর হজরত ইব্রাহিম আ: তা বাইতুল্লাহর এক কোণে স্থাপন করেন।
মহানবী সা:-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পাঁচ বছর আগে কাবাঘর সংস্কার সাধনের পর হাজরে আসওয়াদ স্থাপন নিয়ে জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়। মহানবী সা: দলপতিদের নিয়ে স্বহস্তে কাবাগৃহের যথাস্থানে তা স্থাপন করে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করেন।
তাবাকাতে ইবনে সায়াদের বর্ণনা মতে, জান্নাতি সেই পাথরটির রঙ বরফের শিলার চেয়েও বেশি চমকদার এবং সাদা ছিল। স্পর্শকারী ও চুম্বনকারী বনি আদমের গোনাহসমূহ শোষণ করতে করতে এর রঙ কালো হয়ে গেলে তাকে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর নামে অভিহিত করা হয়েছে।
হাদিস শরিফে হাজরে আসওয়াদ
* হজরত ওমর রা: একদা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করার সময় বলেছিলেন, ‘আমি অবশ্যই জানি যে, তুমি একটি পাথর মাত্র। তুমি কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ করতে পারো না। আমি মহানবী সা:কে যদি তোমাকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে আমি তোমাকে কখনোই চুম্বন করতাম না।’ (বুখারি, মুসলিম)।
* যুবাইর ইবনু আরাবি রা: থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি ইবনু ওমর রা:কে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। জবাবে তিনি বললেন, ‘আমি মহানবী সা:কে তা স্পর্শ ও চুম্বন করতে দেখেছি।’ (তিরমিজি)
হাজরে আসওয়াদের মর্যাদা
* মহানবী সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন এই পাথরটিকে উপস্থিত করা হবে। তার দু’টি চোখ থাকবে তা দিয়ে সে দেখবে, জবান থাকবে যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং সাক্ষী দেবে এমন লোকের অনুকূলে যে তাকে সততার সাথে চুম্বন করেছে।’ (ইবনে মাজা)
* হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা: বলেন, আমি মহানবী সা:কে বলতে শুনেছি, ‘এই দুটি রোকন (হাজরে আসওয়াদ ও রোকনে ইয়ামানি) স্পর্শ করা গুনাহগুলোকে মুছে দেয়।’ (জামে তিরমিজি)
হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের নিয়ম
বাইতুল্লাহ শরিফ তাওয়াফের সময় এ পাথরটি স্পর্শ ও চুম্বন করে তাওয়াফ শুরু করা সুন্নাত। ভিড়ের কারণে অনেকে ভক্তির আতিশয্যে হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের জন্য রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে ধাক্কা ধাক্কি করে লোকদের কষ্ট দিয়ে চুম্বন করা ঠিক নয়। চুম্বন দেয়া সম্ভব না হলে তার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আল্লাহু আকবার বলে উভয় হাতের তালু তার দিকে সম্প্রসারিত করে স্বীয় হস্ত চুম্বন করলেও সুন্নত আদায় হয়ে যাবে এবং মহান আল্লাহ হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের বরকত দান করবেন। হজরত হানজালা রা: বলেন, আমি তাউস রা:কে দেখেছি, তিনি হাজরে আসওয়াদের কাছ দিয়ে যেতেন, যদি ওই স্থানে ভিড় লক্ষ করতেন তবে চলে যেতেন। আর যদি ভিড়শূন্য পেতেন তখন তাকে চুম্বন করতেন তিনবার। (সুনানে নাসায়ি) মূলত এ পাথরকে চুমু দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করা।
শেষ কথা
হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথরটির আদি নিবাস জান্নাত হওয়ার কারণে এর স্পর্শকারী ও চুম্বনকারী দুনিয়ার জীবনেই জান্নাতের সাথে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন করে থাকেন। মূলত এ পাথরটি কেবলই একটি পাথর যা পার্থিব জীবনে কারো কল্যাণ বা অকল্যাণ কোনোটাই করতে পারে না। পাপ শোষণ হয়েছে এ ধারণা করে পুনরায় পাপে নিমজ্জিত হওয়া কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। পাপমুক্ত জীবন নিয়ে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে পারাই হবে এ পাথর স্পর্শ ও চুম্বনের উত্তম প্রতিদান।
লেখক : প্রভাষক, বাড্ডা আলাতুন্নেছা স্কুল অ্যান্ড কলেজ
dr.atique73@yahoo.com