বিশ্বের ২০ মহামারি : শেষ কোথায়?
বিশ্বের ২০ মহামারি : শেষ কোথায়? - ছবি : সংগৃহীত
মানব ইতিহাস ও রোগযুদ্ধ এক সূত্রে গাঁথা। শান্তির সময়, আনন্দের সময়ের স্বল্পতাই যেন মুখ্য। কেন দুর্যোগের সময়ের এই আধিক্য এবং নিরবচ্ছিন্নতা তার গবেষণা-আলোচনার শেষ নেই। তাই মহামারির কথা জানে না এমন মানুষ নেই। হিসাবটা একেবারে সঠিক না হলে জনমনে এটা বদ্ধমূল যে, মহামারী প্রতি এক শ’ বছরে আসে। হয়তো এ জন্য বলা হয় মহামারীর ঘটনাগুলো শতাধিক বছর পরপর ঘটেছে। আর তারপর সে সমাজ এক বাঁক নিয়ে নতুন পথে চলেছে।
এবারের করোনাভাইরাস মহামারি সেভাবেই এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এখানে যে প্রশ্ন স্বাভাবিক তা হলো, ভাইরাস কী? বলা হয় এটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বাহন বা ঘটক যা শুধু এক জীবন্ত জীবকোষের মধ্য দিয়ে নিজেকে বিভক্ত করে বেঁচে থাকে এবং বিস্তার লাভ করে। আর ভাইরাস সবধরনের জীবন্ত সেলকে সংক্রমণ করতে পারে। যাই হোক, এবার দেখা যাক এই জীবাণুঘটিত মহামারী কতবার এসেছে পৃথিবীতে? প্রতি শতকেই এর নানারূপের উপস্থিতি লক্ষ করা যায় এবং এর সংখ্যা অগণিত। অনুসন্ধানীরা তাই বিরত থেকেছেন একে সংখ্যায় বর্ণনা দিতে। তবুও এর মাঝ থেকে অন্তত ২০টি প্রধান বলে কেউ কেউ বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। তারও পার্থক্য অনেক। এখানে ২০টির বর্ণনা করা হলো উদাহরণ হিসেবে।
১. প্রাগৈতিহাসিক মহামারী (আনুমানিক ৩০০০ খ্রিষ্টপূর্ব) প্রায় ৫০০০ বছর আগে চীনের ‘হামিনমাংঘা’ এবং মিয়াওজিগন (Hamin Mangha ও Miaozigon) বলে পরচিত দেশের উত্তরাঞ্চলে এই মহামারীর আবির্ভাব ঘটেছিল। একেক কবরে শত শত হাড়-কঙ্কালের উপস্থিতি প্রমাণ। এত মৃতদেহের কঙ্কালের উপস্থিতি প্রমাণ করে কবর দেয়ার স্থানের অভাব ঘটেছিল।
২. এথেন্সের প্লেগ : ৪৩০ সালের দিকে এথেন্স ও স্পার্টার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ঠিক এই যুদ্ধের মাঝেও এক রোগের আবির্ভাব ঘটে। মানুষ অত্যন্ত গরম হয়ে ওঠে এবং নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। গ্রিক ঐতিহাসিক থুুসিডাইস লিখেছেন, অন্তত এক লাখ মানুষ এই পাঁচ বছরের মহামারীতে মৃত্যুবরণ করে।
৩. অ্যাল্টোনাইন প্লেগ (১৬৫-১৮০) : ‘ডিজঅ্যাবিলিটি ইন অ্যান্টিকুইটি’ বইয়ের এক নিবন্ধে মানচেষ্টার মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির সিনিয়র লেকচারার এপ্রিল পুশলে লিখেছেন, এই প্লেগটি (সম্ভবত গুটিবসন্ত) পার্থিয়া বিজয়ের পর সেখান থেকে রোমান সাম্রাজ্যে বহন করে আনে এবং এই রোগ প্রায় ১৫ বছরে ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটায়। ইউরোপ থেকে এই জলবসন্ত বিশ্বে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।
৪. সাইপ্রিয়ান প্লেগ (খ্রিষ্টাব্দ ২৫০-২৭১) : তিউনিসিয়ার সেন্ট সাইপ্রিয়ানের নামে দেয়া এই মহামারীতে প্রায় ৫০০০ লোক ১৯১৪ সালে এক দিনেই মারা যায় শুধু রোমেই। প্রতœতাত্ত্বিকরা অনুসন্ধানে পায় প্রতিটি দেহ চুন দিয়ে আবৃত ছিল। তারা তিনটি চুন বানানোর ভাটি (বড় চুলা) দেখতে পায়। প্রতিটি কবরের বহুসংখ্যক কঙ্কলের উপস্থিতি প্রমাণ করে মহামারীর বিশালত্ব।
৫. জাস্টিনিয়ানের মহামারী (৫৪১-৫৪২) : বাইজানটাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের (৫২৭-৫৬৫ খ্রিষ্টাব্দ রাজত্বকাল) নামে এই মহামারীতে বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ মারা যায়। এই সময় বাইজানটাইন সাম্রাজ্য তার ক্ষমতায় শীর্ষে ছিল। এর সাম্রাজ্য মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে বিস্তৃত ছিল। জাস্টিনিয়ান আজকের ইস্তাম্বুলে সোফিয়া নামে এক ক্যাথিড্রাল নির্মাণ করেন। সম্রাট নিজেও এই প্লেগে আক্রান্ত হয়েও বেঁচে যান। তবে তার সাম্রাজ্য সঙ্কুচিত হতে থাকে।
৬. ব্লাক ডেথ (১৩৪৬-১৩৫৩) এই মহামারী এশিয়াতে শুরু হয়ে বিস্তৃতি লাভ করে পশ্চিম ইউরোপে প্রবেশ করে। তবে এর জন্ম ইউরোপে। ইউরোপিয়ানরা মধ্যপ্রাচ্য দখলের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এর বিস্তৃতি ঘটে। ইঁদুর থেকে এই জীবাণু মাছির ওপর ভর করে এক জন্তু থেকে অন্য জন্তুতে এবং পরিশেষে মানবদেহে সংক্রামিত হয়ে ভয়ানক বিশ্ব মহামারীতে পরিণত হয়। তবে এই মহামারীর ইতিবাচক দিক হলো, এটা ইউরোপের দাস প্রথার ইতি ঘটায়। কারণ তখন এত মানুষের মৃত্যু ঘটে যে, মানুষ কেনাবেচা প্রায় লুপ্ত হয় এবং ইউরোপের প্রায় অর্ধেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।
৭. কোকো লিৎজি মহামারী (১৫৪৫-১৫৪৮) : আজটেক (ইউরোপের একটি স্থান) ভাষার একটি শব্দ কোকোলিৎজি। যার অর্থ হলো সংক্রামণ মহামারী। প্রচণ্ড জ্বর হয়। মেক্সিকো এবং সেন্ট্রাল আমেরিকার দেড় কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই জীবাণু হারিয়ে যায়নি এবং এখনো বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিরাজ করে স্বাস্থ্যের প্রতি এক বিরাট হুমকি হিসেবে রয়েছে।
৮. আমেকিরান প্লেগ (ষোড়শ শতাব্দী) : এটাকে ইউরোসিয়ান রোগ বলে বলা হয়। এই রোগে ইঙ্কা এবং আজটেক সভ্যতা হারিয়ে যায়। এই রোগগুলোর মাঝে আছে জলবসন্ত। অনুমান করা হয় পশ্চিম গোলার্ধের প্রায় ৯০ শতাংশ স্থানীয় মানুষেরা (ইনডিজেনাস পপুলেশন) মৃত্যুবরণ করে। এই রোগের ফলে স্পেনের হারমান করটিস আজটেকের রাজধানী টেনোকটিটলান ১৫১৯ সালে সহজেই দখল করে। আরেকটি স্পেনের দল ফ্রানসিসকো পিজারোর নেতৃত্বে ইনকা ১৫৩২ সালে দখল করে। এই রোগ ইনকা এবং আজটেকের সৈন্যদের সংক্রামিত করলে তারা যুদ্ধে অপারগ হয়ে হেরে যায়।
৯. লন্ডনের প্লেগ (১৬৬৫-১৬৬৬) এই প্লেগ ১৬৬৫ সালের এপ্রিলে শুরু হয় ইঁদুর থেকে এবং কয়েক মাসে লন্ডন এলাকায় অন্তত এক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। তবে এই বিয়োগান্ত ঘটনা এখানেই শেষ ছিল না। ঠিক এ সময়েই লন্ডনের এক বিরাট এলাকা আগুনে পুড়ে যায়।
১০. মারসেইর গ্রেট প্লেগ (১৭২০-১২২৩) : ঐতিহাসিক তথ্য অনুসারে ফরাসি জাহাজ গ্রান্ডসেল্ট অ্যানটইন মধ্যপ্রাচ্য থেকে মালপত্র এনে মারসাইতে নোঙর স্থাপন করে। এর মধ্যে ছিল গ্লেগ জীবাণুবাহিত ইঁদুর। এরা স্থলে গিয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং সেই সাথে তিন বছর ধরে চলে প্লেগের তাণ্ডবলীলা। প্রায় এক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে।
১১. রাশিয়ান প্লেগ (১৭৭০-১৭৭২) : এই প্লেগের জন্য মস্কোতে কোয়ারেন্টিনে (পৃথক করে রাখা) রাখা মানুষের মাঝে ঝগড়া-বিবাদ এবং হানাহানি শুরু হয় এবং প্রায় এক লাখ লোক মৃত্যুবরণ করে। এ সময় রাশিয়াতে ক্যাথারিন দ্য গ্রেট সিংহাসনে ছিলেন।
১২. ফিলাডেলফিয়ার ইয়োলো প্লেগ (১৭৯৩) : তখন ফিনাডেলফিয়া ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী এবং ইয়োলো জ্বর মহামারীতে আক্রান্ত। শাসকেরা বিশ্বাস করত আফ্রিকার কালোদের এই জ্বর আক্রমণ করবে না। তাই তাদের হাজার হাজার লোকদের নিয়ে আসা হলো আক্রান্তদের সেবা করার জন্য। ফল হলো মশা এই জীবাণু আফ্রিকানদের মাঝে ছড়িয়ে দিলো। তখন ছিল গরমের সময়। যখন শীত এলো রোগ ছড়ানো বন্ধ হলো। কিন্তু এর মাঝে প্রায় ছয় হাজার মৃত্যুবরণ করল।
১৩. ফ্লু মহামারী (১৮৮৯-১৮৯০) : প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে রোগের বিস্তারও যে সহজ হতে পারে তার প্রমাণ মেলে রাশিয়ার ফ্লু’র বিস্তার। সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রথম এর উৎপত্তি এবং দ্রুত সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। পরে সারা বিশ্বে এবং সেবার প্রায় ১০ লাখ লোকের মৃত্যু ঘটে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগ পর্যন্ত।
১৪. আমেরিকান পোলিও এপিডেমিক (১৯১৬) : এ বছর নিউ ইয়র্কে পোলিওর আবির্ভাব ঘটে এবং মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ৩০ হাজার লোকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং অন্তত সাত হাজার লোকের মৃত্যু ঘটে। ১৯৫৪ সালে টিকা আবিষ্কারের পর মৃতের সংখ্যা কমে যায়। তবে রোগটি সম্পূর্ণভাবে নির্মূল হয়নি।
১৫. স্পেনিশ ফ্লু (১৯১৮-১৯২০) : সাউথ সি থেকে নর্থ পোল পর্যন্ত ৫০ কোটি লোক এই রোগে আক্রান্ত হয় এবং এক পঞ্চমাংশ মানুষ মৃত্যুবরণ করে বলে অনুসন্ধানীরা দাবি করেন। তবে এই রোগটি কোথায় উৎপত্তি তা সঠিক কেউ বলতে পারে না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে স্পেন নিরপেক্ষ ছিল তাই এই রোগের আলোচনা এবং সংবাদ প্রকাশ সেখানে ছিল সহজ। সেজন্যই একে স্পেনিস ফ্লু বলে বলা হয়।
১৬. এভিয়ান ফ্লু (১৯৫৭-১৯৫৮) : এর উৎপত্তি ঘটে চীনে। প্রায় ১১ লাখ লোক এই ফ্লুতে মৃত্যুবরণ করে। এভিয়ান ফ্লুর সব ভাইরাসের জীবাণুদের একত্রীকরণের মধ্য দিয়ে এই ফ্লুর জন্ম এবং বিস্তার বলে অনুসন্ধানীরা বলেন। সোয়া লাখ লোক শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মারা যায়।
১৭. এইডস মহামারী (১৯৮১ থেকে বর্তমান সময়) : অনুসন্ধানীরা বলেন, ১৯২০-এর দিকে এইডস রোগের উৎপত্তি। এটা
সিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের মধ্যে এই ইমিউনি ডেফিসিয়ানসি ভাইরাস বলে পরিচিত এই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে। এই এইডস রোগটি প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষের প্রাণ হরণ করেছে ২০২০ সাল পর্যন্ত। এখন প্রায় চার কোটি মানুষ সাবসাহারাতে এই রোগের এলাকার মধ্যে। ১৯৯০ তে এর ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পরে এখন মানুষ এই রোগের খানিকটা চিকিৎসা পেয়েছে।
১৮. হিনি সোয়াইন ফ্লু মহামারী (২০০৯-২০১০) : এই রোগের উৎপত্তি হয় মেক্সিকোতে ২০০০ সালের দিকে এবং বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯. ওয়েস্ট আফ্রিকান ইবোলা এপিডেমিক (২০১৪-২০১৬) : ইবোলা পশ্চিম আফ্রিকায় ২০১৪-২০১৬ তার স্বরূপ প্রকাশ করে। প্রায় ১২ হাজার মানুষ এতে মৃত্যুবরণ করে বলে অনুসন্ধানীরা বলছেন। এর প্রথম প্রকাশ গিনিতে ২০১৩ সালে। পরে লাইবেরিয়া এবং সিয়েরালিয়নে ছড়িয়ে পড়ে। এবং প্রায় সারা আফ্রিকায় এর চলাফেরা চলছে। এর উৎপত্তি বাদুড় থেকে।
২০. জিকা ভাইরাস মহামারী (২০১৫-বর্তমান সময়) : দক্ষিণ এবং সেন্ট্রাল আমেরিকায় গত পাঁচ বছর ধরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এডিস মশা এই ভাইরাসটি বয়ে বেড়ায়। এটা সাধারণ মানুষদের তেমন কোনো ক্ষতি করে না। তবে মায়ের পেটে থাকাকালীন শিশুর মৃত্যু ঘটাতে পারে। এই জিকা আক্রান্ত পেটের শিশুরা মৃত অবস্থায় জন্ম নেয় বলে বিজ্ঞানীরা বলেন।
তবে কোভিড-১৯ ভাইরাসটি ভয়ঙ্কর এ জন্য যে, এটা শুধু জীবন্ত জীবকোষে বাঁচে এবং সেখানে বংশবিস্তার করে। এ ছাড়া তারা নিজেদের পরিবর্তন করে মানব কোষের মতো ব্যবহার শুরু করে ধীরে ধীরে পুরো দেহটাকে দখল করে।
এটার শেষ কখন? এর জবাব এখনো পুরোপুরি কেউ জানে না। কারণ এটা ক্রমান্বয়ে চরিত্র বদলাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দু’রকম অবস্থা বলছেন। হয় সংক্রামিত মানুষেরা ইমিউন হয়ে যাবে অথবা এটা সাধারণ রেসপিরেটরি রোগ হিসেবে বিরাজ করবে।