নেপালে কলকাঠি নাড়ছে ভারত?
নেপালে কলকাঠি নাড়ছে ভারত? - ছবি : সংগৃহীত
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন, তাকে উৎখাত করার জন্য ভারত ষড়যন্ত্র করছেন। তিনি এর আগে অভিযোগ করেছিলেন, নেপালের একটি অংশ দখল করেছে ভারত। তিনি ওইসব অংশকে নেপালের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে সংবিধানও সংশোধন করেছিলেন। এই প্রেক্ষাপটে ওলির ওই দাবি বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তাছাড়া নেপালের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপের অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
ওলি যখন ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য রাখছিলেন, তখন প্রচণ্ড নামে পরিচিত পুষ্প কমল দহল প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে শক্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।
উল্লেখ্য, গত নির্বাচনের আগে দু দল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়ে ওলি কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট-এর প্রধান ছিলেন, প্রচণ্ড ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-মাওয়িস্টের প্রধান।
ক্ষমতা ভাগাভাগির জন্য নেপালের দুই বড় বামপন্থী দল হাতে হাত মিলিয়েছিল দু বছর আগে। এখন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল, যিনি প্রচণ্ড নামে অধিক পরিচিত, এই দুজনের মধ্যে সংঘাত পরিস্থিতি এই ঐক্যের ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।
সংবিধানে ভারতের এলাকা নিয়ে তৈরি নতুন মানচিত্র পাশ করানোর ব্যাপারে প্রধান উদ্যোক্তা ওলি অভিযোগ করেছেন প্রচণ্ড তাকে অপসারণের চক্রান্তে লিপ্ত। ২০০৬ সালে নেপালে অভ্যুত্থান সমাপ্ত করে শান্তি প্রক্রিয়া স্থাপনের জন্য নয়া দিল্লি যখন উদ্যোগ নিয়েছিল, সে সময়ে প্রচণ্ড ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। এখন ওলি অভিযোগ করছেন ভারত তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর প্রক্রিয়ায় উসকানি দিচ্ছে।
রোববার এক অনুষ্ঠানে ওলি বলেছেন, দিল্লির কাজকর্ম, নেপালের একাংশের রাজনীতি এবং তাদংর সহযোগীরা সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আমার অবস্থানের জন্য আমাকে সরাতে চাইছে। তারা এ কাজে সমর্থ হবে এমন যেন কেউ না ভাবেন।
এবং দলের স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠকে গত সপ্তাহে বলেছেন, পর্যায়ক্রমে প্রধানমন্ত্রিত্বের চুক্তি থেকে সরে আসার ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।
৬ মাস আগে প্রচণ্ড এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন, তিনি ওলিকে আরো পাঁচ বছর কার্যভার চালাতে দিতে রাজি হয়েছেন। ওলি তাকে দলের প্রধান হিসেবে কাজ চালানো ও তাকে সমস্ত কর্তৃত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতির পরেই প্রচণ্ড এ ব্যাপারে সম্মত হন। তবে ওলি সমস্ত বড় সিদ্ধান্ত নিজেই নেন এবং দলের প্রধানের কাজও করেন, শোনা যায় বহু সময়ে প্রচণ্ডকে তা জানানোই হয় না।
যতদিন না সাধারণ কনভেনশন হয়, ততদিন দুজনেই নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান। দু দল ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সময়ে ওলি কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট-এর প্রধান ছিলেন, প্রচণ্ড ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-মাওয়িস্টের প্রধান।
প্রতিদ্বন্দ্বীদের বন্ধুতা
৬৯ বছরের ওলি প্রচণ্ডের চেয়ে তিন বছরের বড়। ওলি ছিলেন স্কুল ড্রপআউট। ২২ বছর বয়সে নকশাল আন্দোলন চলাকালীন পূর্ব নেপালের এক কৃষক ধর্ম প্রসাদ ঢাকালকে হত্যার দায়ে তিনি জেলে যান। ৭-এর দশকের গোড়ার দিকে জেলে যাওয়ার পর ১৪ বছর তিনি জেলে কাটান। ৮-এর দশকের মাঝামাঝি রাজানুগ্রহে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনের সময় থেকে রাজনীতিতে তার উত্থান।
ওলির মতো প্রচণ্ডও তার ছাত্রজীবনে সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে গোপন রাজনীতিতে জড়ান। ৯-এর দশকে বহুদলীয় গণতন্ত্র শুরু হলেও প্রচণ্ড তাতে যোগ দেননি, তার বদলে বেছে নিয়েছিলেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানকে। ১৯৯৬ সালে তিনি মাওবাদ গ্রহণ করেন, উদ্দেশ্য ছিল রাজতন্ত্র, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও সংশোধনবাদী কমিউনিস্টদের অবসান। পুরো অভ্যুত্থানের সময় জুড়ে মাওবাদীদের কঠোর সমালোচক ছিলেন ওলি। এই অভ্যুত্থানে ১৭ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়।
২০০৬ সালে নয়া দিল্লির মধ্যস্থতায় যখন সংঘর্ষ শেষ হয়, তখন প্রচণ্ড নায়ক। হিন্দু রাজত্ব থেকে ধর্মনিরপেক্ষ, ফেডারেল সাধারণতন্ত্রে যাওয়ার ব্যাপারে ওলি ছিলেন সংশয়ী। তার একটা কথা খুবই প্রচারিত- “গরুর গাড়িতে করে আমেরিকায় যাওয়া যায় না”।
কিন্তু কোয়ালিশন শাসনে যাওয়ার ব্যাপারটা দুই নেতাকে একত্রে এনে দিয়েছিল। তারা ২০১৭ সালের ভোটে একত্রে লড়ার, এবং ফল বেরোনোর পর একত্রীকরণের সিদ্ধান্ত নেন, ওলিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হয়। ২৭৫ আসনের মধ্যে ১৭৪ আসনে জেতেন তারা। তারপর থেকে ওলি নায়ক হিসেবে উঠে আসেন, বিশেষ করে ব্লকেডের সময়ে ভারতবিরোধী অবস্থান নেয়া ও চীনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর।
বন্ধুত্ব টিকল না কেন
দুই নেতার মধ্যেকার পার্থক্য শুরু থেকেই দেখা যাচ্ছিল। ওলির এমন একজন রাষ্ট্রপতি প্রয়োজন ছিল, যিনি বিপদের সময়ে তাকে রক্ষা করতে পারবেন। তিনি তার পুরনো দলের গোষ্ঠী সংঘাতের সময় থেকে তার পক্ষে থাকা বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারীকে বেছে নেন। প্রচণ্ডের প্রয়োজন ছিল একজন স্পিকার যিনি ঐক্য ভেঙে গেলে তার গোষ্ঠীকে সংসদের সদস্যপদ হারানো থেকে রক্ষা করতে পারবেন। কেবি মেহারা যৌন কেলেংকারির জেরে পদ ছাড়ার পর, সেই জায়গায় তিনি অগ্নি সাপকোতাকে নতুন স্পিকার পদে নির্বাচিত করতে সক্ষম হন।
গত মাসে ওলি একটি অর্ডিন্যান্স জারি করেন। যাতে বলা হয় দলের ওয়ার্কিং কমিটিতে বা পার্লামেন্টারি পার্টিতে ৪০ শতাংশ সমর্থন থাকলেই (উভয়ের দরকার নেই) বিভাজন করা যাবে এবং তাতে সংসদের সদস্যপদ বাতিল হবে না। ওলির এক উপদেষ্টা বলেন, “দলের অনেকেই বিষয়টি ভুল বুঝেছে, আসলে এটা হলো প্রচণ্ড গোষ্ঠীর সহজে বেরিয়ে যাওয়ার রুট।” তবে সে অর্ডিন্যান্স শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহৃত হয়। অভিযোগ উঠেছিল ওলি নিজের দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য বিরোধী দলগুলোকে ভাঙার চেষ্টার করছেন, তার সরকারের ৯ জন সদস্য কম।
পুরোন গোষ্ঠীগত কারণই পার্টির মধ্যে বিভাজনবাদের একমাত্র কারণ নয়। ৯ সদস্যের সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট, যেখানে পার্টির বরিষ্ঠ নেতারা রয়েছেন, ওলির বিরুদ্ধে। তিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও, মাধব নেপাল, ঝালনাথ খানাল ও প্রচণ্ড- তিন নেতা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশনকে পাঁচ শ মিলিয়ন ডলার অনুদানের তীব্র বিরোধিতা করেছেন, তাদের বক্তব্য এর সঙ্গে মার্কিন নিরাপত্তার স্বার্থ যুক্ত। সংসদে ওলির যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে কারণ বিরোধী দল নেপালি কংগ্রেস তাকে সমর্থন দিয়েছে।
এখন দুই শিবির
দলের এক প্রভাবশালী নেতার কথায়, “ওলি এখন স্ট্যান্ডিং কমিটিতে সংখ্যালঘু হলেও, এখনই তাকে পদত্যাগ করতে হবে না, তবে এটা খুব স্পষ্ট বার্তা যে তার হাতে এখন মাত্র কয়েক মাস বাকি, তিন চার মাসের বেশি সম্ভবত নয়। এখন উনি গেলে, আমাদের দোষ দেবেন যে নয়া দিল্লির সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে ঝামেলার সময়ে আমরা ভারতীয় সমর্থন নিয়ে তাকে বের করে দিয়েছি।”
প্রচণ্ডের কথা মতো, ওলি অনেকবার ইঙ্গিত দিয়েছেন যে “একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব না হলে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া উচিত।” স্ট্যান্ডিং কমিটির শুরুর সেশনে তিনি বলেন, তিনি আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সমতার কথা শুনছেন – এর ফলে মনে করা হচ্ছে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য ওলি নেপাল সেনাকে কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন।
ওলি শিবির থেকে সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী গোকুল বাসকোটা বলেছেন – অনেকেই মনে করেন ওলির কারণেই প্রচণ্ডের বিরুদ্ধে দুর্নীতির তদন্ত শুরু হতে পারে, প্রচণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ ২০০৮-১৩ সময়ে শান্তি প্রক্রিয়া চলাকালীন মাওবাদী সদস্যদের জন্য সংগৃহীত অর্থ তিনি আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া ওলি শিবিরের অনেকে দাবি করেছেন সংঘর্ষের সময়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য প্রচণ্ড ও তার অনুগামীদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত।
পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোজ জুং থাপা বলেছেন, “সমস্যা রয়েছে, শেষ পর্যন্ত দুপক্ষই আজ যা চাইছে তা হলো সংহত পার্টি ও সম্মানজনক ক্ষমতা ভাগাভাগি, শেষ পর্যন্ত তাই হবে।”
কিন্তু প্রচণ্ড শিবির আশা করছে শেষ পর্যন্ত ওলিকে সরতেই হবে। তবে তার জায়গা প্রচণ্ডই নেবেন, এ কথা এখনো স্পষ্ট নয়।
সূত্র : ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস