বান্দাহর ওপর আল্লাহর ১০ হক

ড. সাইফুল গণি নোমান | Jul 01, 2020 08:49 am
বান্দাহর ওপর আল্লাহর ১০ হক

বান্দাহর ওপর আল্লাহর ১০ হক - ছবি : সংগৃহীত

 

বান্দাহর প্রতি আল্লাহর হক বা অধিকার হলো মানুষ একমাত্র রাব্বুল আলামিনের ইবাদত করবে। তার সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। সব প্রকার নাফরমানি ও অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকবে । সব কাজে তার পূর্ণ আনুগত্য করবে। পবিত্র কুরআন ও সুন্নাত অনুযায়ী বান্দাহ তার দুনিয়ার সব কাজ পালন করবে। দুনিয়াতে মানুষের যেমন আল্লাহর ওপর অধিকার রয়েছে তেমনিভাবে আল্লাহরও বান্দাহর ওপর কিছু অধিকার রয়েছে। বান্দাহ অজ্ঞতাপ্রসূত এবং অবহেলার কারণে আল্লাহর সাথে অপরাধ করতে পারে। এ কারণে যদি আল্লাহ তায়ালা বান্দাহকে আজাব বা শাস্তি দিতে পারেন, আর যদি তিনি চান বান্দাহকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। আর এটি বান্দাহর ওপর আল্লাহর একান্ত রহমত।

বান্দাহর ওপর আল্লাহর অধিকার রয়েছে এ ব্যাপারটি হাদিসে এসেছে। মুয়াজ ইবন জাবাল রা: থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বিশ্বনবীর পেছনে তার বাহনের ওপর বসা ছিলাম। তখন তিনি বললেন, ‘হে মুয়াজ! তুমি কি জানো বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক কী? আমি বললাম, এ ব্যাপারে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই বেশি জানেন। রাসূল সা: বললেন, বান্দাহর ওপর আল্লাহর হক হলোÑ একমাত্র তাঁরই ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবে না। তারপর রাসূল সা: আরো অনেক পথ চলার পর আবার বললেন, হে মুয়াজ ইবন জাবাল! তুমি কি জান, বান্দা যদি এ কাজটি করে তাহলে আল্লাহর ওপর বান্দাহর কী হক রয়েছে? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভালো জানেন। তিনি বললেন, আল্লাহর উপর বান্দাহর হক হলো তাদের শাস্তি না দেয়া। (বুখারি : ৬৫০০)

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বান্দাহর ওপর আল্লাহর হকসমূহ উল্লেখ করে বলেন : আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাঁর সাথে কোনো বিষয়ে অংশীদার স্থাপন করো না এবং মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো এবং আত্মীয়স্বজন, পিতৃহীন, দরিদ্র, সম্পর্কবিহীন নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করো; নিশ্চয়ই আল্লাহ অহঙ্কারি ও দাম্ভিককারীকে ভালোবাসেন না। (সূরা নিসা-৩৬)

উপরিউক্ত আয়াতে বান্দাহর ওপর আল্লাহর দশটি হকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তা হলো-

এক. প্রথম অধিকার হলো আল্লাহর ইবাদত করা। আল্লাহ তায়ালা স্বীয় ইবাদতের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং স্বীয় একত্বে বিশ্বাস স্থাপন করতে বলেছেন। আর তার সাথে কাউকে অংশীদার করতে নিষেধ করেছেন। কেননা সৃষ্টিকর্তা, আহার্যদাতা, নেয়ামত প্রদানকারী এবং সমস্ত সৃষ্ট জীবের ওপর সদা সর্বদা ও সর্বাবস্থায় দানের বৃষ্টির বর্ষণকারী একমাত্র মহান রাব্বুল আলামিন। সুতরাং একমাত্র তিনিই হচ্ছেন ইবাদতের যোগ্য। এখানে আল্লাহ একমাত্র নিজের উলুহিয়াত তথা এক আল্লাহর ইবাদতের নির্দেশ দিয়েছেন আর তার সাথে উলুহিয়াত বিধ্বংসী আমল শিরক করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। (তাফসিরে ফাতহুল কাদির)।

দুই . পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করা। তোমরা পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে থাকো। কেননা তারাই তোমাদের অস্তিত্বহীনতা থেকে অস্তিত্বে আনয়নের কারণ। কুরআনের অনেক আয়াতে আল্লাহ স্বীয় ইবাদতের সাথে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন : আমি তো মানুষকে তার মাতা-পিতার প্রতি সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। মা সন্তানকে কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার মাতা-পিতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই কাছে। (সূরা : লোকমান : ১৪)

 এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, তাওহিদের পর সব আপনজন-আত্মীয় ও সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে পিতা-মাতার অধিকার সর্বাগ্রে। আল্লাহ্ তায়ালা স্বীয় ইবাদাত বন্দেগি ও অধিকারের পরপরই পিতা-মাতার অধিকার।

তিন. আত্মীয়স্বজন। এখানে সব আত্মীয়স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। কুরআনুল কারিমের অপর এক আয়াতে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যা রাসূল সা: প্রায়ই বিভিন্ন ভাষণের পর তিলাওয়াত করতেন। তা হলোÑ ‘আল্লাহ সবার সাথে ন্যায় ও সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিচ্ছেন এবং নির্দেশ দিচ্ছেন আত্মীয়স্বজনের হক আদায় করার জন্য।’ (সূরা আন-নাহল : ৯০) এতে সামর্থ্যানুযায়ী আত্মীয়-আপনজনদের কায়িক ও আর্থিক সেবাযতœ করা, তাদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করা এবং তাদের খবরা-খবর নেয়াও অন্তর্ভুক্ত।

চার. ইয়াতিম বা অভাবগ্রস্ত। লাওয়ারিশ তথা অনাথ শিশু এবং অসহায় মানুষের সাহায্য-সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করবে। যেমনটা আপন আত্মীয়-স্বজনদের বেলায় করে থাকো। আল্লাহ বলেন : ইয়াতিমদের তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। (আন-নিসা : ২) অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন, আর তাদের ধনসম্পদে রয়েছে ভিক্ষুক ও বঞ্চিতের হক। (আয-যারয়াত:১৯) তারা এমন অভাবী। যারা চাওয়া থেকে বিরত থাকে। তাই পাওয়ার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও লোকে তাদের দেয় না। অথবা এমন ব্যক্তি যার সব কিছু আকাশ বা পৃথিবী থেকে আগত কোনো দুর্যোগ বা আপদে নষ্ট হয়ে গেছে।

পাঁচ. নিকট প্রতিবেশী । রাসূল সা: বলেন, হে আবু যর, যখন তরকারি রান্না করবে তখন তাতে বেশি পরিমাণে পানি দিও এবং এর দ্বারা তোমার পড়শির খোঁজখবর নিও। (মুসলিম : ২৬২৫) রাসূল সা: আরো বলেন, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের ওপর ঈমান রাখে সে যেন তার পড়শির সম্মান করে, তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিবসের ওপর ঈমান আনে সে যেন তার মেহমানের পুরস্কার দিয়ে তাকে সম্মানিত করে। সাহাবায়ে কিরাম বললেন, মেহমানের পুরস্কার কী? তিনি বললেন, একদিন ও রাত্রি। আর মেহমান তিন দিনের পরের যে সময়, তাতে ব্যয় করা সদকাস্বরূপ। তোমাদের মধ্যে যে আল্লাহ ও শেষ দিনের ওপর ঈমান আনে সে যেন ভালো বলে অথবা চুপ থাকে। (বুখারি : ৬০১৯)

ছয়. দূর-প্রতিবেশী। এ আয়াতে দু’রকমের প্রতিবেশীর কথা বলা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস রা: বলেন, দূর প্রতিবেশী সেসব প্রতিবেশীকে বোঝায়, যারা প্রতিবেশী হওয়ার সাথে সাথে আত্মীয়ও বটে। এভাবে এতে দু’টি হক সমন্বিত হয়ে যায়। আর দূর প্রতিবেশী বলতে শুধু সে প্রতিবেশীকে বোঝায় যার সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক নেই। (তাবারিজ)

সাত. সঙ্গী-সাথী। এর শাব্দিক অর্থ হলো সহকর্মী। এতে সফর সঙ্গীরাও অন্তর্ভুক্ত। যারা রেল, জাহাজ, বাস, মোটর প্রভৃতিতে পাশাপাশি বসে ভ্রমণ করে। আর সেসব লোকও অন্তর্ভুক্ত যারা কোনো বিশেষ বৈঠক বা অধিবেশনে আপনার সাথে উপস্থিত থাকে। ইসলামী শরিয়ত নিকটবর্তী ও দূরবর্তী স্থায়ী প্রতিবেশীদের অধিকার সংরক্ষণকে যেমন ওয়াজিব করে দিয়েছে, তেমনিভাবে সে ব্যক্তির সাহচর্যের অধিকারকেও অপরিহার্য করে দিয়েছে। তাদের মধ্যে মুসলিম, অমুসলিম, আত্মীয়, অনাত্মীয় সবাই সমান। সবার সাথে সদ্ব্যবহার করা, কোনো রকম কষ্ট না দেয়া, এমন কোনো কথা না বলা যাতে সে মর্মাহত হতে পারে।

আট. মুসাফির। আয়াতে এমন লোককে বোঝানো হয়েছে। যে সফরের অবস্থায় আপনার কাছে এসে উপস্থিত হয় কিংবা আপনার মেহমান হয়ে যায়। যেহেতু এই অজানা-অচেনা লোকটির কোনো আত্মীয় বা সম্পর্কীয় লোক এখানে উপস্থিত থাকে না। ইসলামী তথা মানবীয় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে তার হকও আপনার ওপর অপরিহার্য। তা হলো, সামর্থ্য ও সাধ্যানুযায়ী তার সাথে সদ্ব্যবহার করা।

নয়. তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করো। এতে অধিকারভুক্ত দাস-দাসীকে বোঝানো হয়েছে। তাদের ব্যাপারেও এ হক সাব্যস্ত করে দেয়া হয়েছে যে, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করতে হবে। সাধ্যানুযায়ী তাদের খাওয়া পরার ব্যাপারে কার্পণ্য করবে না। তাদের ওপর অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দিবে না। এখানে সরাসরিভাবে দাস-দাসীকে বুঝানো হলেও চাকর-চাকরানী ও অধীনস্থ কর্মচারীরা এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাদের নির্ধারিত বেতনভাতা, খানাপিনা প্রভৃতির ব্যাপারে কার্পণ্য করা যাবে না। শরিয়ত মতো তাদের পরিচালনা করা হলে তাদের যাবতীয় খরচও সদকার অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, তুমি নিজে যা খাও তা তোমার জন্য সদকা এবং যা তোমার ছেলেকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা, যা তোমার স্ত্রীকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা। অনুরূপভাবে যা তোমার খাদেমকে খাওয়াও সেটাও তোমার জন্য সদকা হিসেবে গণ্য হবে। (মুসনাদে আহমাদ : ৪/১৩১)

দশ. নিশ্চয় আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে। আল্লাহ্ এমন লোককে পছন্দ করেন না, যে দাম্ভিক এবং নিজেকে অন্যের চেয়ে বড় প্রতিপন্ন করে। এক হাদিসে রাসূল সা: জনৈক সাহাবিকে ওসিয়ত করে বলেন, কাউকে গালি দিও না। সাহাবি বললেন, এরপর আমি কোনো স্বাধীন, দাস, উট বা ছাগল কাউকেই গালি দেইনি। তিনি আরো বললেন, সামান্য কোনো নেক কাজকেও হেয় করে দেখবে না যদিও তোমার কোনো ভাইয়ের সাথে হাসিমুখে কথা বলা হোক। আর তোমার কাপড়কে টাখনুর অর্ধেক পর্যন্ত উঠাবে, যদি তা করতে না চাও তবে দুই গিরা পর্যন্ত নামাতে পারো। কাপড়কে ‘ইসবাল’ বা গিরার নিচে পরা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করো।

এ দশটি অধিকারই বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে খুবই তাৎপর্য বহন করে। ফরজ অধিকারের ক্ষেত্রে কোনোরূপ শৈথিল্য প্রদর্শন করা দোষণীয় আবার লোক দেখানো ও উদ্দেশ্যবিহীন কার্যক্রম আল্লাহ পছন্দ করেন না। করোনাকালীন নিকট আত্মীয়, প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, অসহায় দিনমজুর সবাই চাকরি হারিয়ে দিশেহারা হয়ে ঘুরছে। তাই বান্দাহর ওপর আল্লাহর নির্ধারিত দশটি অধিকার যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে বর্তমানে সমাজের এ শ্রেণীভুক্ত সবাই উপকৃত হবে অন্য দিকে আল্লাহর বিধান যথাযথ বাস্তবায়ন সহজ হবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে আল্লাহর অধিকারগুলো যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন।

লেখক : অধ্যাপক ও ইসলামী গবেষক

dr.saifnumaniu@gmail.com.


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us