রঞ্জিত সিং নাকি ভগত সিং
রঞ্জিত সিং-ভগত সিং - ছবি : সংগৃহীত
শ্রেষ্ঠত্বের উন্মাদনা একটি মানসিক রোগ। এ রোগ শুধু শাসকদের মধ্যে নয়, বরং আজকাল সাধারণ মানুষের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। শাসকগোষ্ঠী শ্রেষ্ঠত্বের চূড়া স্পর্শ করতে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য বৈধ-অবৈধ সব ধরনের চেষ্টা চালিয়ে যায়। আর সবার আগে আইনকে নিজের ঘরের বাঁদি বানিয়ে ফেলে। সাধারণ মানুষ আইনকে বাঁদি বানাতে পারে না বটে, তবে তারা শ্রেষ্ঠ হওয়ার জন্য ইতিহাস থেকে নিজেদের পছন্দমাফিক হিরো এবং খলনায়ক বের করে নেয়। হিরোর সাথে নিজেদের সম্পর্ক যুক্ত করে নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাবতে লাগে। আর খলনায়ককে গালমন্দ করে বিজয়সুলভ অনুভূতিতে উন্মাদ হয়ে যায়। এই অধমের অতীতের এক কলামে লাহোরের ইতিহাসের প্রসঙ্গে রঞ্জিত সিংয়ের কথা আলোচনা এসেছিল। শহরের সম্ভ্রান্ত শ্রেণীর মানুষ উন্মত্ত শিখ সরদারদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য নিজেরা তাকে আমন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু এ কলামকে পুঁজি করে কিছু সুহৃদ পরস্পরের মাঝে কুফর ও ইসলামের লড়াই শুরু করে দিয়েছেন। তেহরিকে ইনসাফের কিছু ক্ষুব্ধ সমর্থক পুরো কলাম না পড়েই আমার দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। কিছু সিন্ধি বন্ধু আপত্তি তুলেছেন, যদি রঞ্জিত সিং পাঞ্জাবিদের হিরো হতে পারেন, তাহলে রাজা দাহির সিন্ধিদের হিরো হতে পারবেন না কেন? কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফুয়াদ চৌধুরী রঞ্জিত সিংয়ের পক্ষে টুইট করেছেন এবং মুসলিম লীগ (এন)-এর জাতীয় অ্যাসেম্বলির সদস্য খাজা সাদ রফিক রঞ্জিত সিংকে ‘ইসলামবিদ্বেষী’রূপে আখ্যায়িত করেছেন।
এই তর্ক-বিতর্কে গালিগালাজ করেছেন যারা, ইসলাম ও দেশপ্রেমের সেই অধিকাংশ দাবিদার শিক্ষিত বটে, কিন্তু ইতিহাস সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল নন। যারা নিজেরা নিজেদের প্রগতিশীল ও সেকুলার চিন্তাভাবনার ধ্বজাধারী অভিহিত করে থাকেন, তারাও একতরফা পক্ষপাতিত্ব করছেন। এ বাস্তবতায় কোনো সন্দেহ নেই যে, রঞ্জিত সিং ১৭৯৯ সালে লাহোর দখলের পর শিখ রাজ্যের সীমানা আফগানিস্তান থেকে চীন পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন। আর এ কারণেই কিছু পাঞ্জাবি তাকে তাদের ‘হিরো’ আখ্যায়িত করে থাকে। তবে রঞ্জিত সিংয়ের সমালোচকদের সংখ্যাও কম নয়। তার সমালোচনা করার অর্থ শিখ ধর্মের সমালোচনা নয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, রঞ্জিত সিং ওই পাঞ্জাবিদের হিরো হতে পারেন, যারা নিজেদের পাঞ্জাবি হওয়া নিয়ে গর্বিত। কিন্তু সেসব পাঞ্জাবি ও কাশ্মিরি তাকে তাদের হিরো মনে করে না, যারা জানে যে, রঞ্জিত সিংয়ের শাসনামলে আজানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। অনুরূপভাবে, আহমদ শাহ আবদালি ওই সব আফগানের হিরো, যারা নিজেদের আফগান হওয়া নিয়ে গর্বিত। কিন্তু কাশ্মিরিরা আবদালি ও রঞ্জিত সিংয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য আছে বলে মনে করে না। কেননা, উভয়েই কাশ্মিরিদের ওপর অত্যাচার করেছেন।
রঞ্জিত সিং মধ্য পাঞ্জাবের কিছু বুদ্ধিজীবীর কাছে হিরো হতে পারেন। কিন্তু দক্ষিণ পাঞ্জাবের অধিবাসীরা তার প্রশংসা কিভাবে করবে? মুলতানে শিখদের দখলদারিত্ব ও মোজাফফর গড় শহরের স্থপতি নওয়াব মোজাফফর খানের শিখদের সাথে লড়াইয়ে পরাজিত হওয়ার পর সেখানে যা হয়েছিল, তা ইতিহাসের গ্রন্থাবলিতে সংরক্ষিত আছে। মুলতানের পর রঞ্জিত সিং কাশ্মিরে হামলা করেছিলেন। ১৮১৯ সালে রঞ্জিত সিংয়ের বাহিনী শ্রীনগরে প্রবেশ করে আফগানদের খুঁজে খুঁজে বের করে হত্যা করে। মুহাম্মাদুদ্দীন ফাওক তার ‘মুকাম্মাল তারিখে কাশ্মির’ গ্রন্থের ৭০৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, আফগানদের শাসনকে যদি ধরা হয় আকণ্ঠ তিক্ত, তাহলে শিখ ‘বাহাদুর’রা ছিল বিষে ভরা তীর। তারা ইসলামী ইবাদতের স্থানসমূহের সাথে যা করেছে, দর্শক শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেই গেছে।’ এটা ঠিক, রঞ্জিত সিংয়ের সরকারে কিছু মুসলমানও শামিল ছিল। ফকির সায়্যিদ ওয়াহিদুদ্দীন তার ‘আসলি রঞ্জিত সিং’ গ্রন্থে তাকে একজন সেকুলার শাসক বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ফকির সাহেবের পরিবারের রঞ্জিত সিংয়ের দরবারের সাথে সম্পৃক্ততা ছিল।
এ পরিবার লাহোরের ফকির খানা মিউজিয়ামে রঞ্জিত সিংয়ের সংশ্লিষ্ট অনেক দুর্লভ বস্তুকে সংরক্ষণ করে রেখেছে। আর এ মিউজিয়াম ইতিহাসের ছাত্রদের জন্য অনেক কিছু জানার স্থান বটে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা চোখ বন্ধ করে রঞ্জিত সিংকে ওই স্থান দিয়ে দেবো, যা ওয়াহিদুদ্দীন দিয়েছিলেন। ড. মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর তামীমীর ‘শিখ মুসলিম তাআল্লুকাত’ গ্রন্থকে কিভাবে উপেক্ষা করবেন, যেখানে সন্নিবেশিত অধিকাংশ তথ্যের উৎস হচ্ছে শিখ লেখকদের গ্রন্থাবলি। এ গ্রন্থ কয়েক বছর আগে সিনেটর ফর সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ইউনিভার্সিটি অব পাঞ্জাব, লাহোর প্রকাশ করেছেন। আর এ গ্রন্থ পাকিস্তানের প্রতিটি রাজনীতিবিদ, প্রতিটি সাংবাদিক ও প্রতিটি সেনা অফিসারসহ সব আমলা আর রাষ্ট্রদূতদের পড়া উচিত। এ গ্রন্থটির নামপত্রে পাক-ভারত উপমহাদেশের কাদেরিয়া সিলসিলার আমির শিখ জাতির আধ্যাত্মিক পৃষ্ঠপোষক হজরত মিয়া মীর রাহ.-এর নাম রয়েছে। এ গ্রন্থে শিখ ও মুসলমানদের মাঝে কিছু ঐতিহাসিক ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। আল্লামা ইকবালের ভাষায় বাবা গুরুনানকের প্রশংসা করা হয়েছে, যা গ্রন্থটির ৩২৯ পৃষ্ঠায় অলঙ্কৃত হয়ে আছে।
ফের উঠি আখের সেদা তাওহিদ কি পাঞ্জাব সে/হিন্দ কো এক মারদে কামেল নে জাগায়া খাব সে- অর্থাৎ এরপর পাঞ্জাব থেকে শেষ তাওহিদের আওয়াজ উঠল/এক কামেল ব্যক্তি ঘুম থেকে ভারতকে জাগালেন।
অপর দিকে ড. মুহাম্মাদ জাহাঙ্গীর তামীমী ফকির সায়্যিদ ওয়াহিদুদ্দীনের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন যে, রঞ্জিত সিং ধর্মীয় উদারতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি লিখেছেন, যদি রঞ্জিত সিং ধর্মীয় উদারতায় বিশ্বাসী হতেন, তাহলে আজান ও গরু জবাই করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেন না। সায়্যিদ আহমদ শহীদ রাহ. ইউপি, বাংলা ও বিহার থেকে মুসলমানদের কাফেলা নিয়ে জিহাদের জন্য পাঞ্জাব আসতেন না এবং সিন্ধু, হাজারা ও কাশ্মিরের মুসলমানরা তাকে সঙ্গ দিত না। রঞ্জিত সিং মহারাজা গুলাব সিংকে জম্মুতে শাসক বানিয়ে দেন এবং তার মাধ্যমে লাদাখ পর্যন্ত পৌঁছে গেলেন। অবশেষে ওই গুলাব সিং পুরো কাশ্মির দখল করে নিয়েছেন। তামীমী সাহেব শিখদের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় কায়েদে আজমের শিক্ষার খুবই গুরুত্ব দিয়েছেন। আমাদের এ নিষ্প্রয়োজনীয় বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসা উচিত। পাকিস্তানে বসবাসরত সব হিন্দু, শিখ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিমকে আমাদের ভাই মনে করা উচিত। আর যদি কোনো শিখকে বাস্তবিকই নিজেদের হিরো বানাতে হয়, তিনি হচ্ছেন ভগত সিং; যাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য লাহোরে ফাঁসি দিয়েছিল। ভগত সিং শুধু পাঞ্জাবিদের নয়, বরং বিশ্বজুড়ে ‘বিপ্লবীদের হিরো’।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২২ জুন,
২০২০ সংখ্যা থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)