একটি ফতোয়া নিয়ে বিভ্রান্তি
একটি ফতোয়া নিয়ে বিভ্রান্তি - ছবি : সংগৃহীত
প্রায় দুই শ’ বছর ধরে উপমহাদেশে একটি কথা ছড়িয়ে রয়েছে। তা হলো আলেমরা ইংরেজি ভাষা শেখা হারাম মর্মে ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু ফতোয়াটির উৎস বা সূত্র কেউ উল্লেখ করেন না, অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেন না। ফতোয়াটি কে দিয়েছিলেন, সেটি কোথায় আছে, তার কোনো পাত্তা নেই। কেউ কথাটি বাতাসে ছেড়ে দিয়েছে। আর জনসাধারণ তা বিশ্বাস করে আলেমদের প্রতি বিরূপ ধারণা পোষণ করে রেখেছে। এমনকি বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ তো অনুসন্ধান বা যাচাই ছাড়াই নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছেন যে, শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহ: ইংরেজি শিক্ষা হারাম বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।
অথচ স্যার সাইয়েদ আহমদ খান আলীগড় কলেজ ও পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়ার সময় নিজের কাজের যৌক্তিকতার পক্ষে উল্লেখ করেছিলেন যে, শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিছে দেহলবী রহ: ইংরেজি শিক্ষা করার পক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন। কিন্তু স্যার সাইয়েদ আহমদ এ ফতোয়ার সূত্র উল্লেখ করেননি। উল্লেখ্য, স্যার সাইয়েদ আহমদ খান ছিলেন দিল্লি কলেজের ছাত্র, যে কলেজের প্রধান শিক্ষক ছিলেন মাওলানা মামলুক আলী। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সাইয়েদ আহমদ খান ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসেম নানুতবি উভয়ের উস্তাদ ছিলেন মাওলানা মামলুক আলী রহ:। আর মাওলানা মামলুক আলীর উস্তাদ ছিলেন মাওলানা রশিদুদ্দীন খান, যিনি ছিলেন হজরত শাহ আবদুল আজিজ রহ:-এর বিশিষ্ট শিষ্য। অতএব হজরত শাহ আবদুল আজিজ রহ:-এর ফতোয়া সম্পর্কে ভালোভাবে জানা থাকার কথা স্যার সাইয়েদ আহমদ খানের। প্রকৃতপক্ষে ফতোয়াটি রয়েছে ফতোয়ায়ে আজিজিয়ার পরিশিষ্টে। তাতে রয়েছে-
বোখারার বাদশাহ কয়েকটি প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন হজরত শাহ আবদুল আজিজের কাছে। একটি প্রশ্ন ছিল ইংরেজি ভাষা শেখা নিয়ে। জবাবে তিনি ফার্সিতে লিখেছিলেন- তা’লিমে ইংরেজি ইয়া’নি আইনে খত ও কিতাবাত ও লুগাত ও ইস্তেলাহাত- ইহারা দানেস্তন বাকে নাদারদ অর্থাৎ ইংরেজি লিপি ও লেখার নিয়ম, শব্দ ও ভাষা ইত্যাদি শেখায় কোনোই দোষ নেই। (পৃষ্ঠা ১৯৫, মুজতাবাই মুদ্রণ)
আরেক বিখ্যাত আলেম আল্লামা আবদুল হাই ফিরিঙ্গি মহল্লি (মৃত্যু ১৮৮৬ খ্রি.) এর ফতোয়া প্রায় একই ধরনের। তিনি বলেন, বস্তুত নিছক ইংরেজি শেখা শরিয়তের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ নয়। মহানবী সা: হজরত জায়দ ইবনে ছাবেত রা:কে ইহুদিদের ভাষা শেখার আদেশ দিয়েছিলেন, যেমনটি বর্ণিত আছে তিরমিজি শরিফ ইত্যাদিতে। মেশকাত শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থে মুল্লা আলী কারী রহ: বলেছেন, শরিয়ত কোনো ভাষা শেখাই হারাম করেনি, তা সুরিয়ানি হোক বা ইবরানি, হিন্দি হোক বা তুর্কি, ফার্সি হোক বা অন্য কিছু। (মজমুয়ায়ে ফতোয়া, মাওলানা আবদুল হাই, ১/৮০)
তাহলে আলেমদের সম্পর্কে এ প্রচারণার পেছনে কি ইংরেজরা? তা হতে পারে। কারণ হজরত শাহ আবদুল আজিজ রহ:-এর একটি ফতোয়ার ফলে ইংরেজরা দুর্ভোগ পোহায় প্রায় দেড় শ’ বছর ধরে। তিনি ফতোয়া দিয়েছিলেন- ইংরেজ অধিকৃত ভারতবর্ষ দারুল হরবে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এ দেশ স্বাধীন করার জন্য চেষ্টা সাধনা জরুরি। তার এ ফতোয়ার ভিত্তিতেই তার শিষ্য সাইয়েদ আহমদ বেরেলবী ও শাহ ইসমাঈলের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল জিহাদি সংগঠন। তারা ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে কিছুকালের জন্য স্বাধীন প্রশাসনও কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু ইংরেজদের দোসরদের বিশ্বাসঘাতকতায় তা ব্যর্থ হয়ে যায়। তারপর বালাকোটের ময়দানে দুই নেতার শাহাদাতের মাধ্যমে এই আন্দোলন বিরাট ধাক্কা খায়। তবুও তাদের মুজাহিদরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পতাকা সমুন্নত রাখেন। উইলিয়াম হান্টারের ভাষায় এই মুজাহিদরা ‘দস্যু’ খেতাব পেয়েছেন। সাইয়েদ আহমদ বেরেলবীর উত্তরসূরিরাই ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং পরে তারাই দিল্লির অনতিদূরে দেওবন্দে গড়ে তোলেন বিখ্যাত দারুল উলুম। এখানকার শিক্ষাপ্রাপ্তরা সবাই হজরত শাহ আবদুল আজিজের ভাবশিষ্য, যারা কখনোই ইংরেজদের সাথে আপস করেননি।
ধূর্ত ইংরেজরা হয়তো হজরত শাহ আবদুল আজিজের ‘দারুল হরব’ ফতোয়াকে গুরুত্বহীন করার হীন উদ্দেশ্যে তার ইংরেজি শিক্ষা সম্পর্কিত ফতোয়াকে বিকৃত করে প্রচার করে। আর তা যাচাই না করেই তাতে বাতাস দেয় লর্ড ম্যাকলে প্রণীত শিক্ষানীতি অনুযায়ী গড়ে ওঠা ‘রক্ত-মাংসে ভারতীয় অথচ মানসিকতা-রুচিতে ইউরোপীয়’ শ্রেণীটি।
বস্তুত আলেমরা ইংরেজি ভাষা শিক্ষার বিরুদ্ধে কখনোই ছিলেন না। তারা সবসময় জোর দিয়েছেন ইংরেজ ও অন্যান্য পশ্চিমা জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা পদ্ধতি পরিহার করার ওপর। আর ঔপনিবেশিক শক্তি ইংরেজ, ফরাসি ও ডাচরা উপমহাদেশে ও অন্যান্য অঞ্চলে নিছক আধুনিক শিক্ষা চালু করতে চায়নি। তারা নিজেদের ভাবধারা ও জীবনপ্রণালী চাপিয়ে দিতে চেয়েছে উপনিবেশগুলোতে। এভাবেই তারা তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসন দীর্ঘায়িত করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এই দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সচেতন আলেমদের ওপর থেকে জনগণের আস্থা নষ্ট করার জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা যেসব হীন তৎপরতা চালিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ইংরেজি ভাষা ও আধুনিক শিক্ষা সম্পর্কে আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গির বিকৃত প্রচারণা।
লেখক : ইসলামিক স্কলার ও সাংবাদিক