ব্যাংকারদের দুশ্চিন্তার মধ্যে নিশ্চিন্ত ঋণখেলাপিরা
ব্যাংকারদের দুশ্চিন্তার মধ্যে নিশ্চিন্ত ঋণখেলাপিরা - ছবি : সংগৃহীত
ঋণ না পরিশোধ করেও আরো তিন মাসের জন্য ঋণখেলাপি হওয়া থেকে নিরাপদে থাকবেন ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। জুন মাস পার না হতেই আরো তিন মাসের জন্য এ সুবিধা দেয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। আগের ছয় মাসের সাথে আরো তিন মাস ঋণ আদায় না করতে পারলে ব্যাংকগুলোর আয় তলানিতে নেমে যাবে। এ জন্য অনেক ব্যাংকারই এখন দুশ্চিন্তায় আছেন। ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে অনেককে চাকরি পর্যন্ত খোয়াতে হতে পারে। কারণ, ভালো-মন্দ পারফরম্যান্সের ওপর অনেকেরই এখন চাকরি থাকা-না-থাকা নির্ভর করছে। তাই ব্যাংকারদের দুশ্চিন্তার মধ্যেও অনেকটা নিশ্চিন্তে আছেন দেশের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা।
জানা গেছে, গত মার্চ থেকে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার সীমিত পরিসরে ব্যাংকিং শুরু হয়। কিন্তু ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম একেবারেই থেমে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগেই সার্কুলার করা হয়, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কেউ ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে তাদের ঋণখেলাপি করা যাবে না। এ কারণে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও ঋণ পরিশোধে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। আবার যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি ছিলেন, তারা আরো সুযোগ পেয়ে যান। এমনিতেই ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে নানা কৌশল অবলম্বন করে বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধ না করেই কাটান। এরওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সার্কুলার দেয়ার পর তারা অনেকটা নিশ্চিন্তে কাটান। এতে সবচেয়ে সমস্যায় পড়ে যায়, দেশের ব্যাংক খাত। ব্যাংক খাতে ঋণ আদায় একেবারেই কমে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অগ্রণী ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ঋণের বড় একটি অংশই আদায় হয় না উদ্যোক্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে। তারা ব্যাংক থেকে একবার ঋণ নিতে পারলে তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না। ঋণ আদায়ের জন্য দিনের পর দিন তাদের পেছনে ঘুরেও কিস্তির অর্থ আদায় করা যায় না। এর মধ্যে কারো রাজনৈতিক পরিচয় থাকলে তো কথাই নেই। ঋণ আদায়ের জন্য বেশি জোরাজুরি করলে চাকরি খাওয়ারই হুমকি দেয়া হয়। তারা নানা কৌশলে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করে দিন পার করেন। কেউবা উচ্চ আদালতে রিট করেন। কিন্তু প্রথমে জুন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ না করলেও খেলাপি করা যাবে না, এমন সার্কুলার পাওয়ার পর তারা অনেকটা নিশ্চিন্তে আছেন। তাদের দেখে যারা নিয়মিত ঋণ পরিশোধ করতেন তারাও কিস্তি বন্ধ করে দেন। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে নগদ আদায় ব্যাপকভাবে কমে যায়। এর ফলে চলতি জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর আয়ের ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। বেশির ভাগ ব্যাংকেরই আয় কমে গেছে। ব্যাংকাররা ধরেই নিয়েছিলেন, জুনের পর সেপ্টেম্বর কোয়ার্টার ভালো যাবে। কারণ, জুলাই থেকে ঋণ আদায় না করলেই ঋণখেলাপি করা হবে। এ কারণে অনেকেই ঋণ পরিশোধ করতেন। কিন্তু জুন শেষ না হতেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগের সুবিধা আরো তিন মাস বাড়িয়ে দেয়া হয়। অর্থাৎ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঋণ আদায় না করলে ঋণখেলাপি করা যাবে না। এর ফলে ব্যাংকারদের দুশ্চিন্তা আরো বেড়ে গেছে।
বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক জানিয়েছেন, এমনিতেই ইতোমধ্যে খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে ২৫ জন শাখা ব্যবস্থাপককে বাদ দেয়া হয়েছে। তারাও এখন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। প্রধান কার্যালয় থেকে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দেয়া হয়েছে। অধীনস্থদেরকে তা বণ্টন করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণখেলাপিদের আরো তিন মাস সুযোগ দেয়ায় তারা এখন মহাদুশ্চিন্তায় পড়ে গেছেন। এমনিতেই গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ করতে চান না। এখন আরো তিন মাসের সুযোগ পাওয়ায় তারা আরো সুযোগ পেয়ে গেছেন। তাই ঋণ আদায়ের লক্ষ্যপূরণ এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সাথে চাকরির ঝুঁকিও আরো বেড়ে গেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় অনেকে ইচ্ছা করলেও ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন না। এতে ব্যাংকারদের চলমান পরিস্থিতিতে ঋণ আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে চাপ দেয়া ঠিক হবে না। তবে, যারা ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, বিশেষ করে রাঘববোয়াল ঋণগ্রহীতা রয়েছেন তাদের কাছ থেকে আদায় বাড়ানো যেতে পারে। এ জন্য একটি কৌশল বের করা প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। কারণ, ভালো-মন্দ দুই সময়েই ঋণ পরিশোধ করেন না। আবার তারা বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে জড়িত রয়েছেন। তারা ব্যাংক থেকে হয় ঋণ নিয়ে ব্যবসায় না খাটিয়ে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছেন, না হয় তারা দেশেই ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছেন। তবে, ব্যাংক থেকে রাঘববোয়ালরা ঋণ নিয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণের চেয়ে বিদেশেই পাচার করেছেন বেশি। এ কারণে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা গেলে বিদেশী ব্যাংক থেকে টাকা এনে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হবেন। এতে দেশের ব্যাংকিং খাতও বেঁচে যাবে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মহলেরই উদ্যোগ নিতে হবে।