চীন-ভারত বিবাদ ও নতুন ব্যবস্থা

গৌতম দাস | Jun 27, 2020 09:55 pm
মোদি ও শি

মোদি ও শি - ছবি : সংগৃহীত

 

অভ্যন্তরীণ গঠন কাঠামোটা পলিটিক্যাল কমিউনিটি হিসেবে গঠিত আর হলো না। এর বদলে রাষ্ট্রের বাইরের দিকে তাকিয়ে গড়া হলো। কারণ ওই কলোনি দখল ব্যবসা কোম্পানিগুলোর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ইউরোপের পড়শি রাষ্ট্রের সমতুল্য কোম্পানি- যেমন ব্রিটিশ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী হলো ডাচ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাই ব্রিটিশ কোম্পানিগুলো চাইল এই নেশন-স্টেট। যাতে সব ব্রিটিশ মানুষ ‘এক জাতির’ আওয়াজ তুলে অপরাপর ডাচ বা ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বী; কোম্পানির বিরুদ্ধে নিজ ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে বিনা-বিভক্তিতে খাড়া হয়ে যায়। দখল কোম্পানিগুলোর স্বার্থই যেন সব ব্রিটিশ নাগরিক-মানুষের স্বার্থ হয়ে যায়। এতে রিপাবলিক বলতে নেশন-স্টেট ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাওয়ায় মূলত যে দুই ক্ষতি হয়ে যায় তা হলো- এক. রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গঠন কাঠামোটা পলিটিক্যাল কমিউনিটি হওয়া সবাই শুনার ফলে এমন হওয়ার যে কথা ছিল তা হারিয়ে যায়। দুই. অন্যের দেশ কলোনি-দখল করা ও সম্পদ লুট করে আনা বৈধ হয়ে যায়। আর সবচেয়ে ভয়াবহ তৃতীয় ক্ষতিটা হলো, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে রিপাবলিক গণপ্রতিনিধিত্বের রাষ্ট্র বলতে আসলে নেশন-স্টেট রূপটাই রেনেসাঁ চিন্তার সর্বোত্তম উপহার হয়ে হাজির হয়ে যায়।

রেনেসাঁ মানে প্রগতিশীলতার নামে ‘নেশন-স্টেট’ (জাতি-রাষ্ট্র) ধারণা রামমোহন রায় ভারতে এনেছেন। কিন্তু তার বুঝের ব্রিটিশ জাতি-রাষ্ট্র বলতে একে তিনি বুঝেছিলেন, ধর্মভিত্তিক জাতির রাষ্ট্র হিসাবে। মানে ‘অ্যাংলো ক্যাথলিক ক্রিশ্চান ব্রিটিশ’ জাতি, এভাবে। কিন্তু নিজ ভারতের বেলায় এখানে দুটা বড় ধর্ম হিন্দু-মুসলমান ছাড়াও ছোট সংখ্যায় অনেক ধর্ম আছে। তাই তিনি স্বাধীন ভারত এই জাতি-রাষ্ট্র গড়তে সবার আগে সবাইকে একই একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত করতে চেয়ে ১৮১৫ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম চালু করেন। এই প্রকল্প ব্যর্থ হলে আর তিনি মারা যাবার পরে বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, অরবিন্দ ঘোষ প্রমুখের হাত ঘুরে এই প্রকল্প যেন ‘না-পারতে’ এটা এক ‘হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র’ প্রকল্প হিসাবে মানিয়ে নেয়ানোর চেষ্টা হিসেবে হাজির করেন। এটাই ১৮৮৫ সালের কংগ্রেস দলের জন্মের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসাবে হাজির হয়েছিল। বলাই বাহুল্য এটা মুসলমানদের জন্য অস্বস্তিকর। তবু তারা দীর্ঘ ২০ বছর অপেক্ষা দেন-দরবার করে নিয়েছিলেন। এরপর ১৯০৬ সালে বাধ্য হয়ে মুসলমান জাতি-রাষ্ট্র প্রকল্প হিসাবে মুসলিম লীগের জন্ম হয়ে যায়।

কিন্তু এখানে মজার ব্যাপার হলো, মুসলিম লীগ মুসলমান জাতি-রাষ্ট্র কথাটা প্রকাশ্যে উচ্চারণ করেই বলতে হয়েছিল যাতে সে মুসলমানদের এতে ডেকে আনতে পারে। আর এই সুযোগে কংগ্রেসিরা নিজেদের হিন্দু-জাতি-রাষ্ট্রের লোক- এই পরিচয় লুকিয়ে ফেলে বলতে থাকে তারা কেবল জাতি-রাষ্ট্রের লোক এবং তারা প্রগতিশীল। কারণ তারা রেনেসাঁ মানা-বুঝা লোক। এর বিপরীতে মুসলমানেরা ধর্মের রাষ্ট্র চায়, রেনেসাঁ মানে না- তাই তারা পশ্চাৎপদ। বিশেষ করে পাকিস্তান আলাদা হয়ে যাওয়ার পর জমিদার-হিন্দুরা কমিউনিস্ট হয়ে গিয়ে এই পশ্চাৎ-প্রগতির ভুয়া যুক্তিটা তুলে ধরেছিল। আর সেই সাথে জাতি-রাষ্ট্র কথাতে যে তারা ধরা পড়ে যাবে তাই জাতি শব্দটা ভেঙে এবার ‘জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র’ বলা শুরু করল; যেন এটা জাতি-রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন কোনো ধারণা।

ইউরোপের পরিণতি দেখা যাক। মূলত দু কারণে সারা ইউরোপ. (৪৭ টা রাষ্ট্রের জোট) ১৯৫৩ সালের মধ্যে জাতি-রাষ্ট্র ধারণাটা ত্যাগ করে। কারণ হলো- হিটলারের উত্থান ও তার নীলচোখের শ্রেষ্ঠ ‘জার্মান নেশন’, এই জাতগর্বের চরম বর্ণবাদী ভয়াবহতা দেখে। এটা ছিল নিজেদের জাতি-রাষ্ট্রের সবচেয়ে কদর্য ও চরম রূপ। তারা এটা থামাতে পেরে জিতেছিল আমেরিকান প্রেসিডেন্টের সহায়তা। আর দ্বিতীয় কারণ, মার্কিন সহায়তা পেতে শর্ত হিসাবে সারা ইউরোপকে দাসখত দিতে হয়েছিল যে, তারা কলোনি দখল ব্যবসা বন্ধ করে দেবে এবং কলোনিকৃত রাষ্ট্র মুক্ত স্বাধীন করে দেবে। আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট দ্বিতীয় বিশযুদ্ধ বিজয় পরবর্তী রাষ্ট্রের যে ধারণা আঁকছেন, তবে তা তিনি করছেন জাতিসঙ্ঘের রূপ কাঠামো বর্ণনা করে। সে কাঠামোটা হলো অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রের অ্যাসোসিয়েশন হিসেবে জাতিসঙ্ঘ।

এর সবচেয়ে সহজ প্রমাণ হলো আমাদের সবার পরিচিত কাশ্মির বিতর্ক। কাশ্মিরের রাজা হরি সিং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নেহরুর সাথে অন্তর্ভুক্তি চুক্তিতে (যদিও অস্থায়ী) স্বাক্ষর করেছে তাই কাশ্মির ভারতের অংশ- এই দাবি নিয়ে ব্যাপারটায় ভারতের পক্ষে রায় আনতে নেহরু জাতিসঙ্ঘের দরবারে গেলেন। খুশি তিনি, কারণ এত সহজ মামলার রায় তার পক্ষে আসবেই। এই যে আস্থা আর নেহরুর রাষ্ট্র বোঝাবুঝি এটাই প্রমাণ করে যে, জাতরাষ্ট্র-বাদী, আর জাতিসঙ্ঘের ভিত্তি কী তিনি এর কিছুই জানেন না। কখনো খেয়াল করেন নাই, বুঝতেও যান নাই। জাতিসঙ্ঘ কাশ্মিরে গণভোটে গিয়ে রায় নিয়ে সে ভিত্তিতে ফয়সালা করতে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল।

কারণ সেটাই জাতিসঙ্ঘের জন্মভিত্তি। এর মানে হলো নেহরু জাতিসঙ্ঘের জন্মভিত্তি জানতেন না, ওর জন্মভিত্তি হলো, কলোনি দখল ‘হারাম’। আর কোন ভূখণ্ড কোথায় কার সাথে যুক্ত হবে, কাদের দ্বারা শাসিত হবে, এর সিদ্ধান্ত নেবার একমাত্র এখতিয়ারÑ কোনো রাজা নয়, কোনো সম্রাট বা সুলতানও নয়। সেই সিদ্ধান্ত নেবে ওই ভূখণ্ডের বাসিন্দা জনগণ।

খেয়াল করুন কোনো, জাতিগোষ্ঠী নয়, কোনো ধর্মীয় পরিচয়ের গোষ্ঠী নয়। কোনো ‘নেশন’ নয়। আর এই যুক্তির ভিত্তিতেই জাতিসঙ্ঘ কলোনি দখল করা অবৈধ জ্ঞান করে। কাজেই রাজা-সম্রাটেরা কেউ কিছুই নয়। বাসিন্দা নাগরিকেরাই সব, তারাই ক্ষমতার উৎস। এ কারণে রাজা হরি সিংয়ের চুক্তিতে স্বাক্ষরের কোনো মূল্য নেই। তাই কাশ্মির সেকালের নেহরুর ভারতের নয়, একালে ৩৭০ ধারা বাতিল করে দিলেও তা মোদির ভারতের নয়। মোদির কাশ্মিরকে ভারতে অন্তর্ভুক্তি জাতিসঙ্ঘের চোখে অবৈধ। অর্থাৎ কাশ্মির ভূখণ্ডের বাসিন্দাদের ‘নাগরিক অধিকারই’ মূল কথা; যেটা নেহরু বোঝেন না। তিনি অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্রের সমঝদার বা বাস্তবায়ক নন। তিনি জাতি-রাষ্ট্রের শাসক ও রাজনীতিক। তিনি জাতিসঙ্ঘের জন্মভিত্তি জানতেন না বলেই কাশ্মির ইস্যুতে সাহস করে জাতিসঙ্ঘের রায় চেয়েছিলেন।

তাহলে এখন চীন-ভারত বিবাদে এসব কথার গুরুত্ব কী?
রুজভেল্ট শুধু রাষ্ট্রের ভিত্তি কী হবে তাও সবাইকে নিয়ে সে সময় ঠিক করে দিয়েছিলেন তাই নয়। তিনি রাষ্ট্রের গ্লোবাল দিক কী হবে সেটাও ঠিক করেছিলেন। আমরা এখন ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলতে আরেকটা শব্দ ব্যবহার করব। ইংরাজি ‘অর্ডার’ শব্দটা নিয়ম শৃঙ্খলা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এতক্ষণ যদি রাষ্ট্রের ভেতরের অর্ডার নিয়ে কথা বলে থাকি তবে এখন রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার, বাইরের বা পারস্পরিক সম্পর্কের নিয়মশৃঙ্খলা অর্থে অর্ডার নিয়ে কথা বলব। তাই কথাটা এখানে গ্লোবাল অর্ডার।

রুজভেল্টের আমেরিকা বিশযুদ্ধ শেষে গ্লোবাল অর্ডার কী হবে এর এক নির্ধারক হয়ে উঠেছিল। যেমন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কী হবে, কিভাবে হবেÑ এর নির্ধারক হয়ে উঠেছিল আমেরিকা। অথবা আরো সরাসরি বললে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নীতি নিয়ম, মুদ্রা কী হবে তা প্রথম প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ঠিক হয়েছিল আমেরিকার নেতৃত্বের গ্লোবাল অর্ডারে। এই অর্ডারটা খাড়া হয়ে ছিল বা আছে মূলত তিনটা প্রতিষ্ঠান জাতিসঙ্ঘ, আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকে। অবশ্য সাথে আরো কিছু অনুষঙ্গ প্রতিষ্ঠান থাকলেও এরাই মুখ্য। গত সত্তর বছর ধরে এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই আমেরিকার নেতৃত্বে গ্লোবাল অর্ডার চলে এসেছে। কিন্তু এখন ক্রমশ অন্তত অর্থনৈতিকভাবে চীন আরো প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে উঠে আসছে। ফলে এবার চীনের নেতৃত্বের এক গ্লোবাল অর্ডার একে বদলে ফেলতে উঠে আসছে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us