ভারতকে যে শিক্ষাটি দিলো চীন
শি ও মোদি - ছবি : সংগৃহীত
কিন্তু এর প্রমাণ কী? এই বক্তব্যের ভিত্তি কী? প্রথমে কথাটা কিছু লক্ষণ দেখে বলাবলি শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালের দিকে। পরে আমেরিকা নিজেই সরকারি প্রতিষ্ঠান দিয়ে স্টাডি করে নিশ্চিত হয়। এর রিপোর্ট ওয়েবে পাবলিক করে দেয়া ডকুমেন্ট আর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ২০০৮ সালে। শিরোনাম ছিল ‘২০২৫ সালের দুনিয়া দেখতে কেমন হবে।’ শুধু তাই নয়, পরে এটা চালিয়ে যাওয়া হয় আরো দুটা রিপোর্টে- ২০৩০ সালে কেমন আর শেষেরটা ২০৩৫ সালে কেমন হবেÑ এভাবে। সবগুলোরই একই রেজাল্ট, আমেরিকা ডুবে যাচ্ছে চীন ভেসে উঠছে- নতুন নেতা চীন। চীনের এই নেতৃত্বের স্পষ্ট লিড শুরু হয়েছে ২০০৯ সাল থেকে।
চীনের পিছনে পিছনে আর কার অর্থনীতি উঠে আসার সম্ভাবনা আছে, এরও স্টাডি ডাটা সেখানে ছিল। এ থেকেই বুশের আমল থেকে আমেরিকা করণীয় ঠিক করে যে, ভারতের পিঠে হাত রেখে কাছে টেনে একে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে। আর তা থেকেই বাজারে ভারতের গুরুত্ব বাড়ে। এমনিতে ভারতের অর্থনীতি খুব গরিবই; বিশেষ করে অবকাঠামোগত সক্ষমতার দিক থেকে। তবুও চীনের কাছাকাছি জনসংখ্যার বলে এর পটেনশিয়াল বা সম্ভাবনা আছে এমন অর্থনীতি মনে করা হয়। ইতোমধ্যে ২০০৯ সাল থেকে পালটা চীনের নেতৃত্বে আই এমএফ এবং বিশ্বব্যাংক ধরনের কিন্তু নতুন প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্রিকস ব্যাংক জন্ম নেয়। ভারত সেখানে যুক্ত হতে অফার পেলে যোগ দেয়। চীনও তার বিনিয়োগ সক্ষমতা থেকে ভারতের চাহিদামতো ঋণ বিশেষত অবকাঠামোগত ঋণ প্রদান করে থাকে। কিন্তু ততই আমেরিকার কাছে ফিরে ফিরে যাওয়ার ঝোঁক তার বাড়তেই থাকে। যদিও ট্রাম্প আমলে এসে আমেরিকা মনে করে, ভারতকে চীনের পেছনে লাগানো বৃথা। কারণ এটা তেমন কোনো ফলদায়ক নয়।
কিন্তু ভারতের আচরণ এমন হয়ে যায় যে, সে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে থাকে যে, সে যেন চীন ও আমেরিকার মাঝে দুটার সাথে প্লে করে দু’জনের থেকেই নিজের সুবিধা আদায় করে চলতে পারবে। চীন সেই অতিরিক্ত বা অতিরিক্ত আত্মবিশাসী মোদির ভারতকে নিজ প্রকৃত সক্ষমতার দিকে হুঁশ ফিরিয়ে নজর করিয়ে দেয়।
ব্যাপারটা অনেকটা কাউকে মারধর দেয়ার পরে আবার বুঝিয়ে দেয়া যে কাঁদলে আবার মার খাবি। কথিত বিশ ভারতীয় সেনা মারা যাওয়ার পর চীন সাবধান করে দেয় যেন নতুন টেনশন বারবার সৃষ্টির চেষ্টা না করে। তাই শেষে মোদির সবল অবস্থান যে ‘কেউ ভারতের মাটিতে আসেনি’। খুব সম্ভবত ভারতকে সামরিকভাবে আরো হেস্তনেস্ত করবে আর বাণিজ্যিক সম্পর্ক ত্যাগ করলে ভারতের ক্ষতি শুধু নয়, টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যাবে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া থেকেই মোদির এমন সিদ্ধান্ত- ‘কেউ ভারতের মাটিতে আসে নাই।’
কিন্তু ভারতের কেন এমন হলো
ভারতের কোনো রাজনীতিক বা একাডেমিক নীতিনির্ধারক পুরা ইস্যুটাকে গ্লোবাল অর্ডারের দিক থেকে দেখেননি। এর ওপর আছে ভারত মানেই আসলে এক নেশন-স্টেট ভাবনায় ভারত। যেটা আবার অসম্ভব এক স্বদেশী ধারণার অর্থনীতি ভাবনাও।
যদি প্রশ্ন করা যায় গ্লোবাল অর্ডার নিয়ন্ত্রণের লিডার প্রশ্নে ভারত কার সাথে থাকতে চায়- আমেরিকা না চীন? এখন পর্যন্ত ভারতের আচরণ থেকে এর জবাব হলো ভারত জানে না। অথচ এর সহজ জবাব হবে আমেরিকার বিরুদ্ধে এবং সেটা এজন্য যে, আমেরিকা যার যুগ শেষ হয়ে যাচ্ছে, সে ক্ষয়িষ্ণু শেষ হয়ে যাচ্ছে- তাই সে দুনিয়ার অতীত নেতা; বিপরীতে ভারত নিঃসন্দেহে নিজেই প্রধান নেতা হতে চায় অথবা অন্ততপক্ষে আগামী নেতা চীনের প্রধান সহযোগীর ভূমিকায়। এসবের বাইরে অন্য কিছু তো হতে পারে না। তাহলে সে বারবার অতীত মানে আমেরিকার ভেতর আশ্রয় খুঁজছে কেন, তাকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চাইছে কেন?
এর জবাব ভারতের কাছে নেই। কেন নেই?
মূল কারণ, গ্লোবাল দিকটা সে বুঝতেই পারে না। মূল কারণ, হিন্দুত্ববাদী জাতি-রাষ্ট্র বুঝের লোক।
যেমন আমাকে একজন বলছিল, পাকিস্তান যদি চীন ও আমেরিকার সাথে একই সাথে সম্পর্ক রাখতে পারে তাহলে ভারতও চীন ও আমেরিকার সাথে একই সাথে সম্পর্ক রাখলে সেটা দোষের হবে কেন?
প্রথম কথা, আমরা গ্লোবাল অর্ডার নিয়ন্ত্রণকদের সহযোগী (মূল নেতার সাথে প্রভাবশালী ভূমিকায়) কেউ একজন হওয়ার প্রসঙ্গে কথা বলছি। স্রেফ দুটা রাষ্ট্রের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখা না রাখার নয়। পাকিস্তান গ্লোবাল অর্ডার নিয়ন্ত্রণকারীদের কেউ নয়, সহযোগী হয়ে ওঠার তালিকাতেও কেউ নয়। পাকিস্তান অর্থনীতিগতভাবেও তেমন কোনো শক্তিমালী দেশ নয়। তাই বলছি গ্লোবাল অর্ডার বা এর নিয়ন্ত্রক বলতে কী বুঝিয়েছি সেটা আমল করাই হয় নাই, এই প্রশ্নের মধ্যে। অর্থাৎ এই প্রশ্নকর্তা যেন ভারত নিজেই!
হিন্দি-উর্দুতে একটা কথা আছে- আওকাত দেখা দিয়া। মানে কারও বাস্তব মুরোদ বা স্টাটাস কি ও কেমন সেটা কোনো হামবড়া লোককে মনে করিয়ে দেয়া। চীন ভারতকে তার আওকাত মনে করিয়ে দিয়েছে; যদিও তার মিডিয়া ও বিরোধী দল পুরানা স্টাইলে এখনো ভাব দেখিয়ে যাচ্ছে!
কারো কোনো সামরিক বা অর্থনৈতিক সক্ষমতা না থাকা নিশ্চয় দোষের নয়। না থাকলে কেমন আচরণ করতে হয় সেটাই আলোচ্য। যতদিন সেটা অর্জিত না হয় ততদিন ভারত চীনের সাথে সঙ্ঘাতবিহীন সম্পর্ক রেখে বা সঙ্ঘাত এড়ানোর বুদ্ধিতে চলাই সোজা রাস্তা। আসলে চীন বুঝিয়ে দিচ্ছে মোদি তোমার হিন্দুত্ব, তোমার জাতি-রাষ্ট্রের বাইরে অবুঝ থাকা আর তোমার হামবড়া ভাবÑ এগুলো অচল! তাই এসব ছাড়তে হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক