মা-বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখা : ইসলামের দৃষ্টিতে কতটুকু বৈধ
বৃদ্ধাশ্রমের এক সদস্য - প্রতীকী ছবি
ইসলাম পিতা-মাতার অধিকার আদায়ে বদ্ধপরিকর। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সব পিতা-মাতা সন্তানের কাছে সর্বোচ্চ সদাচরণ পাওয়ার অধিকারী। যেখানে কোনো স্বার্থ বা স্বার্থপরতার ছোঁয়া নেই। মায়া, মমতা, আদর, যতœ ও নিখাদ ভালোবাসার এক অদ্ভুত চক্রে আবর্তিত এ সম্পর্ক। বৃদ্ধ অবস্থায় যখন তারা অসহায় হয়ে পড়ে, তখন তাদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়া সন্তানের দায়িত্ব।
বৃদ্ধাশ্রম হলো মূলত বৃদ্ধ নারী-পুরুষের আবাসস্থল। গরিব, দুস্থ, সহায় সম্বলহীন, সন্তানহারা বৃদ্ধদের শেষ জীবনে বিশেষ সেবা প্রদান করার জন্য বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হলেও বর্তমানে এর বহুমাত্রিক অপব্যবহার হচ্ছে। সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের লজ্জাজনক প্রতিচ্ছবি এই বৃদ্ধাশ্রম। অশিক্ষিত, শিক্ষিত, চাকরিজীবী অনেক সন্তান নিজের কাছে পিতা-মাতা রাখার প্রয়োজন বোধ করেন না। কখনো কখনো অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করেন যেন তারা নিজেরাই ভিন্ন কোনো ঠাঁই খুঁজে নেন। বস্তুবাদী চিন্তা চেতনা ও নিউক্লিয়ার পারিবারিক ব্যবস্থার কারণে এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।
পিতা-মাতা শব্দটির মাঝে লুকিয়ে আছে অনেক মায়া-মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা। তারা এ পৃথিবীতে মানুষ আগমনের মাধ্যম। শত কষ্ট বেদনা উপেক্ষা করে যারা সন্তানের কল্যাণ কামনায় অহর্নিশ অতিবাহিত করেন। প্রতিটি সন্তান তাদের অকৃত্রিম স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসায় বেড়ে ওঠে।
যেকোনো পরিবারে শিশু, নারী, বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তিরা সবচেয়ে অসহায় ও দুর্বল। ইসলাম তাদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে। বিশেষ করে পিতা-মাতার অধিকার আদায়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছে। সাময়িক ও চটকদার সমাধান ইসলামের কাম্য নয়।
আল্লাহর ইবাদতের পরেই পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করা অত্যাবশ্যক। মহান আল্লাহ বলেন, আপনার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন তিনি ছাড়া আর কারো ইবাদত না করতে এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করতে। তাদের মধ্যে একজন অথবা তারা দু’জনই বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের উফ পর্যন্ত (বিরক্তিসূচক কোনো শব্দ) তোমরা বলবে না, তাদেরকে ধমক দিও না, তাদের সাথে সম্মানসূচক কথা বলো। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৩) অত্র আয়াতে সদাচরণের ক্ষেত্রে বৃদ্ধ অবস্থাকে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।
বৃদ্ধ অবস্থায় পিতা-মাতা শিশুর মতো আচরণ করে। তারা অনেক সময় সন্তানের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কুরআন এসেছে, ‘তাদের জন্য বাহু বিছিয়ে দাও। তাদের জন্য প্রার্থনা করে বলো, হে আমাদের প্রতিপালক আমার পিতা-মাতার উপর দয়া করুন যেভাবে শৈশবে তারা আমার উপর দয়া করেছিলেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল :২৪)
কুরআনের অন্যত্র তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশার্থে সদাচরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদাচরণের নির্দেশ দিয়েছি। তার মা তাকে অসীম কষ্ট সহ্য করে গর্ভে ধারণ করে, আর তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। কাজেই তোমরা আমার প্রতি এবং তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও।’ (সূরা লোকমান: ১৪)
শুধু তাই নয়, ইসলাম তাদের উভয়ের খেদমত করার মাধ্যমে জান্নাত লাভের উপায় বর্ণনা করেছে। আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসে রাসূল সা: বলেন, সে ধ্বংস হোক, সে ধ্বংস হোক, সে ধ্বংস হোক, জিজ্ঞাসা করা হলো কে ধ্বংস হবে হে আল্লাহ রাসূল! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি তার মাতা-পিতার দু’জনকে অথবা একজনকে বৃদ্ধ অবস্থায় পেলো কিন্তু তাদের সেবা করে জান্নাতে যেতে পারল না। (সহিহ মুসলিম)
তাদের উভয়ের সন্তুষ্টির মাঝে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি নিহিত। হাদিসে এসেছে, রাসূল সা: বলেন, পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং তাদের অসন্তুষ্টির মধ্যে আল্লাহর অসন্তুষ্টি নিহিত। (সুনানে তিরমিজি)
এমনকি পিতা-মাতা অমুসলিম হলেও তাদের সাথে সদাচরণের কথা ইসলামে বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা রা: ইসলাম গ্রহণের পর তার মা কর্তৃক অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছিলেন। তখন মায়ের সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবেন তা জিজ্ঞেস করলে রাসূল সা: বললেন, অবশ্যই তোমাকে তার সাথে সদাচরণ করতে হবে। তাছাড়া, রাসূল সা:-এর কাছে দুধ-মা হালিমা এলে তিনি তার সম্মানে নিজের গায়ের চাদর বিছিয়ে দিতেন।
পাশ্চাত্য সভ্যতায় পারিবারিক কাঠামো নেই। সেখানে অ্যাডাল্ট নারী-পুরুষ লিভ টুগেদারে ব্যস্ত। সন্তানরা পিতা-মাতার পরিচয়ে পরিচিত হয় না। ফলে বাধ্য হয়ে বয়স্করা ওল্ড হোমকে নিজেদের আশ্রয়স্থল হিসেবে বেছে নেয়। আজ তারা বিভিন্ন দিবস প্রণয়নের মাধ্যমে তাদের মানবিকতার বহুল প্রচার ও প্রসার করতে প্রয়াস চালাচ্ছে। ঘোষণা করেছে পৃথকভাবে মা ও বাবা দিবস। শুধু এসব দিবসেই তারা পিতা-মাতার খোঁজখবর নেয়।
ইসলামে কোনো দিবস পালনের মাধ্যমে পিতা-মাতাকে সম্মান জানানোর প্রয়োজন নেই। প্রতিটি পরিবার প্রতিটি ক্ষণে তাদের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানায়। আজকে এলিট শ্রেণী পাশ্চাত্যের আদলে আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রম গড়ে তুলছে। বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবাকে পাঠানো ইসলামের নির্দেশনার সাথে সাংঘর্ষিক। অথচ এ ধরনের সমাজেই আবার খুব জোরেশোরে মা দিবস ও বাবা দিবস নামে বিশেষ দিন পালন করেছে, যা রীতিমতো প্রতারণার শামিল।
তাই পশ্চিমাদের মতো ছেলে বা মেয়ে স্বাবলম্বী হলেই পিতা-মাতাকে ত্যাগ করবে। পিতা-মাতাকে আলাদা রেখে নিজে আলাদা থাকবে, এটা প্রত্যাশিত নয়। পিতা-মাতা বৃদ্ধ হলে তার দেখাশোনা করার সামাজিক দায়ভার সন্তানকেই নিতে হবে। তাই পশ্চিমাদের ওল্ড হোম সংস্কৃতি আমাদের জীবনধারায় প্রযোজ্য নয়।
সন্তানের দায়িত্ব হলো পিতা-মাতার অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া, তাদের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা করা সর্বোপরি তাদের প্রতি সদাচরণ করা।
লেখক : বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক