চীনা বিশ্লেষক : যুক্তরাষ্ট্রের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে ভারত!
চীনা বিশ্লেষক : যুক্তরাষ্ট্রের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছে ভারত! - ছবি : সংগৃহীত
২২ জুন দ্বিতীয় দফায় বৈঠকে বসেছিলেন চীন ও ভারতের কোর কমান্ডাররা। তবে গালওয়ান উপত্যকায় ১৫ জুনের সংঘর্ষের পর দুই দেশের উচ্চ পর্যায়ের সামরিক নেতাদের মধ্যে এটাই প্রথম বৈঠক।
বৈঠকের ব্যাপারে চীনের মনোভাব ইতিবাচক। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, বৈঠকে দুই পক্ষই আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও উত্তেজনা কমিয়ে আনার ব্যাপারে তাদের মনোভাব প্রকাশ করেছে।
বৈঠকে প্রথম কোর কমান্ডার বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বর্তমান সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি নিয়ে খোলামেলা ও বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং উভয় পক্ষ পরিস্থিতি শান্ত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে রাজি হয়। তারা সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও প্রশান্ত জোরদার করতে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া ও একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারেও অঙ্গীকার করে।
কিন্তু ভারতীয় মিডিয়া একে নেতিবাচক হিসেবে তুলে ধরে বলে যে খুবই কঠিন একটি বৈঠক হয়েছে কোর কমান্ডারদের, যা ১১ ঘন্টা ধরে চলে।
মিডিয়ার দাবি, বৈঠকে ভারত বেশ কিছু কঠোর শর্ত দেয়। এর মধ্যে প্যাংগং লেকের উত্তর তীর থেকে চীনা সৈন্য প্রত্যাহার, চীনা সৈন্যদের চীনা ভূখণ্ডের আরো ভেতরে নিয়ে যাওয়াও রয়েছে। ভারতীয় মিডিয়ার আরো দাবি, তাদের সেনাবাহিনী সর্বাত্মক-যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত—এমন কথাও নাকি বলা হয়েছে। তাছাড়া অচলাবস্থা দেখা দিলে চুক্তি অনুযায়ী কোনো পক্ষ আগ্নেয়াস্ত্র বা ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করবে না বলে যে চুক্তি রয়েছে তাও নাকি ভারতীয়রা মানবে না। যেভাবে খুশি চীনাদের মোকাবেলা করার ‘পূর্ণ ক্ষমতা’ নাকি ফিল্ড কমান্ডারদের দেয়া হয়েছে, এমনও দাবি করে ভারতীয় মিডিয়া।
কিছু মিডিয়া আরো বলে যে পশ্চিম সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনী শক্তি বাড়িয়ে চলেছে।
তবে কোর কমান্ডারদের বৈঠকের পর উত্তেজনা কমবে কিনা, গালওয়ান উপত্যকায় সামরিক সংঘাতের সমস্যা মিটবে কিনা সেটা নির্ভর করবে ভারত সরকারের পরবর্তী সিদ্ধান্ত ও ভারতীয় সেনবাহিনীর পরবর্তী কার্যক্রমের উপর।
আসলে লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের (এলএসি) পশ্চিমাংশ নিয়ে তেমন কোন বিরোধ নেই। চীন বলছে এলএসি প্যাংগং হ্রদের দক্ষিণ তীর দিয়ে গেছে, আর ভারতের দাবি হ্রদের মাঝ বরাবর গেছে। এলএসি হ্রদের উত্তর তীর দিয়ে গেছে—একথা ভারত কখনোই বলেনি।
এলএসির চীনা অংশে গালওয়ান উপত্যকা, যেখানে সবসময়ই চীনের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিলো। ওই এলাকায় বছরের পর বছর ধরে দুই পক্ষের সেনারা সহাবস্থান করেছে।
গালওয়ান উপত্যকায় গুরুতর সামরিক অচলাবস্থা ও হতাহতের কারণে হলো বহু বছরের চুক্তি ভঙ্গ করে ভারতীয়দের গ্রহণ করা একতরফা ব্যবস্থা।
সংবিধানে জম্মু-কাশ্মিরের মর্যাদা পরিবর্তন
২০১৯ সালের আগস্টে ভারত সংবিধান পরিবর্তন করে অধিকৃত জম্মু-কাশ্মির অঞ্চলের রাজ্য মর্যাদা বাতিল করে একে দুটি কেন্দ্রশাসিত ভূখণ্ডে পরিণত করে। এগুলো হলো: জম্মু-কাশ্মির ও লাদাখ। কেন্দ্র শাসিত লাদাখ ভূখণ্ডে চীনের নিয়ন্ত্রিত বিশাল অঞ্চলকেও অন্তর্ভুক্ত করে দেখানো হয়।
ভারতের কর্মকাণ্ড শুধু চীন-ভারত সীমান্তে শন্তি ও প্রশান্তিই শুধু নষ্ট করেনি, দক্ষিণ এশিয়াতেও উত্তেজনা বাড়িয়ে দিয়েছে।
মে মাসের শুরু থেকেই গালওয়ান উপত্যকায় সামরিক সংঘাত দেখা দেয়। এই সমস্যা সহজেই মেটানো যায় এভাবে : ভারতীয় সেনারা তাদের মূল জায়গায় ফেরত যাবে, আর কখনো আসবে না।
৬ জুন, সামরিক নেতাদের বৈঠকে দুই পক্ষ একটি সমঝোতায় আসে। কিন্তু সেই চুক্তি ভঙ্গ করে ১৫ জুন ভারতীয় সেনারা চীনা সেনাদের উপর আঘাত হানে। চীনারা পাল্টা আঘাত হানলে নাজুক অবস্থায় থাকা ভারতীয় সেনারা দ্রুত পালাতে চেষ্টা করে। অন্ধকার রাতে তারা দুর্ঘটনাবশত গালওয়ান নদীতেই ঝাপ দেয় এবং ডুবে মরে। সীমান্ত রক্ষীদের জীবন মূল্যবান। চীনরা কখনোই এ ধরনের ট্রাজেডি দেখতে চায়নি।
এই ভয়ানক ঘটনা থেকে ভারত শিক্ষা নেবে এবং বটমলাইন স্পর্শ করবে না বলে আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি। চীনারা তাদের ভৌগলিক সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ভারতীয় সেনারা আবারো যদি গালওয়ান উপত্যকায় অভিযান চালায় তাদেরকে আবারো তাড়িয়ে দেবে চীনা সেনারা। ১৫ জুনের ঘটনা দেখিয়ে দিয়েছে ভারতীয়রা চীনা সেনাদের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার অবস্থায় নেই। একই ঘটনা ঘটলে আবারো ভারতীয়রা ব্যর্থ হবে। তাহলে ঝুঁকি নেয়ার দরকার কি?
কৌশলগত সংযম দেখাতে হবে ভারতকে
বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুই দেশ ভারত ও চীন। দুই দেশের অভিন্ন ইতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। তারা উভয়েই আঞ্চলিক ও বিশ্বশক্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ উদীমান বাজার অর্থনীতি। দুই দেশই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জাতীয় পুনরুজ্জীবনের ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সাম্প্রতিক সময়ে চীন ও ভারতের নেতারা দুবার অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে বসে সহযোগিতা ও বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতায় পৌছেন। সীমান্ত সমস্যার সুরাহা না হওয়া এবং মাঝে মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়ার পরও দুই দেশের সম্পর্কের মূল ধারায় বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতা বিরাজ করছে সবসময়।
গালওয়ান উপত্যকায় অচলাবস্থা দেখা দেয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে তিনি চীন ও ভারতের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে আগ্রহী। কিন্তু ভারত এই আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলে যে, সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের সমস্যা মেটানোর মতো ক্ষমতা দুই দেশের রয়েছে।
এতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে নরেন্দ্র মোদির প্রশাসনের মনোভাব। তারা পরিস্থিতির অবনতি চায় না, দ্রুত পরিস্থিতি শান্ত করতে চায়, সীমান্ত সমস্যাকে আন্তর্জাতিক রূপ দিতে আগ্রহী নয়, বরং কৌশলগত আত্ম-নিয়ন্ত্রণ নীতি অনুসরণ করতে আগ্রহী।
মার্কিনিদের ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে
আমি লক্ষ্য করেছি যে গালওয়ান উপত্যকায় সামরিক অচলাবস্থার ব্যাপারে মার্কিন মিডিয়া বিশেষভাবে আগ্রহী। তারা মরিয়া হয়ে চীন ও ভারতের মধ্যে বৈপরিত্য ও মতবিরোধ তালাশ করছে। সেগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে প্রচার করছে, যেন চীন ও ভারতের মধ্যে শত্রুতা পুরোদস্তুর যুদ্ধে রূপ নেয়।
উত্তেজনা দেখা দেয়ার পর মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রকাশ্যে এর জন্য চীনকে দায়ি করেন। বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ভারতের সঙ্গে একটি চীন-বিরোধী অংশীদারিত্ব গড়ে তুলতে। পাশাপাশি কিছু ভারতীয় মিডিয়া ও ভাষ্যকারও আগ বাড়িয়ে পরামর্শ দেন যেন চীনকে যৌথভাবে মোকাবেলার জন্য নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলতে পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনে।
চীনের সঙ্গে বিরোধের কারণে সম্প্রতি ভারতে জাতীয়তাবাদী মনোভাব চাঙ্গা হয়েছে। ভারতের কোন কোন জায়গায় চীনা পণ্য বয়কটের চেষ্টা চলছে। কিছু কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠান চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা স্থগিত করেছে।
এটা মার্কিনীদের জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিকে দিকভ্রষ্ট করা ও ভারতকে তার চীন-বিরোধী শিবিরে প্রবেশ করানোর সুযোগ। এখন ভারতকে আরো প্রলোভন দেখাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং নয়া দিল্লি যেন ওয়াশিংটনের চীন-বিরোধী নীতির পেছনে ছোটে সেই চেষ্টা করবে।
উপসংহার
ভারতের জন্য, আমেরিকা অনেক দূরে, আর চীন প্রতিবেশী। ভারত কৌশলগত সংযম বজায় রাখবে বলে চীন আশা করে। ভারতকে কখনো শত্রু বিবেচনা করেনি চীন। তাই ভবিষ্যৎ চীন-ভারত সম্পর্কের জন্য মোদি প্রশাসনের পথ বেচে নেয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ: সে কি অতীতের মতো নিরপেক্ষ থাকবে, নাকি ‘কৌশলগত আন্ত:নিয়ন্ত্রণের অধিকার’ বজায় রাখবে?
ভারতের ব্যাপারে চীন যখন সিদ্ধান্ত নেবে সেখানেও এগুলো হবে মূল বিবেচ্য বিষয়- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : ভিজিটিং প্রফেসর, সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অফ পলিটিক্যাল সাইন্স অ্যান্ড ল)
সূত্র : এসএএম