সিঙ্গাপুর-কানাডার বৈধ প্রধানমন্ত্রীদের কাণ্ড
সিঙ্গাপুর-কানাডার বৈধ প্রধানমন্ত্রীদের কাণ্ড - ছবি : সংগৃহীত
পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে সচরাচর ‘আদি ও আসল’ শব্দটি ব্যবহার করা লাগে কি না তা বলতে পারব না। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অনাদিকাল থেকেই ‘আদি ও আসল’ কথাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। যারা ওই শব্দ দু’টি ব্যবহার করেন তারা যে খুব একটা শখ করে এমনটি করেন, তা কিন্তু নয়। নিতান্ত ‘ঠেলা’য় পড়ে তাদের আদি ও আসল শব্দগুলো ব্যবহার করতে হয়। কারণ হলো- আমাদের দেশে নকল করার প্রবৃত্তি রয়েছে- যার কারণে কোনো একটি পণ্য যদি গুণগতমানে জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় তবে রাতারাতি পণ্যটি নকল করার জন্য একশ্রেণীর মানুষ উঠেপড়ে লাগে। নকল করার পাশাপাশি ভেজাল মেশানো এবং আরো সব প্রতারণামূলক কুকর্ম দিয়ে কিছু লোক গুণসম্পন্ন জনপ্রিয় পণ্য এবং পণ্যের উৎপাদকের সুনাম সুখ্যাতি নষ্ট করার জন্য যেভাবে অপতৎপরতা চালায়, তা কেবল বঙ্গ দেশেই সচরাচর দৃশ্যমান। ফলে মূল পণ্যের উৎপাদকেরা যখন দেখেন তাদের পণ্যকে নানাভাবে নকল করা হচ্ছে, তখন পিঠ বাঁচানোর জন্য নিজেদের পণ্যের গায়ে ‘আদি ও আসল’ সংযোজন করতে বাধ্য হন।
পণ্যসামগ্রী ছাড়াও এ দেশের মানুষ আরো অনেক কিছু নকল করতে সিদ্ধহস্ত। বংশমর্যাদা, ব্যক্তিগত নাম-পোশাক পরিচ্ছদ থেকে শুরু করে কণ্ঠস্বর নকলের যে হিড়িক আমরা সচরাচর দেখি, এ কারণে আদি ও আসল শব্দের সিলমোহর না থাকলে লোকজন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। সিঙ্গাপুর এবং কানাডা বর্তমান জমানার বিস্ময়কর দুটো রাষ্ট্র। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বর্ণিত উত্তম রাষ্ট্রের যাবতীয় বৈশিষ্ট্য যদি আপনি বাস্তবে দেখতে চান তবে আপনাকে অবশ্যই সিঙ্গাপুর অথবা কানাডা যেতে হবে। রাষ্ট্র দু’টি সুদীর্ঘকাল ধরে তাদের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা এবং ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এমন যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, যার ফলে সেখানকার মানুষজনের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্যসব প্রাণী, বৃক্ষলতা, নদ-নদী প্রভৃতি সভ্য হওয়ার পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে যাচ্ছে।
সিঙ্গাপুর আর কানাডার অভাবনীয় সফলতা এবং সুনাম-সুখ্যাতির কারণে অনেক দেশই তাদের অনুকরণ করতে চাচ্ছে। কিন্তু অনুকরণ ও অনুসরণের জন্য ব্যক্তির চিন্তাচেতনায় যে সততা এবং কর্মে যে একনিষ্ঠ পরিশ্রম দরকার তা না করার কারণে সিঙ্গাপুর-কানাডা তো দূরের কথা সংশ্লিষ্ট দেশ দু’টির অপভ্রংশ, অর্থাৎ নকলনবিস হওয়ার সক্ষমতাও কেউ অর্জন করতে পারেনি। আদি ও আসল সিঙ্গাপুর-কানাডার গণতন্ত্র, গণমানুষের অধিকার, রাজনৈতিক নেতাদের সততা ইত্যাদির সঙ্গে যদি আপনি তাদের অপভ্রংশের তুলনা করেন, তবে খুব সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন, আসল ও নকলের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো কোথায়।
আসল সিঙ্গাপুর-কানাডার লোকজন কোনো দিন ভোটডাকাতির কথা শোনেনি। শেয়ার মার্কেটের জালিয়াতি, ব্যাংক থেকে আমানত লোপাট অথবা রাজনীতিবিদদের সাথে চোর-ডাকাতদের দহরম মহরমের কথা কোনো দিন শোনেনি। জনগণ স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারে না যে, তাদের নেতা তাদের সাথে মিথ্যা কথা কলবেন অথবা প্রতারণা করবেন। জনগণের করের টাকা রাষ্ট্রীয় মদদে লুটেরাদের পকেটে চলে যাবে এবং লুটেরারা ইচ্ছেমতো সেই টাকা দেশ-বিদেশের ক্যাসিনোতে খরচ করবে অথবা ভোগবিলাসে ব্যয় করবে। সেখানকার জনগণ সত্যিকার অর্থেই রাষ্ট্রের মালিক। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা রাষ্ট্রের সেবক এবং সরকার পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের সেবক। যারা রাষ্ট্রের কর্মচারী এবং যারা জনগণের প্রতিনিধি তাদের মধ্যে কোনো দিন কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট সৃষ্টি হয় না। উভয়েই নিজ নিজ অবস্থানে থেকে রাষ্ট্রের এবং জনগণের স্বার্থ রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন।
মূল সিঙ্গাপুর-কানাডার প্রধানমন্ত্রী হতে হলে একজন মানুষকে কী ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হয় তা যদি অনুধাবন করতে চান তবে সিঙ্গাপুরের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী লি এবং কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর জন্ম, বেড়ে ওঠা, শিক্ষা-দীক্ষা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং প্রধানমন্ত্রীর পদে থেকে তারা যে বিনয়-ভদ্রতা-সততার পরাকাষ্ঠা দেখাচ্ছেন তা যদি পর্যবেক্ষণ করেন তবে দেশ দুটির আদি ও আসল সভ্যতার শিকড় খুব সহজেই বের করতে পারবেন। দেশ দুটির বর্তমান ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের পিতৃপরিচয়, পারিবারিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন, সততা ও মেধার তুলনামূলক আলোচনা করলেই আপনারা বুঝতে পারবেন যে, আসল সিঙ্গাপুর ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীরা কেনো দুই নম্বরি কাজকর্ম করতে পারেন না বা তাদের মাথায় ওসব চিন্তা আসে না।
প্রধানমন্ত্রী লি এবং প্রধানমন্ত্রীর ট্রুডোর কিংবদন্তি পিতা যথাক্রমে লি কুয়ান ইউ এবং পিয়েরে ট্রুডো তাদের সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার পাশাপাশি সর্বোচ্চ নৈতিক ও আদর্শিক শিক্ষায় নিজ নিজ সন্তানদের শিক্ষিত করে তুলেছেন এবং সন্তানদের চরিত্রে, আচার-আচরণে এবং চিন্তাচেতনায় সততার বীজ বপন করে জাতির সেবায় মনোনীত করার আগে নিজেরা বারবার নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, সন্তানেরা অবশ্যই জনগণের অভিশাপ কুড়াবে না এবং অনাগত দিনে তাদের বিদেহী আত্মাকে গালি খাওয়াবে না। তারা আরো নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, তাদের সন্তানদের মানসিক ভারসাম্য গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার সুশাসনের পরিপূরক এবং তারা দেশবিরোধী শক্তির সাথে মরে গেলেও আঁতাত করবে না। তাদের সন্তানরা দরদি মনের অধিকারী, মিষ্টভাষী, পরোপকারী এবং অহঙ্কারমুক্ত যারা অসৎলোকের দ্বারা প্ররোচিত বা উত্তেজিত হয় না এবং দুর্বলের ওপর অত্যাচার কিংবা অধীনস্থদের সাথে দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে না। তাদের সন্তানেরা সাহসী, ধৈর্যশীল এবং উদ্ভাবনী ক্ষমতার অধিকারী। তারা লোভী নয় এবং কোনো কিছু অবৈধ উপায়ে তাদের লাভ করার কথা কল্পনা করে না।
সিঙ্গাপুরের কিংবদন্তি প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান এবং কানাডার অত্যন্ত সফল ও জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো যখন তাদের সন্তানদের মধ্যে উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে পেয়েছিলেন ঠিক তখনই নিজ নিজ সন্তানদের নিজেদের রাজনীতির উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। ফলে ২০০৪ সাল থেকে পৃথিবীবাসী লিকে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী এবং ২০১৫ সাল থেকে জাস্টিন ট্রুডোকে কানাডার প্রধানমন্ত্রীরূপে যেভাবে দেখে আসছেন, তার সাথে সমসাময়িক দুনিয়ার অন্য কোনো সরকারপ্রধান বা রাষ্ট্রপ্রধানের তুলনা করা চলে না। উভয় প্রধানমন্ত্রী নিজেদের দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে যেভাবে দিনকে দিন জনপ্রিয় এবং মর্যাদাবান হয়ে উঠছিলেন তা চলমান করোনা সঙ্কটকালে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে।
সিঙ্গাপুর ও কানাডার প্রধানমন্ত্রীদ্বয় যেভাবে করোনা সঙ্কট মোকাবেলা করে চলেছেন তাতে তামাম দুনিয়ার মানুষের অশেষ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা দিয়ে প্রতি মুহূর্তে সিক্ত হয়ে চলেছেন। তারা উভয়েই অত্যন্ত সততার সাথে স্বীকার করে নিয়েছেন যে, করোনা নামক রোগটি অত্যন্ত ভয়াবহ যা মোকাবেলা করার মতো প্রযুক্তি, ওষুধপত্র এবং প্রয়োজনীয় ডাক্তার-নার্স তাদের নেই। দ্বিতীয়ত, করোনার ফলে তাদের দেশের জনগণের শরীর-মন এবং মস্তিষ্কে কী ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে সে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে নিয়েছেন। তারপর সেসব কথা যারা খুব ভালোভাবে লিখতে পারেন, তাদের দিয়ে একাধিক নিবন্ধ লিখিয়ে নিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে যারা আবার লিখিত স্ক্রিপ্ট হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপনা করতে পারেন তাদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছেন যে, কিভাবে বিষয়গুলো উপস্থাপন করলে জনগণের চোখে দৃষ্টিনন্দন হবে এবং হৃদয়মনে প্রশান্তি সৃষ্টি করবে। সবার শেষে আধুনিক প্রযুক্তির ভিডিও-অডিও ব্যবহার করে প্রায় প্রতিদিন তারা জনগণের কাছে হাজির হয়ে এমন কিছু বলছেন যা প্রতিটি নাগরিক অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করছে।
তারা তাদের দেশের নাগরিক, অভিবাসী নাগরিক, বিদেশী শ্রমিক কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রীদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সব সম্ভাব্য আর্থিক সুবিধা তাদের প্রয়োজন সৃষ্টি হওয়ার আগেই পৌঁছে দিয়েছেন। জনগণের খাদ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত সমস্যাগুলো যা তাদের প্রকৃতিগতভাবে প্রতি মুহূর্তে উদ্বিগ্ন করে তোলে সে বিষয়াদি প্রধানমন্ত্রীদ্বয় তাদের নিত্যকার ভাষণে যখন বারবার উচ্চারণ করে এই মর্মে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেন যে, রাষ্ট্র ও সরকার তাদের পাশে রয়েছে, তখন মানুষ শত বিপদের মধ্যেও বেঁচে থাকার প্রেরণা পেয়ে থাকে। তারা ভুয়া তথ্য অথবা বক্তব্য, মিথ্যা আশ্বাস ও প্রতারণামূলক অভিব্যক্তিবাদের মোহে তাড়িত হয়ে এ কথা বলার চেষ্টা করেন না যে, আমি এটা করলামÑ আমার বাবা ওটা করেছিলেন কিংবা আমার দলের লোকজন এটা-ওটা করছে।
প্রধানমন্ত্রী লি এবং প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর সফলতা ও জনপ্রিয়তার মূল চাবিকাঠি হলো তাদের ব্যক্তিগত সততা এবং সরলতা। বিনয়-ভদ্রতা এবং সৌজন্য তাদের স্বাভাবিক সৌন্দর্যকে আরো মোহনীয় ও স্মরণীয় করে তোলে। মানুষের প্রতি সহজাত ভক্তি-ভালোবাসা এবং দায়বদ্ধতার সুদৃঢ় অঙ্গীকার তাদের গণমুখী করে তুলেছে। ফলে নাকের পানি-চোখের পানি এক করে ন্যাকা ন্যাকা সুরে প্রতারণামূলক কথাবার্তা দিয়ে তাদের জনগণকে বিভ্রান্ত করার নিত্যনতুন নাটকের জন্য মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে হয় না। তারা জানে এবং বিশ্বাস করে যে, জনগণের ভোট ছাড়া তারা কোনো দিন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এক দিনও গদিতে বসে থাকতে পারবেন না জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা ছাড়া। তারা খুব ভালো করে জানেন, তাদের দেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম, তাদের জনগণ আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ও স্বাধীনচেতা এবং সর্বোপরি, তারা সেই জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত বৈধ প্রধানমন্ত্রী।
আসল সিঙ্গাপুর-কানাডার জনপ্রিয় এবং সফল প্রধানমন্ত্রীদ্বয়ের মূল ক্যারিশমা হলো তাদের বৈধতা। ফলে দায়িত্ব নিয়ে তারা যখন স্থানকাল পাত্র ভেদে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রয়োগ করেন তখন তা জাদুকরি শক্তি নিয়ে একধরনের সম্মোহনী আবহ তৈরি করে ফেলে। প্রকৃতির মাঝে মহান আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন মাখলুকাতের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য নিজ নিজ গোত্র, ধর্ম, বর্ণ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে যেভাবে নেতা সৃষ্টি করেন ঠিক সেইভাবে মানুষের নেতা হওয়ার জন্যও আল্লাহর ম্যানুয়াল রয়েছে। কেউ যদি সেই ম্যানুয়াল অমান্য করে নকল নেতা হওয়ার চেষ্টা করে তবে দেশ কাল সমাজ কোনোকালে আদি ও আসল সভ্যতার ধারকবাহক হতে পারে না। প্রকৃতির এই অমোঘ নিয়ম প্রধানমন্ত্রী লি এবং প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো খুব ভালোভাবে জানেন বলেই তারা জনগণের নেতা হতে পেরেছেন এবং জনগণের দোয়া আর ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে দিনরাত সন্তুষ্টচিত্তে ও নির্ভয়ে বুক উঁচু অথচ মাথা নিচু করে হাসিমুখে দেশের সেবা করে যাচ্ছেন।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য