চীনের শুল্ক সুবিধায় ভারতে এত উৎকণ্ঠা কেন?
চীনের শুল্ক সুবিধায় ভারতে এত উৎকণ্ঠা কেন? - ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশকে চীনের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার বিষয়টি নিয়ে নানা ধরনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে দেখা যাচ্ছে। করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যখন বড় ধরনের অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়েছে, তখনই বেইজিং এই বাণিজ্যসুবিধা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ঘোষণা অনুসারে বাংলাদেশের আট হাজার ২৫৬টি পণ্য শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে চীনে যা দেশটিতে বাংলাদেশ যে পণ্য রফতানি করে তার ৯৭ শতাংশ। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এই সুবিধা পাবে। ২০২৭ সালে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পরও যাতে এই সুবিধা অব্যাহত থাকে সে চেষ্টা করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে ।
ভারতের সাথে যখন চীনের দোটানা তুঙ্গে তখনই বাংলাদেশের রফতানি পণ্য কোটামুক্তভাবে বিনা শুল্কে রফতানির সুযোগ দেয় চীন। তবে চীনের দেয়া এমন সুবিধাকে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘খয়রাতি’ হিসেবে উল্লেখ করে খবর প্রকাশ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন এটাকে ‘ছোট মানসিকতার পরিচয়’ বলে মন্তব্য করে বলেছেন, এটা খয়রাতি নয়। তবে এ বিষয়ে ভারত সরকার কোনো কিছু বলেনি। দেশটির কয়েকটি পত্রিকা আপত্তিকর ভাষায় মন্তব্য করেছে। তারা এমন শব্দ ব্যবহার করেছে যা কোনোভাবেই ব্যবহার করা উচিত নয়। যেসব পত্রিকা এই ভাষা ব্যবহার করেছে তারা ‘সাংবাদিকতার নৈতিকতাবিবর্জিত’ কাজ করেছে বলেও মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার বক্তব্য হলো, ‘চীন যে সুবিধা দিয়েছে তা আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের দীর্ঘদিনের ফসল। অনেক দিন ধরেই আমরা এই সুবিধা চীনের কাছে চেয়ে আসছিলাম। আমরা এমনকি প্রতিবেশী ভারতের কাছেও এ ধরনের সুবিধা চেয়েছি। চীন খুবই উপযুক্ত সময়ে অন্যান্য এলডিসিভুক্ত দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশকে এই সুবিধা দিয়েছে। চীনের সাথে আমাদের বাণিজ্যিক ঘাটতি অত্যন্ত বেশি। আশা করি, আট হাজারের বেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা সেই ঘাটতি কিছুটা হলেও কমিয়ে আনবে। চীনের প্রদেয় এই সুবিধা আগামী জুলাই থেকে বলবৎ হবে।’ মন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর অবশ্য আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের মন্তব্য প্রত্যাহার এবং এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছে।
কেন এই প্রতিক্রিয়া?
বাংলাদেশের প্রতি বছর যেখানে রফতানি আয় ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সেখানে এই সিদ্ধান্তে ঢাকার ০.৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় বাড়বে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। রফতানি আয়ের বৃদ্ধি হিসেবে এটি মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। তবে এর পরও এ নিয়ে উল্লাস অথবা উদ্বেগ কেন এতটা বেশি সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। মূল বিষয়টা হলো দক্ষিণ এশিয়ায় এখন চীন এবং ভারতের মধ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই এমন একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যেখানে কোনো দেশ একপক্ষে ঝুঁকলে সেটাকে অন্যপক্ষ অনেক বড় করে দেখছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় মিডিয়ার শুল্ক সুবিধাকে তাচ্ছিল্য করা প্রসঙ্গে এ নিয়ে ‘ভারত সরকার কোনো আপত্তি করছে না’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভারতের সরকারি মনোভাবই মিডিয়ার রিপোর্টে প্রতিফলিত হয়েছে।
চীন ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশ এক ধরনের ‘ডিলেমায়’ আছে বেশ কিছু দিন ধরে। বাংলাদেশের যে উন্নয়নসহায়তা প্রয়োজন সেটি দেয়ার ক্ষমতা নেই ভারতের। এমনকি বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বিশেষত পোশাক রফতানির মাধ্যমে যে খ্যাতি অর্জন করেছে তাতেও ভারতের কোনো সহায়ক মিকা নেই। অভ্যন্তরীণভাবে তিনটি বিষয়ে নীতিগত সহায়তার মুখ্য ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক বিপ্লবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাক টু ব্যাক এলসি ব্যবস্থা প্রবর্তন, ডিউটি ড্র ব্যাক পদ্ধতি এবং ক্যাশ ইনসেন্টিভ বা নগদ সহায়তা। আর আন্তর্জাতিকভাবে কাঁচামালের সুবিধা পাওয়া গেছে চীন থেকে। প্রথম দিকে হংকংয়ের মাধ্যমে এলসি করা হতো; পরে বাজার উন্মুক্ত হলে সরাসরি চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হয়। এমনকি তৈরী পোশাকের লিংকেজ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও চীনের সহায়তা পাওয়া গেছে। এ দেশের ছোট ও মাঝারি অধিকাংশ পোশাক কারখানায় চীনের মেশিনপত্র ব্যবহার করা হয়। এর বিপরীতে ভারতের উল্লেখ করার মতো কোনো সহায়ক ভূমিকা ছিল না বরং আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত বাংলাদেশকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গ্রহণ করে বৈরী তৎপরতা চালিয়েছে।
এখন বাংলাদেশকে চীন যে শুল্ক ও কোটামুক্তভাবে পণ্যের প্রবেশ সুবিধা দিয়েছে, তাতে ভারতের উদ্বেগ দুই কারণে। এর একটি হলো, চীনের সাথে বাংলাদেশের এনগেজমেন্ট বা সম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়া। ভারতের অবজারভার ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, এই সম্পৃক্ততা যতখানি সম্ভব ঠেকাতে হবে। বিশেষত প্রভাবশালী এই ভারতীয় থিংক ট্যাংক বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য ‘সব ধরনের ব্যবস্থা’ নিতে পরামর্শ দিয়েছে।
চীনের এখনকার বাজার সুবিধার পেছনে একটি অর্থনৈতিক বিষয় সুপ্ত রয়েছে। সেটি হলো চীনের ব্যয়বহুল হয়ে পড়া শিল্প ইউনিটগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তর করে এখানকার উৎপাদিত পণ্য আবার চীনে রফতানি করা। সেটি পাশ্চাত্যের অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান চীনের ক্ষেত্রে করেছে। এ ছাড়া চীনের সামনে আরেকটি আশঙ্কা হলো করোনাভাইরাস-উত্তর সময়ে চীনকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ার মতো একটি অবস্থা তৈরি হতে পারে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিল্প ইউনিট অন্য দেশে স্থানান্তর করতে পারলে তৃতীয় দেশ থেকে তৈরি করা চীনা কোম্পানির পণ্য রফতানির একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। ইতোমধ্যে স্টিল মিল ও কেমিক্যাল প্ল্যান্ট করার জন্য চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের সাথে আলোচনা শুরু করেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যে, দেশটিকে ভারত তার ‘বিধিবদ্ধ আঙিনা’ মনে করে সেখানে চীনের প্রভাব ও সম্পৃক্ততা নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়া দিল্লির নীতিনির্ধারকরা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। এর অর্থনৈতিক মূল্যের পাশাপাশি রয়েছে কৌশলগত মূল্যও। চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা যত বাড়বে ততই ভারতের প্রভাব এখানে কমতে থাকবে। এতে ভারতের সমলোচনামুখর রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের প্রতিবেশী দেশগুলো একের পর এক ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে চীনের দিকে ছুটছে বলে যে অভিযোগ তুলছেন সেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বাস্তবে রূপ লাভ করবে।
মোদি সরকারের পক্ষ থেকে এনআরসির মাধ্যমে লাখ ত্রিশেক মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে হুমকি দিয়ে রাখা হয়েছে সেটি বাংলাদেশের জনগণের পাশাপাশি সরকারকেও সন্ধিগ্ধ করে তুলেছে ভারতের বিজেপি সরকারের ভবিষ্যৎ নীতির ব্যাপারে। চীনা প্রভাবের অনুপ্রবেশে এটি একটি উর্বর ক্ষেত্র বানিয়েছে বাংলাদেশকে। ক্ষেত্রটিকে আরো উর্বর করেছে মোদি সরকারের সাম্প্রতিক মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা বাধানোসহ নানা কর্মকাণ্ড।
এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের ছোটখাটো দ্বিধাগ্রস্ততাকে ভারত অনেক বড়ভাবে হুমকির বিষয় হিসেবে দেখে। চীনের শুল্ক সুবিধাকে এ কারণে ভারত বাংলাদেশের পক্ষ পরিবর্তনের একটি মহড়া হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।
চ্যালেঞ্জও হবে অনেক বড়
চীনের বাণিজ্য ছাড় কি শুধু সুবিধাই নিয়ে আসবে নাকি একই সাথে চ্যালেঞ্জও আসবে এর মাধ্যমে? এই প্রশ্নটি হেলাফেলা করার মতো নয়। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক নির্ভরতার অনেক দিক রয়েছে। এর একটি দিক হলো বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বিনিয়োগ সহায়তা প্রাপ্তি। বিশ্ব ব্যাংক বা এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এই সহায়তা রেয়াতি শর্তে পায় বাংলাদেশ; যেখানে নামমাত্র সার্ভিস চার্জ এবং পরিশোধের দীর্ঘ মেয়াদ থাকে। কিন্তু তাদের স্বচ্ছতাসহ অন্য যেসব শর্ত থাকে সেসবের সাথে মানিয়ে উঠতে পারে না বাংলাদেশের রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে চীনের বিনিয়োগের সুদহার এবং পণ্যের সরবরাহ দর যাই থাক না কেন স্বচ্ছতার ব্যাপারে তারা চোখ বন্ধ রাখতে অভ্যস্ত। ফলে চীনা সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের ব্যয় অব্যাহতভাবে বাড়তে থাকলেও তহবিল প্রাপ্তিতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা হলো বাংলাদেশের রফতানি বাজারনির্ভরতা। বাংলাদেশের ৪০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি পণ্যের তিন-চতুর্থাংশের গন্তব্য হলো ইউরোপ ও আমেরিকা। এসব অঞ্চলের শুল্ক সুবিধাকে অবলম্বন করেই বাংলাদেশের পোশাক খাতের উত্থান ঘটেছে। চীনের ওপর অধিক নির্ভরতা যুক্তরাষ্ট্র্রসহ পাশ্চাত্যকে বৈরী করে ফেললে বাংলাদেশের রফতানি বাজারে সঙ্কট হতে পারে। চীন রাশিয়ার যে বাজার তা দিয়ে কোনোভাবেই এটি পূরণ করার মতো নয়।
ভারতের পক্ষ থেকে আশাব্যঞ্জক ও ক্ষতিকর দু’টি বার্তাই রয়েছে ঢাকার জন্য। আশাজনক বার্তাটি হলো করোনা-উত্তর সময়ে যে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহায়তা ঢাকার প্রয়োজন হবে সেটি বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপ এবং জাপানের মাধ্যমে পূরণ করা হবে, যেখানে ভারত সরাসরি তার প্রভাব কাজে লাগাবে। আর ভীতিকর বার্তাটি হলো, করোনা-উত্তর বিশ্বে চীনের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের এমন একটি বলয় তৈরি হচ্ছে যেটি চীনকে বয়কটের মতো চরম অবস্থায়ও যেতে পারে। চীনা বলয়ে অবস্থান নিলে বাংলাদেশ একদিকে ইউরোপ আমেরিকার বাজার হারানোর ঝুঁকির সম্মুখীন হবে; অন্য দিকে তাদের প্রভাব বলয়ের অভিবাসন ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানের বাজার ঢাকার জন্য সঙ্কুচিত হয়ে যেতে পারে। এমনকি জাতিসঙ্ঘের শান্তি মিশনে বাংলাদেশের অবস্থানের ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে।
প্রকৃতপক্ষে চীনের ব্যাপারে পাশ্চাত্যের দেশগুলো এই পর্যায়ে যেতে পারবে কিনা অথবা ভারতের সাথে তাদের নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো সমীকরণ তৈরি হবে কিনা সেটি বলা কঠিন। তবে এ বিষয়গুলোকে বাংলাদেশ কোনোভাবেই হালকা হিসেবে দেখতে পারে না।
পররাষ্ট্র সম্পর্কে অস্থিরতা
এ বিষয়টিতে বাংলাদেশ ভারত চীন এই ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কে যে বড় রকমের একটি অস্থিরতা তৈরি হতে যাচ্ছে তাতে সংশয়ের অবকাশ কমই মনে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগের পৃথিবী এবং এর পরবর্তী বিশ্বের অবস্থা এক হবে না বলে বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞরা যে পূর্বাভাস দিয়ে আসছিলেন, তার বড় রকমের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় পড়তে যাচ্ছে বলে মনে হয়। চীন থেকে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শুরু হলেও এটি ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। একই সাথে এই কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেই লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে চীনা পণ্য বর্জন এবং চীনের অর্থ সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাতিলের হিড়িক শুরু হয়েছে ভারতে। সাময়িকভাবে এই উত্তেজনা নিরসনের কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে এক শক্তি আরেক শক্তিকে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতি দুই ক্ষেত্রেই নিচ্ছে বলে মনে হয়।
ভারতের সাথে চীনের ১৯৬২ সালে বড় ধরনের যুদ্ধ হলেও পরবর্তী পর্যায়ে বিরোধের বিষয়গুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে উভয় দেশ। ফলে ১৯৭৫ সালের পর মৃত্যু ঘটার মতো আর কোনো সঙ্ঘাত সংঘর্ষ হয়নি। অধিকন্তু ব্রিকস (ইজওঈঝ), নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা দেশে পরিণত হয় চীন ও ভারত। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সব কিছু উল্টো গতি নেয়। মোদি চীনের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বলয়ের সাথে কৌশলগত সামরিক ও বাণিজ্যিক মৈত্রী গঠনের মাধ্যমে বিশ্ব শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে চীন, ভারতের মধ্যে বিরোধের বিষয় পাশে ফেলে অভিন্ন স্বার্থে সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস বারবার হোঁচট খেতে থাকে। ডোকলাম সঙ্কটের মধ্য দিয়ে এর প্রথম বড় রকমের সঙ্ঘাতমুখর প্রকাশ ঘটে।
ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে দীর্ঘদিন ধরে তার আঙিনা হিসেবে বিবেচনা করে এতে অন্য কোনো শক্তির প্রবেশ না মানার মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে আসছিল। যুক্তরাষ্ট্র এটি মেনে নিয়ে একপর্যায়ে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার নেতা বা মোড়ল ঘোষণা করে। এতে উল্লসিত নরেন্দ্র মোদি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং পরমাণু প্রযুক্তি রফতানিকারক দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। সেই সাথে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো যাতে চীনের ঘনিষ্ঠ হতে না পারে তার জন্য নানাভাবে চোখ রাঙানোর নীতি গ্রহণ করেন। এটি করতে গিয়ে একে একে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ সুতা ছিন্ন হতে শুরু করে। ভারতের সাথে কঠিন চুক্তির মাধ্যমে আবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার একসময়ের সাংবিধানিক হিন্দু রাষ্ট্র্র নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন শত্রু দেশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। রাজাপাকসের নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর শ্রীলঙ্কার ওপর নিয়ন্ত্রণ ভারতের চেয়ে চীনেরই এখন অনেক বেশি। মালদ্বীপ ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও চীনের সাথে বিরোধে যেতে চাইছে না। এমনকি, ভুটানের অবস্থা কোনো একসময় নেপালের মতো হয়ে পড়ে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত দিল্লির নীতিনির্ধারকরা। তলে তলে বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে থিম্ফু অনেক দূর এগিয়েছে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের। এ অবস্থায় বাংলাদেশ হলো একমাত্র দেশ যেটি ভারতের সাথে নিরাপত্তা ও অন্যান্য সহযোগিতার সম্পর্কটি এখনো ধরে রেখেছে ।
কিন্তু ঢাকার ওপর সন্দেহের দৃষ্টি কোনোভাবেই সরিয়ে রাখতে পারছেন না মোদি ও তার সহযোগী নীতিপ্রণেতারা। দুই দেশের বন্ধনকে দৃঢ় করতে এর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোজ পারিকর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা চুক্তির যে মুসাবিদা বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছিল তাতে পুরোপুরি সম্মত হয়নি ঢাকা।
প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কার ওপর নির্ভর করবে- বেইজিং নাকি ভারত? এতদিন শেখ হাসিনার প্রশাসন এই দুই রাষ্ট্রের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক চালিয়ে আসছিল। নিরাপত্তা ও কৌশলগত ইস্যু নিয়ে সমঝোতায় অগ্রাধিকার দিয়েছে ভারতকে। আর অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরতা তৈরি করেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে চীনা বিনিয়োগে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। এর একটি অংশ ছাড়ও করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার পর অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে বাংলাদেশের ৯ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে বলে হিসাব করা হয়েছে। চীনের সাথে কার্যকর সহযোগিতা করা হলে বেইজিং এই সহায়তা দিতে সম্মত বলে জানা যাচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে করোনা সংক্রমণে সহযোগিতার ইস্যুটি। করোনার টিকা অবিষ্কারে সবচেয়ে অগ্রণী অবস্থানে রয়েছে চীন। এটিও বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।
সব মিলিয়ে ভারতের বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা যেমন বাড়ছে তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক পররাষ্ট্র সম্পর্কের সমীকরণগুলোও জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই জটিলতা এই অঞ্চলে অনেক ধরনের পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
mrkmmb@gmail.com