বাংলাদেশকে চীনের বাণিজ্য ছাড় : ভারতের প্রতিক্রিয়া এমন কেন?

মাসুম খলিলী | Jun 25, 2020 10:18 pm
নরেন্দ্র মোদি

নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত

 

বাংলাদেশের প্রতি বছর যেখানে রফতানি আয় ৪০ বিলিয়ন ডলারের বেশি সেখানে এই সিদ্ধান্তে ঢাকার ০.৭ বিলিয়ন ডলারের রফতানি আয় বাড়বে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। রফতানি আয়ের বৃদ্ধি হিসেবে এটি মোটেই উল্লেখযোগ্য নয়। তবে এর পরও এ নিয়ে উল্লাস অথবা উদ্বেগ কেন এতটা বেশি সেই প্রশ্ন উঠতে পারে। মূল বিষয়টা হলো দক্ষিণ এশিয়ায় এখন চীন এবং ভারতের মধ্যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াই এমন একটা পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে যেখানে কোনো দেশ একপক্ষে ঝুঁকলে সেটাকে অন্যপক্ষ অনেক বড় করে দেখছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় মিডিয়ার শুল্ক সুবিধাকে তাচ্ছিল্য করা প্রসঙ্গে এ নিয়ে ‘ভারত সরকার কোনো আপত্তি করছে না’ বলে উল্লেখ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে ভারতের সরকারি মনোভাবই মিডিয়ার রিপোর্টে প্রতিফলিত হয়েছে।

চীন ভারতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশ এক ধরনের ‘ডিলেমায়’ আছে বেশ কিছু দিন ধরে। বাংলাদেশের যে উন্নয়নসহায়তা প্রয়োজন সেটি দেয়ার ক্ষমতা নেই ভারতের। এমনকি বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বিশেষত পোশাক রফতানির মাধ্যমে যে খ্যাতি অর্জন করেছে তাতেও ভারতের কোনো সহায়ক মিকা নেই। অভ্যন্তরীণভাবে তিনটি বিষয়ে নীতিগত সহায়তার মুখ্য ভূমিকা রয়েছে বাংলাদেশের তৈরী পোশাক বিপ্লবে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাক টু ব্যাক এলসি ব্যবস্থা প্রবর্তন, ডিউটি ড্র ব্যাক পদ্ধতি এবং ক্যাশ ইনসেন্টিভ বা নগদ সহায়তা। আর আন্তর্জাতিকভাবে কাঁচামালের সুবিধা পাওয়া গেছে চীন থেকে। প্রথম দিকে হংকংয়ের মাধ্যমে এলসি করা হতো; পরে বাজার উন্মুক্ত হলে সরাসরি চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হয়। এমনকি তৈরী পোশাকের লিংকেজ শিল্প প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও চীনের সহায়তা পাওয়া গেছে। এ দেশের ছোট ও মাঝারি অধিকাংশ পোশাক কারখানায় চীনের মেশিনপত্র ব্যবহার করা হয়। এর বিপরীতে ভারতের উল্লেখ করার মতো কোনো সহায়ক ভূমিকা ছিল না বরং আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত বাংলাদেশকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে গ্রহণ করে বৈরী তৎপরতা চালিয়েছে।

এখন বাংলাদেশকে চীন যে শুল্ক ও কোটামুক্তভাবে পণ্যের প্রবেশ সুবিধা দিয়েছে, তাতে ভারতের উদ্বেগ দুই কারণে। এর একটি হলো, চীনের সাথে বাংলাদেশের এনগেজমেন্ট বা সম্পৃক্ততা বেড়ে যাওয়া। ভারতের অবজারভার ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টেও বলা হয়েছে, এই সম্পৃক্ততা যতখানি সম্ভব ঠেকাতে হবে। বিশেষত প্রভাবশালী এই ভারতীয় থিংক ট্যাংক বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা খাতে চীনের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য ‘সব ধরনের ব্যবস্থা’ নিতে পরামর্শ দিয়েছে।

চীনের এখনকার বাজার সুবিধার পেছনে একটি অর্থনৈতিক বিষয় সুপ্ত রয়েছে। সেটি হলো চীনের ব্যয়বহুল হয়ে পড়া শিল্প ইউনিটগুলো বাংলাদেশে স্থানান্তর করে এখানকার উৎপাদিত পণ্য আবার চীনে রফতানি করা। সেটি পাশ্চাত্যের অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠান চীনের ক্ষেত্রে করেছে। এ ছাড়া চীনের সামনে আরেকটি আশঙ্কা হলো করোনাভাইরাস-উত্তর সময়ে চীনকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ার মতো একটি অবস্থা তৈরি হতে পারে। চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের শিল্প ইউনিট অন্য দেশে স্থানান্তর করতে পারলে তৃতীয় দেশ থেকে তৈরি করা চীনা কোম্পানির পণ্য রফতানির একটি সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। ইতোমধ্যে স্টিল মিল ও কেমিক্যাল প্ল্যান্ট করার জন্য চীনা বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশের সাথে আলোচনা শুরু করেছেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো যে, দেশটিকে ভারত তার ‘বিধিবদ্ধ আঙিনা’ মনে করে সেখানে চীনের প্রভাব ও সম্পৃক্ততা নতুন করে বৃদ্ধি পাওয়া দিল্লির নীতিনির্ধারকরা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। এর অর্থনৈতিক মূল্যের পাশাপাশি রয়েছে কৌশলগত মূল্যও। চীনের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা যত বাড়বে ততই ভারতের প্রভাব এখানে কমতে থাকবে। এতে ভারতের সমলোচনামুখর রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরা তাদের প্রতিবেশী দেশগুলো একের পর এক ভারতের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে চীনের দিকে ছুটছে বলে যে অভিযোগ তুলছেন সেটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও বাস্তবে রূপ লাভ করবে।

মোদি সরকারের পক্ষ থেকে এনআরসির মাধ্যমে লাখ ত্রিশেক মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার যে হুমকি দিয়ে রাখা হয়েছে সেটি বাংলাদেশের জনগণের পাশাপাশি সরকারকেও সন্ধিগ্ধ করে তুলেছে ভারতের বিজেপি সরকারের ভবিষ্যৎ নীতির ব্যাপারে। চীনা প্রভাবের অনুপ্রবেশে এটি একটি উর্বর ক্ষেত্র বানিয়েছে বাংলাদেশকে। ক্ষেত্রটিকে আরো উর্বর করেছে মোদি সরকারের সাম্প্রতিক মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা বাধানোসহ নানা কর্মকাণ্ড।
এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের ছোটখাটো দ্বিধাগ্রস্ততাকে ভারত অনেক বড়ভাবে হুমকির বিষয় হিসেবে দেখে। চীনের শুল্ক সুবিধাকে এ কারণে ভারত বাংলাদেশের পক্ষ পরিবর্তনের একটি মহড়া হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us