উৎকণ্ঠা বাড়ছে ভারতের

মাসুম খলিলী | Jun 25, 2020 10:14 pm
নরেন্দ্র মোদি

নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত

 

বাংলাদেশ ভারত চীন এই ত্রিপক্ষীয় সম্পর্কে যে বড় রকমের একটি অস্থিরতা তৈরি হতে যাচ্ছে তাতে সংশয়ের অবকাশ কমই মনে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণের আগের পৃথিবী এবং এর পরবর্তী বিশ্বের অবস্থা এক হবে না বলে বৈশ্বিক বিশেষজ্ঞরা যে পূর্বাভাস দিয়ে আসছিলেন, তার বড় রকমের প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ায় পড়তে যাচ্ছে বলে মনে হয়। চীন থেকে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ শুরু হলেও এটি ভারত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের জন্য এখন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। একই সাথে এই কোভিড-১৯ সংক্রমণের মধ্যেই লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সীমান্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতে চীনা পণ্য বর্জন এবং চীনের অর্থ সহায়তাপুষ্ট প্রকল্প বাতিলের হিড়িক শুরু হয়েছে ভারতে। সাময়িকভাবে এই উত্তেজনা নিরসনের কিছু উদ্যোগ দেখা গেলেও দীর্ঘ মেয়াদে এক শক্তি আরেক শক্তিকে মোকাবেলা করার প্রস্তুতি প্রতিরক্ষা ও অর্থনীতি দুই ক্ষেত্রেই নিচ্ছে বলে মনে হয়।

ভারতের সাথে চীনের ১৯৬২ সালে বড় ধরনের যুদ্ধ হলেও পরবর্তী পর্যায়ে বিরোধের বিষয়গুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে উভয় দেশ। ফলে ১৯৭৫ সালের পর মৃত্যু ঘটার মতো আর কোনো সঙ্ঘাত সংঘর্ষ হয়নি। অধিকন্তু ব্রিকস (ইজওঈঝ), নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা দেশে পরিণত হয় চীন ও ভারত। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর সব কিছু উল্টো গতি নেয়। মোদি চীনের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বলয়ের সাথে কৌশলগত সামরিক ও বাণিজ্যিক মৈত্রী গঠনের মাধ্যমে বিশ্ব শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে চীন, ভারতের মধ্যে বিরোধের বিষয় পাশে ফেলে অভিন্ন স্বার্থে সামনে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস বারবার হোঁচট খেতে থাকে। ডোকলাম সঙ্কটের মধ্য দিয়ে এর প্রথম বড় রকমের সঙ্ঘাতমুখর প্রকাশ ঘটে।

ভারত দক্ষিণ এশিয়াকে দীর্ঘদিন ধরে তার আঙিনা হিসেবে বিবেচনা করে এতে অন্য কোনো শক্তির প্রবেশ না মানার মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে আসছিল। যুক্তরাষ্ট্র এটি মেনে নিয়ে একপর্যায়ে ভারতকে দক্ষিণ এশিয়ার নেতা বা মোড়ল ঘোষণা করে। এতে উল্লসিত নরেন্দ্র মোদি নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং পরমাণু প্রযুক্তি রফতানিকারক দেশের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন। সেই সাথে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো যাতে চীনের ঘনিষ্ঠ হতে না পারে তার জন্য নানাভাবে চোখ রাঙানোর নীতি গ্রহণ করেন। এটি করতে গিয়ে একে একে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে দিল্লির নিয়ন্ত্রণ সুতা ছিন্ন হতে শুরু করে। ভারতের সাথে কঠিন চুক্তির মাধ্যমে আবদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার একসময়ের সাংবিধানিক হিন্দু রাষ্ট্র্র নেপালের সাথে ভারতের সম্পর্ক এখন শত্রু দেশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। রাজাপাকসের নতুন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর শ্রীলঙ্কার ওপর নিয়ন্ত্রণ ভারতের চেয়ে চীনেরই এখন অনেক বেশি। মালদ্বীপ ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও চীনের সাথে বিরোধে যেতে চাইছে না। এমনকি, ভুটানের অবস্থা কোনো একসময় নেপালের মতো হয়ে পড়ে কিনা তা নিয়ে শঙ্কিত দিল্লির নীতিনির্ধারকরা। তলে তলে বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে থিম্ফু অনেক দূর এগিয়েছে বলে ধারণা পর্যবেক্ষকদের। এ অবস্থায় বাংলাদেশ হলো একমাত্র দেশ যেটি ভারতের সাথে নিরাপত্তা ও অন্যান্য সহযোগিতার সম্পর্কটি এখনো ধরে রেখেছে ।

কিন্তু ঢাকার ওপর সন্দেহের দৃষ্টি কোনোভাবেই সরিয়ে রাখতে পারছেন না মোদি ও তার সহযোগী নীতিপ্রণেতারা। দুই দেশের বন্ধনকে দৃঢ় করতে এর আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোজ পারিকর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা চুক্তির যে মুসাবিদা বাংলাদেশকে দেয়া হয়েছিল তাতে পুরোপুরি সম্মত হয়নি ঢাকা।

প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত কার ওপর নির্ভর করবে- বেইজিং নাকি ভারত? এতদিন শেখ হাসিনার প্রশাসন এই দুই রাষ্ট্রের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক চালিয়ে আসছিল। নিরাপত্তা ও কৌশলগত ইস্যু নিয়ে সমঝোতায় অগ্রাধিকার দিয়েছে ভারতকে। আর অর্থনৈতিক বিনিয়োগ বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে চীনের ওপর নির্ভরতা তৈরি করেছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলী টানেলসহ অনেক বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে চীনা বিনিয়োগে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছেন। এর একটি অংশ ছাড়ও করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার পর অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে বাংলাদেশের ৯ বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন হবে বলে হিসাব করা হয়েছে। চীনের সাথে কার্যকর সহযোগিতা করা হলে বেইজিং এই সহায়তা দিতে সম্মত বলে জানা যাচ্ছে। এ ছাড়া রয়েছে করোনা সংক্রমণে সহযোগিতার ইস্যুটি। করোনার টিকা অবিষ্কারে সবচেয়ে অগ্রণী অবস্থানে রয়েছে চীন। এটিও বাংলাদেশের জন্য হয়ে দাঁড়িয়েছে গুরুত্বপূর্ণ একটি ইস্যু।

সব মিলিয়ে ভারতের বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা যেমন বাড়ছে তেমনি দক্ষিণ এশিয়ার সার্বিক পররাষ্ট্র সম্পর্কের সমীকরণগুলোও জটিল হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই জটিলতা এই অঞ্চলে অনেক ধরনের পরিবর্তনের নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us