করোনার বিরুদ্ধে লড়াই : একজন মনোয়ারা আক্তার
মনোয়ারা আক্তার - ছবি : নয়া দিগন্ত
মনোয়ারা আক্তার। করোনা উপসর্গ রোগীদের কাছে এক ভরসার নাম। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের প্যাথলজি বিভাগের ল্যাব টেকনোলজিস্ট। তিনি ১৮ শ’ করোনার নমুনা সংগ্রহ করে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। করোনা মহামারিতে নিরলসভাবে কাজে করে পুরো সোনারগাঁও উপজেলাবাসীর কাছে প্রশংসায় সিক্ত হয়েছেন এই করোনা যোদ্ধা।
তিনি বলেন, যারা করোনায় অসুস্থ হচ্ছে তারাও তো আমার মতো কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। কারো বোন, ভাই, মেয়ে। এ করোনাকালে অনেকে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছে। আমিও আমার অবস্থান থেকে পরম করুণাময়ের ওপর আত্মবিশ্বাস রেখে মানুষের একটু সেবা করে যাচ্ছি।
সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা ভাইরাস পরীক্ষার কাজ শুরু হয় গত ৫ এপ্রিল। কাঁচপুর ইউনিয়নে এক বৃদ্ধ সর্দি কাশি নিয়ে মৃত্যুবরণ করার পর তার নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেই থেকে শুরু এখন পর্যন্ত ১৮০০ বার রোগীদের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। করোনাভাইরাস সংক্রমণ সন্দেহে আসা রোগীদের শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত।
সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, সোনারগাঁও উপজেলায় হাসপাতালে যখন করোনা ভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হয়, তখন দায়িত্ব দেয়া হয় এমটি ইপিআই, এমটি ল্যাবসহ আরো দু’জনকে। লোকবলের অভাবে অবশেষে নমুনা সংগ্রহের দায়িত্ব পড়ে এমটি মেডিক্যাল টেকনোলজিষ্ট মনোয়ারার উপর। সাথে তাকে সহযোগিতার জন্য দেয়া হয় সহকারী রায়হান ও হাসানকে। প্রথমে কিছুটা শঙ্কিত হলেও মনের ভেতর সাহস সঞ্চার করে মুহূর্তের মধ্যেই নমুনা সংগ্রহের কাজে রাজি হয়ে যান তিনি। এরপর ৫ এপ্রিল প্রথম একজন মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ দিয়ে শুরু হয় তার এগিয়ে চলা। গত আড়াই মাসে বিভিন্ন রোগীর কাছ থেকে ১৮ শ' বার নমুনা সংগ্রহ করেছেন তিনি। সবশেষ ২০ জুন ২২ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছেন। এসব নমুনা পরীক্ষা করে ৩৬২ কয়েকজন রোগীর শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। শুধু সাধারণ মানুষই নন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন তার সাথে কর্মরত হাসপাতালের কয়েকজন স্টাফও। তারপরও দমে যাননি মনোয়ারা।
মনোয়ারা আক্তার বলেন, আমাদের হাসপাতালে প্রথম থেকেই লোকবল সঙ্কট ছিল। সেজন্য আমি নিজেই একা মেডিক্যাল টেকনোলজিষ্টের কাজটি করে আসছি। যখন দেশে করোনাভাইরাস শুরু হলো তখন টিএইচও স্যার আমাকে ডেকে বললেন সোনারগাঁওয়ের করোনা আক্রান্তদের নমুনা সংগ্রহ করে আইইডিসিআরএ পাঠানোর জন্য। আমি রাজি হওয়ার পর স্যাম্পল কালেকশন কিট-পিপিইসহ সব সরঞ্জাম আমাকে বুঝিয়ে দেয়া হলো। তখন একাই হাসপাতালে সহকারী মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আমার স্বামী মোঃ হাবিলউদ্দিনের সাথে কথা বলে মা-বাবা ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের দোয়ায় কাজ শুরু করি।
মনোয়ারা বলেন, প্রথম কয়েকদিন নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে অনেক ভয় পেয়েছি। কারণ টিভিতে দেখেছি পৃথিবীর অনেক দেশে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে অনেক চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মারা গেছেন। সেগুলো দেখে আমার মনেও ভয় তৈরি হয়েছিল। এছাড়া আমার ঘরে পাঁচ বছরের একটি কন্যা সন্তান আছে। তাকে রেখে কীভাবে নমুনা সংগ্রহ করবো। আবার আমি যদি করোনায় আক্রান্ত হই, তাহলে তাকে কে দেখবে? এসব চিন্তা করে রাতে ঘুমাতে পারিনি। কিন্তু যখন চিন্তা করলাম যুদ্ধের ময়দানে নেমে মৃত্যুকে ভয় পেলে চলবে না, ভয়কে জয় করে যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে যেতে হবে।
তিনিবলেন, আমরা যদি ভয় পাই তাহলে মানুষের চিকিৎসা করবে কে? আমার উপর যে দায়িত্ব দিয়েছে সে দায়িত্ব যেন সঠিকভাবে পালন করতে পারি সেজন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছি। এছাড়া এ কাজে টিএইচও স্যার এবং আমার স্বামী সাহস জুগিয়েছেন। আল্লাহর উপর ভরসা ও তাদের দেয়া সাহস নিয়েই নমুনা সংগ্রহের কাজে নেমে পড়ি। নমুনা সংগ্রহের কাজে সহায়তার জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে সহায়তার জন্য সহকারী মোঃ রায়হান ও মোঃ হাসানকে সাথে দেন। যারা আমার কাজে প্রতিদিনই সহায়তা করে আসছেন। তাদের দু'জন পালা করে আমাকে সহায়তা করতেন। কাজটি যাতে বন্ধ না হয়ে যায় সেজন্য নিজের দিকে খেয়াল রেখেছি। সব সময় করোনা মুক্ত থাকতে যা যা করণীয় তা পালন করেছি।
তিনি আরো বলেন, প্রথমে হাসপাতালের বাইরে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করতাম। কিন্তু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন হাসপাতালেই নমুনা সংগ্রহ করা হয়। হাসপাতালে প্রতিদিনই নমুনা সংগ্রহ অব্যাহত রয়েছে। একদিনে সর্বোচ্চ ৭০ জনেরও নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়া কেউ যদি উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন শুনেই কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাৎক্ষণিক নমুনা সংগ্রহ করেছি। আর ইচ্ছে আছে যতদিন সুস্থ থাকবো, ততদিন নমুনা সংগ্রহের এ কাজ চালিয়ে যাবো। নিজের করোনাভাইরাস পরীক্ষা করিনি, কারণ এখন পর্যন্ত কোনো লক্ষণ দেখছি না। যদি অসুস্থ হয়েই যাই, তাহলে সুস্থ হয়ে আবার এসে কাজটি চালিয়ে যাবো। আমি সবার দোয়া ও সহযোগিতা কামনা করছি।
সোনারগাঁও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. পলাশ কুমার সাহা বলেন, আমি হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকালে মনোয়ারাকে দেখেছি নিষ্ঠা ও মনোযোগের সাথে কাজ করতে। তাকে ধন্যবাদ জানাই সাহসিকতা এবং তার কাজের জন্য।