কিডনি চিকিৎসার প্রকারভেদ
কিডনি - প্রতীকী ছবি
কিডনি রোগ বা অন্য কোনো রোগে কিডনি আক্রান্ত হওয়ার ফলে এর কার্যকারিতা তিন মাস বা ততোধিক সময় পর্যন্ত লোপ পেলে তাকে
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বলা হয়। ক্রনিক নেফ্রাইটিস কিডনির ফিল্টারকে (ছাঁকনি) আক্রমণ করে ক্রমান্বয়ে কিডনির কার্যকারিতা
কমিয়ে ফেলতে পারে। ফলে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। লিখেছেন শামীমা সরকার
মানুষ জন্মগ্রহণ করার ছয় সপ্তাহের মধ্যেই কিডনির ফিল্টার মেমব্রেন পুরোপুরি তৈরি হয়ে যায়। ফলে কিডনি পুরোদমে কাজ শুরু করতে পারে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০-১২ লাখ ফিল্টার রয়েছে এবং প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে। এই পরিশোধিত রক্তের মধ্য থেকে এক থেকে তিন লিটার শরীরের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেয়া হয়। কোনো কারণে যদি এ ধরনের ফিল্টার বাধাপ্রাপ্ত হয়, তখন দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামের জৈবপদার্থ পরিমাপ করা হয়, যার মাধ্যমে কিডনি কতটুকু কাজ করছে তা বোঝা যায়। দুঃখজনক বিষয় হলোÑ এই জৈবপদার্থটি কিডনির ৫০ শতাংশ কার্যকারিতা নষ্ট হওয়ার পরই শরীরে বাড়তে পারে। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১ দশমিক ৪ মিলিগ্রাম এবং একজন মহিলার শরীরে ১ দশমিক ৩ মিলিগ্রাম স্বাভাবিক হিসেবে ধরা হয়। যদি শরীরে এর থেকে অধিক মাত্রায় ক্রিয়েটিনিন তিন মাস বা ততোধিক কাল স্থায়ী থাকে তখন তাকে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়।
দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীর কোনো উপসর্গ বোঝা যায় না। ফলে বছরের পর বছর এরা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সম্পর্কে সবার ধারণা থাকা প্রয়োজন। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা, রক্তস্বল্পতা, শরীরে পানি জমা, শ্বাসকষ্ট ও প্রস্রাবের পরিমাণে তারতম্য, চর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি দেখা দেয়। তার মধ্যে প্রধান হলো হৃৎপিণ্ডের রোগ। দেশে ৮০ শতাংশ কিডনি রোগী এই উপসর্গগুলো নিয়েই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং রক্ত পরীক্ষায় দেখা যায় কিডনির অন্তত ৮০ ভাগ কার্যকারিতাই তখন নষ্ট হয়ে গেছে। কিডনির কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশ লোপ পেলে ওষুধের মাধ্যমে চিকিৎসা করে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। এক সময় রোগী মৃত্যু বরণ করেন। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যদি দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ নিরূপণ করা যায়, তাহলে চিকিৎসার মাধ্যমে এই রোগগুলোকে আংশিক বা পরিপূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হয়।
সুতরাং দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ থেকে বাঁচতে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি অত্যন্ত জরুরি। নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার। শুধু সচেতনতার মাধ্যমেই একজন রোগীর কিডনিতে সমস্যা আছে কি না তা জানা সম্ভব। যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কি না এবং ডায়াবেটিস আছে কি না তা নিরূপণ করা প্রয়োজন। যদি কারো ডায়াবেটিস থাকে, তার বছরে অন্তত একবার প্রস্রাবের সাথে অ্যালবুমিন বা মাইক্রো অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক কি না তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
দেশে এক কোটি ৮০ লাখ কিডনি রোগী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশে কিডনি ফাউন্ডেশন ও বিএসএমএমইউয়ের উদ্যোগে সাভারের আশুলিয়া গ্রামে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগের ওপর তিন বছর ধরে গবেষণা চালানো হচ্ছে। তিন হাজার প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওপর চালানো গবেষণার এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ১৮ শতাংশ মানুষ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ১৩ শতাংশের রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৩ সালে ১৫ হাজার ৬২৫ জন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ওপর গবেষণা সমীক্ষায় দেখা যায়, এদের ১১ শতাংশ দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত। অস্ট্রেলিয়ায় এই সংখ্যা ১৬ শতাংশ এবং আইসল্যান্ডে ১০ শতাংশ।
বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে মারা যান। কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ হিসেবে নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। নেফ্রাইটিস রোগের প্রধান কারণ হিসেবে ব্যাকটেরিয়া-জনিত ইনফেকশন, ভাইরাল হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ মেশানো ও ভেজাল, ক্রনিক ইন্টরেস্টেশিয়া নেফ্রাইটিসকে এর কারণ হিসেবে দায়ী করা যেতে পারে। এমনকি পানিতে অধিক পরিমাণে আর্সেনিক কিডনি রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে। মার্কারি, লেড, গোল্ড ও অন্যান্য ধাতব পদার্থ কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।
কিডনি সম্পূর্ণ অজেকো হয়ে গেলে শুধু ওষুধের মাধ্যমে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। রোগীকে বাঁচিয়ে রাখতে নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন প্রয়োজন হয়। বর্তমানে বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী পাঁচ থেকে ১৫ বছর এবং সফল কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাবাবিক জীবন যাপন করতে পারে। পৃথিবীতে নিয়মিত হেমোডায়ালাইসিসের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত রোগী বেঁচে আছেন এবং সফল কিডনি সংযোজনের ক্ষেত্রে প্রায় ৩৩ বছর বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে তিনবার ৪ ঘণ্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা বোঝায়। নিকটাত্মীয়ের কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপনকে কিডনি সংযোজন বোঝায়। অবশ্য উন্নত বিশ্বে মৃত বক্তির কিডনি নিয়ে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কিডনি সংযোজন করা হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়ের চলমান গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগীর মধ্যে ১৮ দশমিক ৫ শতাংশেরই উচ্চ রক্তচাপ, ৫ শতাংশ ডায়াবেটিস এবং ৬ শতাংশের প্রস্রাবের সাথে প্রোটিন নির্গত হয়। উল্লিখিত ৫ শতাংশ ডায়াবেটিক রোগীর সবাই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগে আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। ওই সমীক্ষায় রোগীদের প্রশ্ন করা হয়েছিলÑ তারা তাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ অথবা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হওয়া সম্পর্কে জানেন কি না। ৬০ শতাংশ রোগী জানেনই না তাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ অথবা প্রস্রাবে প্রোটিন নির্গত হয় এবং তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হননি। সুতরাং এই রোগীরাই দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে ভোগেন এবং ক্রমান্বয়ে তাদের কিডনি সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়। এই রোগীদেরই শনাক্ত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মাইক্রো-অ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া এবং চর্বিজাতীয় খাবারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেয়ে বা ধূমপান পরিহার করে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সাথে সম্পর্কিত হৃদরোগ থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। কিডনি রোগীদের সচেতন করে তোলা এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ শনাক্তকরণের সাথে সাথে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে লাখ লাখ কিডনি রোগী কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবেন। পাশাপাশি কিডনি অকেজো রোগীরা ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের বিশাল খরচ থেকে মুক্তি পাবেন।