ভারতকে শিক্ষা দেবে চীন?
মোদি ও শি - ছবি : সংগৃহীত
ভারতীয় বিশ্লেষকেরা ২০১৭ সালে পূর্ব লাদাখ থেকে দোকলাম পর্যন্ত ভারত-চীন সমিান্তে সামরিক প্রস্তুতির তুলনা করেছিলেন। বিরোধপূর্ণ এলাকায একটি রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে এমনটি আবারো হওয়াটা প্রত্যাশিতই ছিল।
দোকলামে ভারত আশঙ্কা করেছিল যে চীনা রাস্তাটি দেশটিকে পাহাড়ি এলাকায় এমন সুবিধা দেবে যার ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাথে তার ক্ষীণ সংযোগস্থল সিলিগুরি করিডোরটি হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
লাদাখে ভারতীয় বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী চীনা সামরিক অবস্থান ভারতের নিমৃাণ করা একটি রাস্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। এই রাস্তাটি আকসাই চিন ও এনএইচ ২১৯, ভঙ্গুর জিনজিয়াং-তিব্বত মহাসড়ককে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
চীন কি শুরুতে লাদাখে ভারতের রাস্তা নির্মাণকে অগ্রাহ্য করেছিল?
মজার ব্যাপার হলো, ভারতের ২০০৮ সালের দৌলত বেগ ওলদি এয়ার বেজটি আবার চালুর (১৯৬২ সালে পরিত্যক্ত করার পর) বা এমনকি ২০১৩ সালের দ্রুততার সাথে তার শক্তি বাড়ানোর (এর ফলে এখানে সদ্য কেনা লকহিড মার্টিন সি-১৩০জে-৩০ পরিবহন বিমান অবতরণ করতে পারবে) প্রতিবাদ করেনি চীন।
এমনকি দুই দশক সময় নিয়ে সব আবহাওয়ায় চলাচল উপযোগী ২৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দারবুক-শিয়খ-দৌলত বেগ ওলদি (ডিএসডিবিও) রাস্তাটির কাজ সম্পন্ন করে তখনও চীন প্রতিবাদ করেনি। উল্লেখ্য, এই রাস্তাটি নির্মাণের ফলে ভারতীয়রা সেখানে দুই দিনের বদলে মাত্র ৬ ঘণ্টায় সৈন্য পাঠাতে পারবে। ফলে বলা যায়, এটি একটি গেম চেঞ্জার।
পূর্ব লাদাখের অতি সাম্প্রতিক সময়ের টালমাটাল ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে আমরা যে কারণেই হোক না কেন, এসব বিষয় দেখতে পাচ্ছি না। এই প্রেক্ষাপটে আমাদের মূল্যায়ন করার সময় একটি মৌলিক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়।
চীন কেন এত দিন চুপ করে থেকে হঠাৎ করে দৌলত বেগ ওলডি সামরিক ঘাঁটি নতুন করে চালু নিয়ে পুরোপুরি সক্রিয় হয়ে ওঠল? এই ঘাঁটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। একটি ভারতের সর্বউত্তরের শীতল মরু অঞ্চল কারাকোরাম রেঞ্চের সর্বশেষ বিন্দু, চীনা সীমান্তের মাত্র ৮ কিলোমিটার দূরে, দুই দেশের মধ্যকার লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের আকসাই চিন থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে, তিব্বত থেকে জিনজিয়াংকে বিভক্তকারী কারাকোরাম পাস থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে।
আকসাই চিন নিয়ে ভারতীয় পরিকল্পনা নিয়ে সংশয়ে চীন?
এর জবাব হলো, এই অঞ্চলে সামরিক অবকাঠামোতে ভারতের শক্তিবৃদ্ধিকে কোনোভাবেই চীন হালকাভাবে গ্রহণ করতে পারে না।সাব সেক্টর নর্থ নামে পরিচিত এই এলাকাটি সিয়াচেন হিমবাহের ঠিক পূর্বে অবস্থিত এবং এখন দিয়েই কেবল ভারত থেকে আকসাই চিনে প্রবেশ করা যায়।
স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, এসএসএনে সামরিক অবকাঠামোতে যেকোনো ধরনের হুমকি সৃষ্টিকারী শক্তিবৃদ্ধি চাইবে না চীন। তবে ভারত ডিএসডিবিও থেকে উত্তর দিকে বেশ কয়েকটি শাখা রাস্তা নির্মাণকাজ শুরু করেছিল। এর ফলে ফিঙ্গার নামে পরিচিত অংশগুলোতে চীনা প্রতিরক্ষা লাইনের পেছনে যাওয়ার সুযোগ দেয় ভারতকে।
এদিকে এসএসএনের উত্তরে ইন্ডাস ভ্যালি দিয়ে চীন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি মহাসড়ক তৈরী করেছে। এনএইচ ২১৯ নামের হাইওয়েটি তিব্বতকে সংযুক্ত করেছে জিনজিয়াংকে। এখানেই এনগরিতে চীনাদের একটি বিমান ঘাঁটি আছে।
ঐতিহাসিকভাবে ১৯৬২ সালের যুদ্ধের আগে চীন মনে করত যে তিব্বত-জিনজিয়াঙ এনএইচ ২১৯ হাইওয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় সব ভূখণ্ড তারা নিরাপদ রেখেছে। বস্তুত ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর চীন একতরফাভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে দখল করা সব ভূমি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। এমনকি কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ আকসাই চিন থেকেও সরে যায়। সেটিই আজকের হটস্পটে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু এখন ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে চীন সন্দেহে রয়েছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তির পর লাদাখে ভারতের ফরোয়ার্ড পলিসি
ইউনাইটেড প্রগ্রেসিফ অ্যালায়েন্সের (ইউপিএ) আমলে ভারত লাদাখে ‘ফরোয়ার্ড পলিসি’ গ্রহণ করে। ২০১০-২০১৪ সাময় কালের ওই নীতির ফলে দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সামরিকিকরণ ঘটে।
আর তা ঘটে ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত পরমাণু চুক্তি সইয়ের পর। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ক মৌলিকভাবে বদলে যায়, ভারতের কৌশলগত হিসাব অন্য রকম হয়ে পড়ে।
এরপর মোদি সরকার আসার পর চীনের প্রতি ভারত পেশীশক্তি প্রদর্শন করতে থাকে। চীনকে ভয় পাওয়ানোর ভাষায় কথা বলতে থাকে।
এদিকে উগ্র-জাতীয়তাবাদী বক্তব্যে ভারত ছেয়ে যায়। ফলে ভারতের সাধারণ মানুষ মনে করতে থাকে যে ভারতের সামরিক বাহিনী চীনের সমকক্ষ হয়ে গেছে।
চীন পরাশক্তি : ভারতীয় বিশ্লেষকেরা কি তা বোঝে?
বস্তুত, এ ধরনের বিশ্বাস বিভ্রান্তিকর। চীন পরাশক্তি। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের শক্তি বাড়লেও চীন তার বাহিনীকে অনেক আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত করে ফেলেছে। এই বাহিনীর মোকাবিলা করা ভারতের সামর্থ্যের বাইরে।
এদিকে ভারতে প্রবাসী তিব্বত সরকারের উপস্থিতি, পাকিস্তান-অধিকৃত কাশ্মিরে আগ্রাসী দাবি, এক চীন নীতি বাতিলের কথা বলা, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরকে চ্যালেঞ্জ করা, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে কোয়াড শুরুর কথা বলার মধ্যে ভারতের দম্ভ কাজ করছিল।
চীনা লাল রেখা অতিক্রম : ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল?
অবশ্য চীনের লাল রেখা ভারত সরকার লঙ্ঘন করেছিল জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়াত্তশাসন বাতিলের অনুচ্ছেদ ৩৭০ রদ করা। এর ফলে মানচিত্রে কৌশলগত পরিবর্তন ঘটে যায়। চীন দুবার এর প্রতিবাদ করেছিল। এই পরিবর্তনের ফলে ভারতের রাস্তা নির্মাণের বিষয়টি নিয়ে চীন নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়।
এখন চীন যা করছে, তা কি তাদের ভূখণ্ডগত সম্প্রসারণকামী? কিন্তু এমন হলে আলোচনার কোনো সুযোগই থাকত না। তারা কিন্তু বারবার ভারতের সাথে আলোচনা চায় বলে জানাচ্ছে।
আবার এমনটা ভাবার কারণও নেই যে করোনাভাইরাসের কারণে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনটি ভাবার কোনোই অবকাশ নেই।
চীন কি পাকিস্তানের সাথে মিলে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এমন কোনো ভাবনা চীনের নেই।
তাহলে চীনের হিসাবে কী আছে? বিষ্ময়করভাবে বলা যায়, ভারতের বিশ্লেষণগুলোতে বোঝাই যায় না যে চীন দীর্ঘ এমন কিছু ভাবছে।
ভারত আসলে বুঝতে পারছে না সরকারের কথা ও কাজ চীন, ভারত বা বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশীরা কত গুরুত্ব দিয়ে নিচ্ছে।ভারত হয়তো ঢাকাকে বোঝাতে পারবে যে বাংলাদেশের নাগরিকদের আসলেই তারা ‘উইপোকা’ বোঝায় না।
কিন্তু চীনকে কি বোঝানো সম্ভব যে আকসাই চিনের ওপর দাবি স্রেফ ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রাধান্য বিস্তারের জন্য, এটা কঠিন কোনো বক্তব্য নয়?
কিন্তু চীন যখন দুবার জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়াত্তশাসন বাতিল নিয়ে দুবার প্রতিবাদ করেছে, তখন ভারত তাতে আমল করেনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোয়াড গঠনের তোড়জোর দেখিয়েছে।
গত ১৫-১৬ জুনে ভারতীয় সৈন্যদের নৃশংসভাবে হত্যার পর ভারতে প্রবল আবেগের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু এর পেছনে যে ভারতের চীনা নীতিই দায়ী, সেটা কিন্তু বোঝানো যাচ্ছে না। আর তা না বোঝানো গেলে, জনসাধারণের কাছ থেকে যৌক্তিক আচরণ পাওয়া যাবে না।
জনগণকে আসল বিষয়টি বোঝানোর দায়িত্ব সরকারের। অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করার ভারতের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে বলা যায়, এতে করে ভারত-চীন সম্পর্কে ক্ষতি হয়েছে।
গ্লোবাল ভিলেজ স্পেস