চীনের সাথে সমঝোতা করবেন মোদি!
মোদি - ছবি : সংগৃহীত
চীনের সাথে সীমান্ত সঙ্ঘাত নিয়ে গত ১৮ জুন দিল্লিতে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক খুব বেশি দিন স্থায়িত্ব পাবে না।
এসব উত্তেজনা ভারতের রাজধানীতে বসবাসকারী এলিটদের চর্চার বিষয়। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, যারা মোদির মন্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, তারা কোনো না কোনোভাবে এবং মোদির প্রতিটি কথা নিয়েই সমালোচনা করেন।
তারা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত – কংগ্রেস দল ও ওইসব বুদ্ধিজীবী, যারা বিজেবি সরকারের মতাদর্শ ও কঠোর নীতির কারণে সরে গেছেন।
এর সাথে আরেকটি ক্ষুদ্র অংশকে যোগ করা যেতে পারে। তারা চীনবিরোধী ও আমেরিকান পন্থী। এদের মধ্যে আছেন আমলা, অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তা, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, ও আমাদের থিঙ্ক ট্যাঙ্কারদের ঝাঁক।
১৮ জুনের সর্বদলীয় সম্মেলনে সনিয়া গান্ধী বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। আর মমতা ব্যানার্জি, শরদ পাওয়ার ও উদ্ধভ থ্যাকারের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিরা মূলত সরকারি অবস্থানের সমর্থক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন।
তবে ইতিবাচক দিক হলো, সনিয়া গান্ধী পর্যন্ত মোদির ওপর আক্রমণ চালালেও চীনের ওপর পাল্টা সামরিক আঘাত হানার কথা বলতে সতর্ক ছিলেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা হলো চীনের সাথে যুদ্ধ চাচ্ছে না ভারত।
এমনকি উত্তর প্রদেশ ও বিহারের সমাজতন্ত্রবিরোধী ও মার্কিনপন্থী মানসিকতার স্বঘোষিত সমাজবাদীরা পর্যন্ত চীনা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা জোর দিয়ে বলছেন না।
ভারত ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকে ও ১৯৬০-এর দশকের প্রথম দিকে বিরাজমান পরিস্থিতি থেকে এটি বড় ধরনের পরিবর্তন।
এর কারণ হলো ভারতে জোরালোভাবে এই ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারত জয়ী হতে পারবে না, অথচ তা হবে ভারতের ভবিষ্যতের জন্য বিপর্যয়কর। তাছাড়া চীনের ‘সফট পাওয়ার’ ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী দশকগুলোতে উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ভারতকে ছাড়িয়ে যাওয়া চীনের আর এখন কোনোভাবেই ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করার কারণ নেই। এখন চীনের লক্ষ্য আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় যথাযথ স্থান লাভ। অর্থাৎ এর মাধ্যমে তারা বিশ্বায়নের চালক হতে চায়, পাশ্চাত্যের সাথে প্রত্যাশিত সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে আলোচনা করতে চায়।
গত ৯ জুন ইইউ-চায়না স্ট্র্যাটেজিক ডায়ালগের পর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ/ভাইস প্রেসিডেন্ট যোশেপ বোরেল মন্তব্য করেছেন যে আমরা মনে হয় যে চীনকে পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী বিবেচনা করা হলে তেমন খারাপ মনে হবে না। আমাদের উচিত হবে চীনের কাছে আমাদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কথা বলা। অর্থনৈতিক বিষয়, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আমাদের কথা বলা দরকার।
তিনি বলেন, অনেক বিষয়ে আমাদের মধ্যে অভিন্ন অবস্থান আছে। উদাহরণ হিসেবে জেসিপিওএ, ইরান পরমাণু চুক্তির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার ব্যাপারে একই ধরনের আগ্রহ আছে উভয় পক্ষের। আবার চলমান অতিমারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিশ্বের প্রয়োজন বেশি বেশি সহযোগিতা, কম সঙ্ঘাত।
তিনি বলেন, আমাদের দুই পক্ষের মধ্যে একই ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেই। চীন তাদের ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলে, আমরা আমাদেরটার পক্ষে।তাছাড়া এটা স্পষ্ট যে চীনের একটি বৈশ্বিক আকাঙ্ক্ষা আছে। তবে একইসাথে আমি মনে করি না যে বিশ্ব শান্তির জন্য হুমকি সৃষ্টি হবে, এমন কোনো কাজ চীন করছে না। তারা বারবার বলছে যে তারা বৈশ্বিক ভূমিকা পালন করতে চায়। তবে তারা সামরিক ভূমিকা নয়, বা শক্তি প্রয়োগ করতেও চায় না, সামরিক সঙ্ঘাতেও যেতে চায় না। তাহলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতৈ আমরা কী বুঝব?
তিনি বলেন, বিষয়টিকে এভাবে বলা যায় যে অনেক সময় স্বার্থ ও মূল্যবোধ নিয়ে ভিন্নতা থাকে। এটা জীবনের অংশ। জীবনের বাস্তবতার কারণেই আমাদের সহযোগিতা করতে হবে। কারণ আমরা চীনের প্রবল সহায়তা ছাড়া জলবায়ুর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারব না। চীনের অংশগ্রহণ ছাড়া আমরা বহুপক্ষীয় বিশ্ব গঠন করতে পারব না। তবে চীন যে চীনের মতো করেই অংশগ্রহণ করবে, তা নয়। বরং এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এটিকে আমরা বলতে পারি পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
মোদিও সম্ভবত এই ধারণাতে বিশ্বাস করেন। চীন প্রশ্নে অ্যাঙ্গেলা মরকেল ও ইমানুয়েল ম্যাকোঁর ধারণাও সম্ভবত একই। মোদি বাস্তবতার আলোকেই চীনের উত্থানের সাথে ভারতের রাজনৈতিক অর্থনীতিকে একত্রিত করেছেন। আর তা করেছেন নেহরু ও তার পূর্বসূরীদের চেয়ে অনেক বেশি দক্ষতার সাথে।
তবে কাজটি সহজ হয়নি। ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টের নানা স্বার্থেন্বেষী গ্রুপের কারণে কাজটি খুবই জটিল।
আবার চীন প্রশ্নে মাঝামাঝি অবস্থান গ্রহণ করার ব্যাপারে কংগ্রেসের কাছ থেকে সহযোগিতার হাত প্রত্যাশা করাটা খুব বেশি চাওয়া হয়ে যাবে। মোদির কাছে সবচেয়ে সেরা বাজি হতে পারে ভারতের পুঁজিবাদের চীনা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদের প্রতি গোপন মুগ্ধতা।
গত কয়েক সপ্তাহে লাদাখে যা ঘটেছে, তাতে করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা খুবই কঠিন কাজ। তবে তা করতে পারবেন কেবল মোদিই। কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার মতো বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং আরো বিশেষ করে বলা যায়, তা জাতির কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা, ভারতের রাজনীতিতে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।
আমার মতে মোদির সবচেয়ে সেরা কৃতিত্ব হতে পারে বেইজিংয়ের সাথে সীমান্ত নিষ্পত্তি করা। আর এর মাধ্যমে মধ্য আয়ের দেশ ভারতকে এক বা দুই প্রজন্মের মাধ্যমে চীন আজ যেখানে আছে, সেখানে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা।
সূত্র : এসএএম