কালিতে কি ঢাকা পড়ে ২০ হাজার কোটি রুপি?
সুব্রত রায় - ছবি : সংগৃহীত
একজন মানুষ তার মনের ভাব কথোপকথনের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পারে, আবার কলম দিয়ে কাগজে লিপিবদ্ধ করেও ব্যক্ত করতে পারে। কথোপকথনের মাধ্যমে ব্যক্ত ভাবের স্থায়িত্ব ক্ষণকাল। অপর দিকে কলমে দিয়ে কাগজে লিপিবদ্ধ ভাবের স্থায়িত্ব দীর্ঘকাল। কলম দিয়ে লেখনীর কাজে যে দ্রব্যটি ব্যবহৃত হয় তা হলো কালি। কালি একটি রাসায়নিক পদার্থ। লেখনীতে আজকাল আগের মতো তরল কালির ব্যবহার নেই বললেই চলে। এখন সর্বত্র বলপয়েন্ট কলমের ব্যবহার। কালি শেষ হয়ে গেলে বলপয়েন্ট কলমের আর কার্যকারিতা থাকে না। তরল কালির কলমে কালি শেষ হওয়ার পর পুনঃকালি ভরার সুযোগ থাকায় নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত এ কলম কার্যকারিতা হারায় না।
বর্তমানে আমাদের চতুর্পাশে প্রাত্যহিক যা কিছু ঘটে তা আমরা প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সুবাদে অতিদ্রুত জানতে পারি। উভয় মিডিয়ায় তথ্য উপস্থাপনে কালির ব্যবহার অপরিহার্য, যদিও তা আর আগের মতো তরল কালি নয়। একজন মানুষের কুকীর্তি কালি দিয়ে প্রকাশের কারণে তিনি নিন্দিত আবার একজন মানুষের সুকীর্তি কালির দিয়ে প্রকাশের কারণে তিনি নন্দিত। নিন্দিত আর নন্দিতের দোলাচলে সমাজ বহমান।
কালি যে শুধু লেখনীর মাধ্যমে কলঙ্কিত বা উদ্ভাসিত করে তা নয়। কালির আরো অভিনব ব্যবহার আছে। আর এ অভিনব ব্যবহার দেখা গেল একদা ভারতের সর্বোচ্চ বিচারালয় সুপ্রিম কোর্টে। ভারতের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে ২০ হাজার কোটি রুপি আত্মসাতের অভিযোগে আটক এমএলএম (মাল্টিলেভেল মার্কেটিং) ব্যবসায়ী সাহারাসহ আরো বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের মালিক সুব্রত রায়কে মামলা শুনানি সংশ্লেষে সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে আনা হলে অকস্মাৎ মনোজ শর্মা নামক জনৈক আইনজীবী পুলিশবেষ্টিত অবস্থায় তার মুখে এক দোয়াত তরল কালি নিক্ষেপ করলে সম্পূর্ণ মুখাবয়ব কালি দিয়ে আবৃত হয়ে যায়। ভারতের মধ্য প্রদেশের ঐতিহাসিক স্থান গোয়ালিহর থেকে আগত সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী ইতোপূর্বে কমনওয়েলথ গেমস কেলেঙ্কারি মামলায় অভিযুক্ত কংগ্রেস সংসদ সদস্য সুরেশ কালমাদিকে জুতা ছুড়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থানের বিষয়টি দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
ভারতের শীর্ষ বিচারালয়ের একজন আইনজীবী পরপর দু’টি ঘটনায় আইনকে সমুন্নত রাখার পরিবর্তে কেন নিজের হাতে তুলে নিয়ে আদালতের সিদ্ধান্তের আগেই অন্যায়ের প্রতিবিধানে সচেষ্ট হলেন এ প্রশ্নে বিচারাঙ্গনের সাথে সংশ্লিষ্টদের মধ্য থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা খুবই হতাশাজনক। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, অর্থের শক্তির কাছে আজ ন্যায়, নীতিকথা, বিচার সব কিছুই পদদলিত। আর এ আশঙ্কা থেকেই বিচারে কী হয় তা দেখার জন্য অপেক্ষা না করে মনোজ শর্মার এ অভিনব প্রতিবাদ।
সুব্রত রায় ভারতের সাহারা গ্রুপ অব কোম্পানিসহ অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক। সাহারা গ্রুপের ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বিমান পরিবহন, আবাসন, পোশাক পণ্যসহ নানাবিধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। সুব্রত রায় হতদরিদ্র পরিবার থেকে আগত এবং অতি সাধারণ অবস্থা থেকে ফুলেফেঁপে তার ব্যবসা আজ ভারতজুড়ে বিস্তৃত। সুব্রত রায়ের ব্যবসায়িক সাফল্যের পেছনে যে ব্যবসাটি প্রধান অর্থের জোগান দিয়েছে তা হলো এমএলএম ব্যবসা। এ ব্যবসাটি থেকে লাভের প্রলোভনে পড়ে ভারতের লক্ষ-কোটি সাধারণ মানুষ যখন নিজেদের সঞ্চিত অর্থের সবটুকু প্রতিষ্ঠানটির হাতে তুলে দিলেন, তখন জানা গেল অভিনব উপায়ে প্রতারণা ও ফাটকাবাজির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের নানাবিধ কলাকৌশল।
এ ধরনের এমএলএম ব্যবসার সাথে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষও কমবেশি জড়িত এবং ভারতের সাধারণ মানুষের মতো তারা প্রতারণার ফাঁদে পড়ে আজ সর্বস্বান্ত। আমাদের দেশের যেসব এমএলএম ব্যবসায়ীকে আইনের আওতায় এনে বিচারে সম্মুখীনের আয়োজন চলছে তাদের নেতৃস্থানীয়রা কারাবন্দী হলেও অসুস্থ না হওয়া সত্ত্বেও ভিআইপি মর্যাদায় পিজি হাসপাতালে প্রিজন সেলে দিব্যি আরাম-আয়েশের সাথেই দিনাতিপাত করছেন।
সুব্রত রায় আটক হলেও একজন সাধারণ আসামিকে আটকাবস্থায় যেভাবে কারা অভ্যন্তরে থাকতে হয় এবং আদালতে হাজিরা সংশ্লেষে প্রিজন ভ্যানে করে জেলখানা থেকে আদালতে আনানেয়া করা হয় তার ক্ষেত্রে এখনো সেটি ঘটেনি। তাই অনেকে বলেন, ভারতের আইনও সুব্রত রায়ের কাছে অসহায়।
আটকাবস্থায় তাকে রাখা হয়েছে ভিআইপি রেস্টহাউসে এবং একস্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়ার সময় রাত যাপনের প্রয়োজন দেখা দিলে তাকে রাখা হয় পাঁচতারকা হোটেলে। তার পরিবহনে নিয়োজিত রয়েছে মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ির বহর। যদিও আটককালীন আবাসন ও পরিবহন সংক্রান্ত ব্যয় সুব্রত রায়ের প্রতিষ্ঠান বহন করছে কিন্তু সে ক্ষেত্রে ভারতের সাধারণ জনগণের প্রশ্ন সাধারণ অপরাধী এবং সুব্রত রায়ের ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ সমরূপ নয় কেন? আর সমরূপ না হয়ে থাকলে তাতে কি ভারতের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত আইনের দৃষ্টিতে সমতাÑ এ মৌল নীতিটির লঙ্ঘন হচ্ছে না?
সুব্রত রায় বছর কয়েক আগে এক লাখ কোটি রুপি বিনিয়োগের প্রস্তাব নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে আগমন-পরবর্তী সাংবাদিকদের তিনি বলেছিলেন তার মাতুলালয় রাজধানী শহর ঢাকার নিকটবর্তী মুন্সীগঞ্জ জেলায় এবং সে কারণে তিনি বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। বিনিয়োগ প্রস্তাব উপস্থাপনকালীন তিনি সরকারকে অনুরোধ করেছিলেন ঢাকা শহরের সন্নিকটে তাকে যেন এক লাখ একর ভূমি আবাসন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়ার কারণে এখানে ভূমির তীব্র সঙ্কট এবং সরকার সুব্রত রায়কে ভূমি অধিগ্রহণ করে দিতে সম্মত হলেও এক লাখ একর ভূমি সংস্থান যে দুরূহ তা খুব সহজেই বোধগম্য। এখানে প্রাসঙ্গিক যে, আবাসন শিল্প খাতে আমাদের আবাসন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষমতা অর্জন করেছে এবং বিগত ৩০ বছর ধরে তারা রাজধানী ঢাকা শহরসহ বিভিন্ন জেলা শহরে তাদের কর্মপরিধি বিস্তৃত করে নান্দনিক বহুতলবিশিষ্ট আবাসিক, বাণিজ্যিক ও বিপণিবিতান নির্মাণে সফলতা পেয়ে আসছেন। বাংলাদেশের আবাসন শিল্প উদ্যোক্তারা বলতে গেলে সক্ষমতার বিচারে শতভাগ সফল। সুব্রত রায় আমাদের আবাসন শিল্প খাতে যে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছেন তার চেয়ে আকর্ষণীয় প্রস্তাব দেয়ার যোগ্যতা আমাদের আবাসন শিল্প খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো রাখেন। তাই দেখা গেল সুব্রত রায় প্রস্তাব দেয়া পরবর্তী আমাদের আবাসন শিল্প খাতের মালিকদের পক্ষ থেকেও সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছিল তাকে যদি একান্তই বিনিয়োগের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে এমন সব খাতের ক্ষেত্রে দেয়া হোক যে সব খাতে আমরা পশ্চাৎপদ ও অনগ্রসর। সুব্রত রায় কেন বাংলাদেশে এসে এমন একটি খাতে বিনিয়োগের প্রস্তাব করলেন যে খাতে আমরা শুধু দেশেই সক্ষম নই বরং এ সক্ষমতাকে পুুঁজি করে বিদেশেও নিজেদের সামর্থ্য প্রমাণের যোগ্যতা রাখি।
সুব্রত রায়ের বিনিয়োগ প্রস্তাবের ব্যাপারে আমাদের দেশের সচেতন জনগোষ্ঠী এবং আমাদের সংবাদকর্মীরা সজাগ থাকার কারণে সরকারের অভ্যন্তরে যে ক্ষুদ্র মহলটি তাকে বিশেষ বাণিজ্যিক সুবিধা দিতে চেয়েছিলেন তারা সফল হতে পারেননি। কিন্তু এ ধরনের একজন বিতর্কিত ব্যবসায়ী কী করে আমাদের দেশে এসে সরকারের শীর্ষ নির্বাহীর সাক্ষাৎ পেলেন এবং সাক্ষাৎ দেয়ার পেছেনে কারা কলকাঠি নেড়েছেন তাদের মুখোশ জনসম্মুখে উন্মোচিত হওয়া উচিত। তা ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী কোন ব্যক্তির পুত্র সুব্রত রায়ের প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশস্থ স্থানীয় প্রতিনিধি এ বিষয়টিও দেশবাসীর জানা প্রয়োজন।
ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতার কথা আলোচনায় এলে যে খেলাটির নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তা হলো ক্রিকেট। ক্রিকেটে আমাদের খেলোয়াড়রা বিভিন্ন সময়ে দেশের জন্য দুর্লভ সম্মান বয়ে এনেছেন। কিন্তু আজ আমাদের দেশের জনগণ অত্যন্ত দুঃখ-ভারাক্রান্ত এ কথা ভেবে যে, আমাদের ক্রিকেট খেলোয়াড়রা ভারতের বিতর্কিত এমএলএম ব্যবসায়ী সুব্রত রায়ের প্রতিষ্ঠান সাহারার নাম সম্বলিত জার্সি পরে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। সুব্রত রায়ের ব্যাপারে ভারতের সংবাদমাধ্যমে যে খবর প্রচারিত হয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে আমাদের ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) আগেই ভাবা উচিত ছিল আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল ভিনদেশী একটি বিতর্কিত প্রতিষ্ঠানের নাম সম্বলিত জার্সি পরিধান করবে নাকি দেশী বা বিদেশী নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম সম্বলিত জার্সি পরিধান করবে? উল্লেখ্য, ইতঃপূর্বে আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দল আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন কোমল পানীয় প্রতিষ্ঠানের নাম সম্বলিত জার্সি পরিধান করে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের এমন অনেক ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানি, শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে যাদের নাম সম্বলিত জার্সি বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পরিধান করলে তারা গর্ববোধ করবেন। কিন্তু তাদেরকে সে সুযোগ হতে বঞ্চিত করে কেন ভারতের বিতর্কিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিককে এ সুযোগটি দেয়া হয়েছিল তা ভেবে দেশবাসী উদ্বিগ্ন।
চূড়ান্ত বিচারে সুব্রত রায়ের কী হবে ভারতের বিচারব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতার কারণে তা সে দেশের মানুষের অজানা। কিন্তু আইনজীবী মনোজ শর্মা সুব্রত রায়ের মুখাবয়ব কালির কালিমায় আবৃত করে অন্যায়ের প্রতিবিধানে যে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তা অন্যায়কে মনে-প্রাণে ঘৃণা করেন ভারত ও ভারতের পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহের এমন লক্ষ-কোটি মানুষের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এ দৃষ্টান্তটি যাদের ক্ষেত্রে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে তাদের জন্য আশা উদ্দীপক। আর তাই প্রতারণা ও ফটকাবাজির শিকারে সর্বস্বান্ত হয়ে হতাশার অতল গহ্বরে নিমগ্ন কেউ যদি আইনকে নিজের হাতে তুলে নিয়ে আমাদের দেশে অনুরূপ ঘটনা ঘটায় তাতে অবাক হওয়ার কিছু কি আছে?
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail: iktederahmed@yahoo.com