ভারতের বিরুদ্ধে নেপালে কেন ক্ষুব্ধ
নেপালের প্র্রধানমন্ত্রী ওলি - ছবি : সংগৃহীত
নেপালের গত বৃহস্পতিবার নতুন ভূখণ্ডগত মানচিত্র অনুমোদন করার ফলে ভারতের সাথে দেশটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সঙ্কটের বিষয় প্রকট হলো। চীন যখন এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে, তখন এই তিক্ততা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
গত সোমবার বিরোধপূর্ণ সীমান্তে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যরা পাথর ও রড দিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এতে ভারতের ২০ সৈন্য মারা যায়। নেপাল এ ব্যাপারে কোনো শোক প্রকাশ করেনি।
বরং এর তিন দিন পর দেশটির রাষ্ট্রপতি ও পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ বর্তমানে ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকা কালাপানি অঞ্চলের ৬২ বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিজের ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করে তৈরী একটি মানচিত্র অনুমোদন করেছে।
এর আগে ভারত মানচিত্রটি প্রত্যাখ্যান করে একে অযৌক্তিক দাবি হিসেবে অভিহিত করেছিল। তবে নেপালের আইনমন্ত্রী শিব মায়া তুমবাহাম্বে বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে বলেন, এই এলাকা যে নেপালের সে ব্যাপারে তাদের হাতে পর্যাপ্ত প্রমাণ আছে।
দ্বিপক্ষীয় এই উত্তেজনা আরো তীব্র করে নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল পূর্ণ চন্দ্র থঅপা বুধবার ভারত-নেপাল সীমান্তের কালাপানি-সংলগ্ন এলাকা পরিদর্শন করেন।
এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করলেও নেপালের নতুন মানচিত্র অনুমোদন ভারতের জন্য উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। আর এই প্রেক্ষাপটে নয়া দিল্লি সম্ভবত পর্দার অন্তরালে কাঠমান্ডুর সাথে আলোচনা করছে।
সোমবার চীনা ও ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যেকার সহিংস ঘটনার ফলে নয়া দিল্লি এখন কাঠমান্ডুর সাথে তার সম্পর্ক যাতে আরো অবনতিশীল না হয়, সে ব্যাপারে তৎপর হয়ে ওঠে। অবশ্য নেপালের দাবি ভারত মেনে নেবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ কালাপানি এলাকাটি ভারত-নেপাল-চীন সীমান্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত।
নেপাল ও ভারতের মধ্যে দুই শ’ বছর ধরে সীমান্ত বিরোধ থাকলেও দেশ দুটির মধ্যে উন্মুক্ত সীমান্ত বিরাজ করছে। ১৮১৬ সালে নেপাল ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে সুগুইলি চুক্তির মাধ্যমে মহাকালি নদীটিকে দুই দেশের মধ্যকার সীমান্ত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ভারত বা নেপালের কেউ এই নদীর অবস্থান প্রশ্নে একমত নয়।
তবে এখনকার মতো উত্তেজনা কখনো হয়নি। ২০১৩-২০১৭ পর্যন্ত নেপালে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকারী অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত রনজিত রাই বলেন, বিষয়টি কূটনৈতিক পর্যায়ে উত্থাপিত হলেও কোনো পক্ষই তেমন সক্রিয়ভাবে তাদের দাবি জানায়নি।
কিন্তু ২০১৫ সালে নেপালের ওপর ভারতের দুই মাসের অঘোষিত অর্থনৈতিক অবরোধের ফলে তাদের মধ্যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয়। এই সময় নেপালে খাদ্য ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়া হলে দেশটিতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
দুই দেশের সম্পর্কে অবশ্য সমমাত্রিক অবস্থা নেই। ২৯ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির দেশ নেপাল অনেকাংশে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলারের ভারতের ওপর নির্ভরশীল। ২০১৭-১৮ সময়কালে ভারত থেকে নেপাল আমদানি করেছিল ৭.৩৯ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পণ্য, আর ভারতে রফতানি করেছিল ৪২০ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। ফলে ওই অবরোধ নেপালকে বেশ কঠিন অবস্থায় ফেলেছিল।
আগস্টে জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার পর গত নভেম্বরে ভারত তাদের নতুন ভূখণ্ডগত মানচিত্র প্রকাশ করে। এতে কালাপানি অঞ্চলকে ভারতীয় ভূখণ্ড বলে দেখানো হয়।
কাঠমান্ডুভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক নেপাল ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন অ্যান্ড এনগেজমেন্টের গবেষণা পরিচালক ড. প্রমোদ জয়সাল বলেন, ভারতের এই মানচিত্রই বর্তমান অচলাবস্থার সৃষ্টি করেছে। এরপর থেকে নেপাল আর তাদের দাবি ছাড় দিতে নারাজ। ভারতের পথই অনুসরণ করছে নেপাল।
গত মে মাসে ভারত ও চীনের মধ্যে সীমান্ত উত্তেজনা দেখা দেয়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং নেপালের দাবি করা কিছু অংশের মধ্য দিয়ে ৮০ কিলোমিটার একটি রাস্তার উদ্বোধন করেন। ভারত অবশ্য দাবি করে, তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য এই রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে।
নেপালে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত রাকেশ সুদ (২০০৮-২০১১) বলেন, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্ম ওলি একে ভারতকে টার্গেট করার ও তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে একে গ্রহণ করেছেন। তিনি দলীয় অন্তঃকোন্দল দমাতে এবং প্রশাসনিক ঘাটতি থেকে দৃষ্টি ফেরাতেও এটি ব্যবহার করছেন।
এই অঞ্চলে চীনা প্রভাব বাড়ার প্রেক্ষাপটে ভারতের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হারে সবর হচ্ছে নেপাল। অনেকেই মনে করছে, নেপালের ঘরোয়া রাজনীতেও চীন এখন বেশ সক্রিয়।
নেপালের দৃঢ়তা, চীনের সাথে সীমান্ত বৈরিতা আর পাকিস্তানের সাথে চলমান উত্তেজনার ফলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ভণ্ডুল হয়ে যেতে বসেছে। চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার মতো কৌশলগত দেশে নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল ভারত। আবার মোদি প্রশাসনের হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডার ফলে মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে ভারতকে।
সাবেক কূটনীতিক রাই মনে করেন, ভারতের উচিত হবে নেপালের সাথে তার সম্পর্ক নতুন করে মূল্যায়ন করা। নেপালে চীনা প্রভাব বৃদ্ধি ভারতের অনুকূল হবে না।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট