কাশ্মির নিয়ে খেলার সুযোগ যেভাবে পেল চীন
কাশ্মির নিয়ে খেলার সুযোগ যেভাবে পেল চীন - ছবি : সংগৃহীত
কাশ্মির উপত্যকা ও এর আশপাশের এলাকা হলো ১৯৪৭, ১৯৪৫ ও ১৯৯৯ সালের তিন যুদ্ধসহ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার প্রতিটি সঙ্ঘতের কেন্দ্রবিন্দু। উপনিবেশবাদ এই সমস্যা সৃষ্টি করলেও পরাশক্তিগুলোর এ ব্যাপারে আগ্রহ আছে সামান্যই, ব্রিটেন যত দ্রুত পেরেছে, হাত ধুয়ে ফেলেছে। কিন্তু গত বছরের কাশ্মিরের আধা স্বায়ত্তশাসনবিষয়ক অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করার পর একটি পুরনো খেলোয়াড়কে আরো শক্তিশালী ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিয়েছে। এই দেশটি হলো চীন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে চলতি সপ্তাহের রক্তাক্ত সঙ্ঘাতের পর চীনের উচ্চাভিলাষ বৈশ্বিক উদ্বেগের কারণ হলেও সেটা তার নিজের সীমান্ত ছাড়িয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত। কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতীয় রাজনীতিবিদেরা বলে আসছে যে কাশ্মির হলো পুরোপুরি স্থানীয় ইস্যু। এই সমস্যার মূলে রয়েছে রাজ্যটির উৎস। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যটির হিন্দু রাজা শুরুতে দোটানায় থাকলেও পরে পক্ষ বেছে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু মুসলিমদের আবাসভূমি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই রাজ্যটিকে হারানো ছিল একটি বিরাট বিপর্যয়। আর ভারতীয় নেতার অধীনে থাকা একটি মুসলিম রাজ্যের ধারণাটি তাদের বহুত্ববাদী আদর্শের জন্য খুবই সহায়ক হয়েছিল। রাজ্যটি এখনো ভারতের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এর লোকজন অসন্তুষ্ট, প্রতিবেশী ক্রুদ্ধ।
যুদ্ধে ভারত জয়ী হলেও ইস্যুটির মীমাংসা হয়নি। ভারতীয় নেতারা বিলাপ করলেও ১৯৪৭ সাল থেকে এটি আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়েই আছে।
পাকিস্তান ইস্যুটিকে আন্তর্জাতিকীরণে খুবই আগ্রহী। আর চীনের দীর্ঘ দিনের মিত্র চীনও তা চায়। আর ১৯৬৩ সালের চীন-পাকিস্তান চুক্তির মাধ্যমে দেশ দুটি তাদের সীমান্ত ইস্যুগুলোর মীমাংসা করে ফেলে। এর ফলে ইসলামাবাদ ও বেইজিং কেবল তাদের মধ্যকার বিরোধই মেটায়নি, সেইসাথে কাশ্মির প্রশ্নে চীনকে আরো বড় করে নিয়ে আসা হয়। ওই চুক্তির বলে পাকিস্তান ট্রান্স-কারাকোরাম ট্র্যাক্টটি চীনকে দিয়ে দেয়। এটি অত্যন্ত বন্ধুর হলেও বিরোধপূর্ণ এলাকা ছিল। ভারত যুক্তি দেয় যে, এই এলাকাটি চীনের কাছে দিয়ে দেয়ার কোনো অধিকার পাকিস্তানের নেই। ভারত এখনো এই এলাকার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ দাবি করে থাকে।
পাকিস্তান ১৯৬৩ সালের পর স্বাভাবিকভাবেই চীনের সাথে সম্পর্ক জোরদার করে। এর এক বছর আগে চীনের সাথে যুদ্ধে হেরে যায় ভারত। এর মাধ্যমে চীন-ভারত ভ্রাতৃত্ববোধ চির দিনের জন্য হারিয়ে যায় আর পাকিস্তান একে একটি সুযোগ হিসেবে নেয়। দ্বিপক্ষীয় বিরোধকে ত্রিপক্ষীয় ইস্যুতে পরিণত করতে পারাটা একটি দারুণ বিষয়।
এতে ফল আসে। ভারতের নিজের সিদ্ধান্তেও প্রভাব ফেলে। ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করাটা ছিল বিজেপির দীর্ঘ দিনের লক্ষ্য। ২০১৯ সালে তারা পার্লামেন্টের ভোটাভুটির মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সময় তারা ওই অঞ্চলে ব্যাপক দমনপীড়ন চালায়। ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন, স্থানীয় রাজনীতিবিদদের গ্রেফতারের মতো ঘটনাও ঘটনানো হয়। এছাড়া রাজ্যটিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে কেন্দ্র-শাসিত এলাকায় পরিণত করা হয়।
এতে পাকিস্তান ক্রোধে ফেটে পড়ে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান এর তীব্র সমালোচনা করেন। কিন্তু ভারতের পদক্ষেপের ফলে নতুন সমস্যা সৃষ্টি হয়। এত দিন কাশ্মির ছিল বাফার স্টেট। এখন কেন্দ্র-শাসিত এলাকায় পরিণত হওয়ায় অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল।
চীন এই ইস্যুর প্রতি গভীরভাগে আগ্রহী হয়ে ওঠে।চীন কূটনৈতিক ও ঘরোয়া- উভয় কারণেই এ ব্যাপারে সচেতন হয়ে পড়ে। এর একটি কারণ হলো, চীনকে পাকিস্তান যে এলাকাটি দিয়েছিল, তা লাদাখের অংশ। চীন মনে করে, অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করে নতুন এলাকা সৃষ্টি একটি আগ্রাসী পদক্ষেপ। এ কারণেই গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চীন-ভারত সীমান্তে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে বেইজিং।
ভারতীয় পদক্ষেপের ফলে চীনকে এখন জিনজিয়াং অঞ্চল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। উইঘুর মুসলিমদের প্রতি আচরণের কারণে সারা বিশ্বে নিন্দিত চীন। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি দেশ এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে। মুসলিম বিশ্বে উইঘুর মুসলিমদের প্রতি আচরণের জন্য চীনা ইমেজে বেশ কলঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে।
এখন অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিলের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের সাথে একমত হয়ে এবং নিজের মুসলিমবিরোধী অবস্থান আড়াল করতে এই সুযোগটি কাজে লাগাচ্ছে চীন। মুসলিমদের প্রতি দিল্লির অসদাচরণের বিষয়ীট সামনে এনে চীন তার জনগণের প্রতি করা দমনপীড়ন থেকে নজর সরিয়ে নিচ্ছে। কাশ্মিরে তার অবস্থান বেশ ভালো কাজে দিয়েছে।
ফরেন পলিসি