আমেরিকান থিংকট্যাংক কেন ভারতে?
আমেরিকান থিংকট্যাংক কেন ভারতে? - প্রতীকী ছবি
কথাগুলো মনে হলো জয়িতা ভট্টাচার্যের একটা রচনা দেখে। যেন তিনি সেই ঝড়ের সময় সবার আম ফেলে দেয়া ছোট মেয়েটা। জয়িতা ভারতের ‘ওআরএফ’ মানে অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন নামে এক থিংকট্যাংকের ফেলো। সম্ভবত আসামের শিলচরের মেয়ে, আসাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে পিএইচডি।
আমেরিকান সমাজের পলিটিক্যাল কালচারে রাষ্ট্র-সরকারের নীতিনির্ধারণে বা পলিসি সাব্যস্ত করার জন্য পক্ষবিপক্ষের পয়েন্টগুলো জোরালো করে তুলে ধরতে গবেষণা বা কনসেন্সাস তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কাজটা আমেরিকান সমাজ ওই থিংকট্যাংক ধরনের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই করে থাকে। এমন প্রতিষ্ঠানগুলো সাধারণত দাতব্য প্রতিষ্ঠান বা নন-প্রফিট ফাউন্ডেশন টাইপের কাঠামোর হয়ে থাকে। যদিও একটা দুর্ভাগ্য যে, একালে এসে লক্ষ করা যাচ্ছে অনেক সময় থিংকট্যাংক গড়ার নামে প্রপাগান্ডা প্রতিষ্ঠান গড়া ফ্যাশন হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে আমেরিকা এ কাজে বিপুল অর্থ ঢালতে শুরু করার পর থেকে। এমনিতেই আরেক দেশের অর্থে থিংকট্যাংক গড়া- এটা থিংকট্যাংক ধারণার মৌলিক ভিত্তিরই বিরুদ্ধে। কারণ থিংকট্যাংক তো গড়া হবে নিজ দেশেরই নীতি-পলিসি নিয়ে স্টাডি গবেষণার জন্য। কাজেই এ খাতে অন্যে যেচে অর্থ দিতে আসা মানে এতে দাতাদেশের সরাসরি স্বার্থ ও চিন্তায় প্রভাব ছড়ানো শুধু নয়, এটা প্রায় তার ফরেন পলিসির বাস্তবায়ন। সোজা কথাটা হলো, চীন-ভারত যেন দূরে থাকে; প্রতিদ্বন্দ্বিতায় থাকে, ঈর্ষায় থাকে এটা আমেরিকান স্ট্র্যাটেজি।
আমেরিকার গ্লোবাল অর্থনৈতিক সামর্থ্য বা সক্ষমতায় পতন আর চীনের উত্থানের একালে এটাই যুক্তরাষ্ট্রের ভয় যে চীন-ভারত যেন আমেরিকান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আগামীর নেতৃত্ব হয়ে একজোটে দাঁড়িয়ে না যায়। ফলে এর সোজা হিসাব হলো, চীন-ভারত যেন রেষারেষির সম্পর্কে খাড়া হয়ে যায়। আর এখানে সবচেয়ে বড় ইনপুট যেটা তা হলো, ২০৫০ সাল নাগাদ ভারতের অর্থনীতি নাকি সবার চেয়ে উপরে যাবে এমন কথা ছড়িয়ে রাখা আছে। আর তাই বাস্তবতার সাথে মিল না পেলেও ‘যদি লাইগা যায়’ এই লোভে ভারত চীনের সাথে সহযোগিতামূলক পদক্ষেপ নিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে একধাপ আগালে তিনধাপ পিছিয়ে যায়। এ কাজগুলোই নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে করে যাচ্ছে আমেরিকার কিছু থিংকট্যাংক ভারতে এর শাখা খুলে।
আবার এটাও খুবই সম্ভব যে বিরাট কিছু হওয়ার লোভে আমেরিকান পরামর্শের ফাঁদে পড়ে ভারত কিছুই হতে পারল না। বরং ডানে-বায়ে চীনের বিরোধিতা করতে গিয়ে যেটুকু হওয়ার ভারতের সম্ভাবনা ছিল সেটুকুও ভেসে গেল। এটা অসম্ভব নয়। আমেরিকা যেমন চীনকে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে তেমন ভারতের কাছেও নিশ্চয় হারতে চাইবে না। এ কথাটা ভারত কোনো আমলই করে না। বরং ধরে নিয়েছে আমেরিকা তার বন্ধু থাকবে। এসব কারণেই ভারতের কিছুই না হয়ে, কোনো উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক শক্তি হয়ে না ওঠার সম্ভাবনাও প্রবল। যার প্রধান কারণ ভারতের অভ্যন্তরীণ গঠন দুর্বলতাÑ কেন্দ্র বনাম রাজ্যের দ্বন্দ্ব। এক রাজ্য আরেক রাজ্যের ঘাড়ে উঠে থাকা।
ভারতের বিপুল এক ভোক্তা জনগোষ্ঠী আছে, যা তার নিজের জন্যই (চীনের মতোই) এক বিরাট রেডি বাজার। এ ফ্যাক্টর ছাড়া ভারতের সব কিছুই নেগেটিভ। কাজেই কনস্ট্রাকটিভ আর পজিটিভ এটিটিউড লাগবে। অন্যের ক্ষতি করে বেড়ানো কারও জীবনের লক্ষ হতে পারে না। এটি সবার আগে ভারতকে বুঝতে হবে।
ভারতে খোলা আমেরিকান থিংকট্যাংকের শাখাগুলো আবার কাঠামোর দিক থেকে বিদেশী এনজিও। আর ওদের বড় অফার হলো ভারতীয় স্টুডেন্ট-একাডেমিকদের পিএইচডি বা মাস্টার্স বিদেশে পড়তে স্কলারশিপ দেয়া। এছাড়া ভারতে বা জাপানে বসে চীনা তৎপরতার এটা বা সেটা খারাপ, তাদের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য খারাপ এসব প্রমাণিত হয় যাতে এমন ক্যাম্পেইন-মূলক গবেষণা স্টাডিতে এনগেজ করা। ২০০৬ সালে বুশের ভারত সফর থেকে এ ধারা শুরু হয়ে ওবামার আমলে তুঙ্গে উঠেছিল ডালপালা বিছিয়ে। কিন্তু ট্রাম্পের আমলে এসে ২০১৭ সাল থেকে তার জাতিবাদী আধাখেচড়া ধারণার ধাক্কায় আগের প্রায় সব অর্থ বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যায়, ভারতকে দেয়া আমেরিকায় বিশেষ রফতানি সুবিধা (যেন চীনবিরোধী হওয়ার বুকিং মানি) যা কিছু আগে দেয়া হয়েছিল সব গুটিয়ে ফেরত নেয়া হয়। সারকথা ট্রাম্পের আমেরিকা এ ব্যাপারে হতাশ ও হয়রান। থিংকট্যাংক এনজিওগুলো তাই ট্রাম্প আমলে এসে ফান্ড অনেক গুটিয়ে ফেলেছে। তবে চীনা ঋণের ফাঁদ, চীনা ঋণের শোষণ ইত্যাদি এসব ক্যাম্পেইনগুলো এ ধরনের থিংকট্যাংকগুলোর প্রপাগান্ডামূলক কাজের অংশ। তবে ওআরএফ একমাত্র ব্যতিক্রম। এটাও দাতব্য, তবে মুখ্যত স্থানীয় ব্যবসায়ী রিলায়েন্স গ্রুপেরই অর্থে পরিচালিত। কিন্তু সবচেয়ে কমন দিকটা হলো, ওআরএফসহ সব থিংকট্যাংক পরিচালিত হয় ওই একই নীতিতে অভিমুখে। আমেরিকার তৈরি অভিমুখ। আমেরিকান মাদার থিংকট্যাংকগুলোতে বসে যেসব যুক্তি বয়ান তৈরি হয় সেগুলো সারা ভারতের সব থিংকট্যাংক আউড়িয়ে যেতে থাকে। তবে লক্ষণীয় যে সরকার বেশির ভাগ সময়ই নিজের সরকারি ভাষ্য বা অবস্থানে ওইসব বয়ানকে জায়গা দেয় না। এর সম্ভাব্য মূল কারণ, এই চীনের সাথেই তো ভারত সরকারের যৌথভাবে ব্রিকস ব্যাংক, অথবা সাংহাই কর্পোরেশন অর্গানাইজেশন ধরনের জোট তৎপরতায় অংশ নিয়ে থাকতে হয়।