পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন মোদি? ৫টি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন
নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগৃহীত
লাদাখে চীনা সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষে ২০ ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়া ও চীনা হেফাজত থেকে ১০ ভারতীয়কে মুক্তি দেয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ভারতে কোনো অনুপ্রবেশ বা ভারতীয় কোনো চৌকি দখলের ঘটনা ঘটেনি।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির ফলে বেশ কিছু প্রশ্ন জেগেছে ভারত-চীন বিরোধপূর্ণ সীমান্তজুড়ে প্রকৃত অবস্থা নিয়ে।
মোদি বলেছেন, আমাদের সীমান্তে কেউ অনুপ্রবেশ করেনি, বর্তমানে কেউ অনুপ্রবেশ করছে না, কারো হাতে আর কোনো ভারতীয় চৌকিও দখলে নেই। লাদাখে আমাদের ২০ সৈন্য মারা গেছে, তবে যারা ভারত মাতার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিল, তাদের শিক্ষা দেয়া হয়েছে।
সরকারিভাবে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে মোদির মন্তব্যের অংশটি বাদ দিয়ে বলা হয়েছে, শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার করেন যে আমাদের ভূখণ্ডের ভেতরে কেউ নেই বা আমাদের চৌকি কেউ দখল করেনি।
সংঘর্ষ নিয়ে মোদির সরাসরি বক্তব্যের পর কয়েকটি প্রশ্ন জেগেছে।
মোদি কি বলছেন যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভুল বুঝেছিল বা মিথ্যা বলছিল?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইয়ির টেলিফোন সংলাপের পর এক বিবৃতিতে বলেছিল, চীনা পক্ষ লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের (এলএসি) আমাদের অংশের গালওয়ান উপত্যকায় একটি কাঠামো নির্মাণ করতে চেয়েছিল।
এই বক্তব্যে স্পষ্টভাবেই মনে হতে পারে যে তারা কাঠামো নির্মাণেল জন্য ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিল। এর আগেও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে বিবৃতি দিয়েছিল, তাতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল যে চীনা পক্ষ একতরফাভাবে স্থিতিবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করেছে।
মোদি জোর দিয়ে বলেছেন যে চীনারা ভারতীয় ভূমিতে অনুপ্রবেশ করেনি। সেটিই যদি ঠিক হবে তবে তারা কিভাবে স্থিতিবস্থা পরিবর্তনের চেষ্টা করল? আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিভাবে বলল যে এলএসির আমাদের অংশ একটি কাঠামো নির্মাণ করার চেষ্টা করছে? মোদি কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তৃব্য বাতিল করে দিলেন?
চীনারা কি বর্তমানে ওই এলাকা দখলে রেখেছে যেখানে আগে টহল দিত ভারতীয় সৈন্যরা?
মোদির বিবৃতি যদি সংশয়ের দৃষ্টিতে পাঠ করা হয়, তবে এই উপসংহারে পৌঁছা যায় যে ‘সীমান্ত’ শব্দটি ব্যবহার করে তিনি পরিকল্পিতভাবে দ্ব্যর্থবোধকতার পরিচয় দিয়েছেন।
এলএসি একটি সাংঘর্ষিক ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে প্রকৃতপক্ষে চীন ও ভারত উভয় পক্ষই বিশ্বাস করে যে সীমান্ত চিহ্নিত অবস্থায় নেই। এখানে দুই পক্ষই সীমান্তের কোনো রেখার ব্যাপারে একমত নয়। ফলে ভারত এলএসিকে চিহ্নিত করতে পারে এভাবে যে যতটুকু এলাকায় ভারতীয় সৈন্যরা টহলে যেতে পারে, ততটুকুই ভারতীয় এলাকা।
বিভিন্ন মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, চীনা সৈন্যরা এখন এমনসব এলাকায় টহল দিচ্ছে, যেখানে অতিসাম্প্রতিক কালেও ভারতীয় সৈন্যলা টহল দিত। এসব খবরে বলা হয়, আগে ভারতের বলে দাবি করা প্রায় ৬০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা এখন চীনের দখলে চলে গেছে।
মোদি কি জোর দিয়ে বলছেন যে এসব প্রতিবেদন অসত্য? এখন ভারত সরকারের অবস্থান কি এই যে চীনারা আমাদের ভূখণ্ড দখল করতে আসেনি যা আগে ভারত টহল দিত?
কিংবা ‘এলএসির ভিন্ন ভিন্ন ধারণা’ প্রশ্নে পিছু হটলেন মোদি যেটাকে বিজেপির জাতীয় সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব সাম্প্রতিক এক মতামত কলামে পূর্ববর্তী সরকারের ‘পরাজয় মেনে নেয়ার সেই পুরনো যুক্তি’ হিসেবে তাচ্ছিল্য প্রদর্শন করেছেন?
কোনো অনুপ্রবেশই যদি না হবে, তবে ভারতের ২০ সৈন্য মারা গেল কেন?
প্রকৃত লড়াইয়ের যেসব খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে যে চীনারা নৃশংস অস্ত্র ব্যবহার করেছে। কোনো কোনো খবরে বলা হয়, তারা পেরেক লাগানো মুগুর দিয়ে ভারতীয় সৈন্যদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। ভারতীয় সৈন্যরা কেন এমন পরিণতি ভোগ করল, তা জানা দরকার।
খবরে বলা হয়, ভারতীয় সৈন্যরা এলএসির ভারতীয় অংশে তাঁবু ও অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস করতে চেয়েছিল। ৬ জুন দুই সামরিক বাহিনীর সমঝোতার পর চীনার এই এলাকা থেকে সরে যাওয়ার আশ্বাস দেয়ার পরও তা না করায় ভারত এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল।
কিন্তু মোদি দাবি করছেন যে চীনা সৈন্যদের কোনো অনুপ্রবেশ ঘটেনি। তাই যদি হবে, তবে ভারতীয় সৈন্যদের মারা যাওয়ার ব্যাখ্যা কী হতে পাারে? কেন তারা সেখানে লড়াই করেছিল?
ভারতীয় সৈন্যরা কি আগ্নেয়াস্ত্র সাথে নিয়েছিল?
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বৃহস্পতিবার টুইটারে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে আরেকটি প্রশ্ন জাগে। বিভিন্ন প্রশ্নের জবাবে জয়শঙ্কর দাবি করেছেন যে লড়াইয়ের সময় মারা মারা গেছে বা যারা আহত হয়েছে বা চীনারা যাদের আটক করেছিল, তারা অস্ত্র বহন করছিল।
এলএসিতে স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট সঙ্ঘাত যাতে বড় যুদ্ধে পরিণত না হয, সেজন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার না করার দীর্ঘ দিনের রীতির কথা উল্লেখ করেছেন মন্ত্রী।
কিন্তু তার এই বক্তব্য আরো কিছু প্রশ্নের সৃষ্টি করে।
খবরে প্রকাশ, ভারতীয় সৈন্যরা খালি হাতে লড়াই করেছে, আর চীনারা মুগুর ও অন্যান্য উন্নত অস্ত্র ব্যবহার করেছ। জয়শঙ্কর সম্ভবত বলতে চেয়েছেন যে ভারতীয় সৈন্যরা সশস্ত্র থাকলেও তারা সেগুলো ব্যবহার করেনি।
কিন্তু কৌশলগত সামরিক পরিস্থিতিতে সৈন্যরা তাদের হাতে থাকা অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে, অন্তত আক্রান্ত হলে তো পারেই। এখন সরকারের অবস্থান যদি এই হয় যে এসব সৈন্যের হাতে বুলেটসহ আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও তারা চীনা সৈন্যদের হাতে প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা সত্ত্বেও সেগুলো ব্যবহার করেনি, তাহলে এর অর্থ কী হয়?
রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব কি গোয়েন্দা সতর্কতা মিস করেছেন?
আক্রমণের আগে এলএসিতে চীনা সৈন্য বাড়ার বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য ছিল। মে মাসের শুরু থেকেই খবর প্রকাশিত হচ্ছিল যে প্রধান প্রধান অবস্থানে ভারতীয়রা যথাযথভাবে প্রস্তুত নয়।
এমন খবরের পরও চীনাদের হাতে ২০ সৈন্য নিহত হওয়ার খবরে ভারতের প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন জাগেই।
ভারতীয় সৈন্যরা কিভাবে মারা গেল, সে ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য নেই। আবার ভারত সরকার চীনাদের অনুপ্রবেশ না ঘটার কথা বলার পর বিষয়টি আরো অস্পষ্ট হয়ে গেছে। চীনা বাহিনীর হাতে ভারতের ১০ সৈন্যের আটক হওয়ার ব্যাপকভাবে প্রচারিত খবরের ব্যাপারে ভারত এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই জানায়নি।
সরকারি অবস্থান কি এটিই যে কোনো ভারতীয় সৈন্য আটক হয়নি?আর তারা যগি আটক হয়ে থাকে, এবং কোনো অনুপ্রবেশ না ঘটে থাকে, তবে কিভাবে তা হলো? প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কেবল লাদাখ নয়, এলএসির আরো কয়েকটি স্থানে স্থিতিবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। সরকার কি এর ব্যাখ্যা দেবে? নাকি কোনো অনুপ্রবেশ ঘটেনি বলে জোর দিয়ে বলার মাধ্যমে স্থিতিবস্থার চীনা পরিবর্তনকে স্রেফ মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোদি?
সূত্র : স্ক্রল.ইন