নেপথ্যে চীন-মার্কিন স্নায়ু যুদ্ধ?
নেপথ্যে চীন-মার্কিন স্নায়ু যুদ্ধ? - ছবি : সংগৃহীত
এর আগে ২০১৭ সালের দোকলাম সঙ্কটে আড়াই মাসব্যাপী দু’পক্ষের মধ্যে সামরিক উত্তেজনার পর সাম্প্রতিক সময়ে লাদাখে বড় রকমের রক্তক্ষয়ের ঘটনা ঘটল। এটিকে নিছক কোনো সীমান্ত বিরোধ বা উত্তেজনা বলে মনে হয় না। এর পেছনে রয়েছে আরো গভীর ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত সমীকরণের বিষয়। যদিও আপাতত দু’পক্ষের মধ্যে সীমান্ত বৈঠক অথবা পররাষ্ট্রমন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমিত হবে। তবে এর রেশ সামনে চলতে থাকবে যদি দুই দেশের যে কৌশলগত নীতি ও সমীকরণ বারবার উত্তেজনাকর অবস্থা সৃষ্টি করছে তাতে পরিবর্তন না আসে।
উভয় সরকারের শীর্ষপর্যায়ের মধ্যে কথাবার্তা এবং সমঝোতায় মনে হয়েছে এ সংঘর্ষ এখনই বিস্তৃত হবে না। তবে দু’দেশের মধ্যে এমন কিছু বিরোধ অতি গভীরে শেকড় গাড়তে করতে শুরু করেছে যাতে মনে হয় পররাষ্ট্রনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল পুনর্বিবেচনা করা না হলে এ সঙ্ঘাত থামবে না। এ উত্তেজনার পেছনে এশিয়ার দুই বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের নেতৃত্বের মানসিক গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও রয়েছে।
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিংপিন যেমন তার আগেকার চীনা নেতৃত্বের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন, তেমনিভাবে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আর তার শীর্ষ সহযোগীদের দৃষ্টিভঙ্গি আগের সরকারগুলোর চেয়ে বেশ খানিকটা আলাদা। এমনকি বিজেপির বাজপেয়ী সরকার যে নীতি কৌশল নিয়ে ভারত পরিচালনা করেছে এখনকার নীতি তার চেয়েও মৌলিকভাবে ভিন্ন বলে মনে হয়।
গ্লোবাল টাইমসের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ভারতের সাথে সংঘর্ষে জড়াতে চায় না চীন। তারা আশা করে দ্বিপক্ষীয় সীমান্ত সমস্যাগুলো শান্তিপূর্ণভাবেই মেটানো যাবে। তবে এটা চীনের বদান্যতা, দুর্বলতা নয়। ভারতীয় সমাজকে বুঝতে হবে যে চীন ভারতের সাথে বন্ধুত্বের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং শক্তিশালী প্রতিবেশী আরেকটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতকে সম্মান করে। ভারতের প্রতি চীনের মূল নীতি হলো চীন-ভারত সম্পর্ক এবং সীমান্ত অঞ্চল স্থিতিশীল রাখা। দুই দেশের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে, তবে এমন একটি ব্যবস্থাও বিকাশ করেছে যার ফলে কয়েক দশক ধরে সীমান্তে সাধারণ স্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে।
এ প্রক্রিয়াটি অবলম্বন করা এবং এটি ধ্বংস করার পরিবর্তে এর উন্নতি হলো দু’পক্ষের ঘাটতি দূর করার একমাত্র উপায়। ভারতকে কখনোই ছাড় দেয়ার জন্য চীনকে চাপ দেয়ার বিষয়ে ভাবা উচিত নয়, কারণ চীন তা করবে না। তদুপরি, চীনের পাল্টা ব্যবস্থার ব্যয় যাই হোক না কেন কখনোই তাতে দেরি হবে না।
এরপর আরো বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা প্রভাবিত ভারতীয় ধারণাগুলো স্পষ্টভাবে চীনকে টার্গেট করে। এ ধারণা অনুসারে, ওয়াশিংটনের চীনের ওপর আক্রমণ চালানোর জন্য ভারতের মতো দেশ দরকার হবে।
মার্কিন জনগণ এবং অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর কিছু ব্যক্তির পক্ষপাতিত্বের কারণে ভারতীয় জনগণকে মাতাল করা সরকারের উচিত নয়। নয়াদিল্লি যদি এ ধরনের ভূমিকা পালন করার জন্য উদ্যোগী হয় তবে কৌশলগতভাবে সক্রিয় হওয়ার চেয়ে দেশটির নিজেকে ঝুঁকির মধ্যে ছেড়ে দেয়া হবে। এটি একটি বড় দেশ হওয়ার উচ্চাভিলাষ ত্যাগ করে ভারতকে তথাকথিত জোটের একটি সরঞ্জামে পরিণত করবে।
গ্লোবাল টাইমসে বলা হয়, আমরা লক্ষ করেছি যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ভারত থেকে চীন সম্পর্কে অনুকূল মতামত খুব কমই শোনা যাচ্ছে, আর মূল্যবোধভিত্তিক জোট এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের স্বর আরো জোরালো হচ্ছে। এটি কি ভারতের উত্থানের ইচ্ছাকে দৃঢ় কোনো কৌশলগত সহায়তা দিতে পারবে?
চীন-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে চীন-এর বিরুদ্ধে ভারতের সাম্প্রতিক উসকানির বিষয়টিও অনেকেই দেখতে পাচ্ছেন। ভারত যুক্তরাষ্ট্রকে নানাভাবে খুশি করতে চাইছে। ঘটনার আগেই বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, দোকলাম স্ট্যান্ড অফের চেয়ে আরো গুরুতর সমস্যা তৈরি করা ভারতের প্রথম লক্ষ্য হতে পারে।
চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্ঘাত এখন অনেকখানি মতবাদগত বিষয়ে পরিণত হচ্ছে। চীন ২০৩০ সাল নাগাদ আমেরিকান অর্থনীতিকে বেইজিং ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
এরপর বিশ্ব রাজনীতিতে চীন আরো বেশি মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করা শুরু করতে পারে। ২০৫২ সাল নাগাদ তারা এখনকার যুক্তরাষ্ট্রের মতো একক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হতে চায়। আর যুক্তরাষ্ট্র তখন এখনকার অন্য বৃহৎ শক্তির মতো একটি সাধারণ বিশ্বশক্তি হয়ে থাকবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বেইজিং জাপানের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে চাইছে। আফ্রিকা ও এশিয়ায় বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব বাড়াতে চায় চীন। এশীয় অঞ্চলের ছোট ছোট দেশগুলোকে তার প্রভাববলয়ে আনতে চায়। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনা উত্থানকে ঠেকানোর জন্য এর মধ্যে যে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেছে সেটাকে আরো সামনে নিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন চীনকে এর মধ্যে আমেরিকার এক নাম্বার শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার তাত্ত্বিক উদ্যোগ নিয়েছে। করোনাভাইরাসের ইস্যু নিয়ে সর্বাত্মক প্রচারণা শুরু করেছে। চীনকে কনটেইন করার ক্ষেত্রে এশিয়ায় ছোট ছোট দেশগুলো কোনো কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে ভারতই হতে পারে প্রধান মিত্রশক্তি। এ জন্য দিল্লির সামনে অর্থনৈতিক উত্থান ও বিশ্ব শক্তি হওয়ার প্রলোভনও সামনে রাখা হয়েছে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে অনুসৃত নীতি পর্যবেক্ষণে মনে হচ্ছে বিজেপি সরকার কৌশলগতভাবে সেই ফাঁদে পড়ে তার নীতি পদক্ষেপগুলো নিচ্ছে। চীন বারবার দিল্লির কাছে এ বার্তা দিতে চাইছে যে, বেইজিং একটি বড় শক্তি হিসেবে সহযোগিতার সম্পর্ক ভারতের সাথে বজায় রাখতে চায়।
এটি ব্রিকস ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার কাঠামোর মাধ্যমে এগিয়ে নেয়ার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু আমেরিকার ছায়া শক্তি হিসেবে দিল্লির কোনো উসকানিমূলক ভূমিকা গ্রহণ মেনে নেবে না।
তবে ভারতীয় নীতি অনুসৃতির যে বাস্তবতা এখন দেখা যাচ্ছে, তাতে ভারতের মোদি প্রশাসন পশ্চিমের মিত্র হিসেবেই নিজেকে বিশ্বশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে বলে মনে হয়। এটি চাইলে গ্যালাওয়ান অথবা দোকলাম সঙ্ঘাতের মতো ঘটনা একের পর এক ঘটতেই থাকবে। এটি শুধু চীন সীমান্ত অথবা চীনের অর্থনৈতিক করিডোর অবকাঠমোর টার্গেটে সীমিত থাকবে না। একই সাথে এ অঞ্চলে চীনা মিত্র দেশগুলোর সাথেও ভারতের সম্পর্কে উত্তেজনা তৈরি হবে। ইতোমধ্যে যা পাকিস্তান ও নেপালের সাথে দেখা যাচ্ছে। একই পরিস্থিতি বাংলাদেশ মিয়ানমার বা শ্রীলঙ্কার মতো দেশের সামনেও দেখা যেতে পারে।
mrkmmb@gmail.com