সীমান্ত সঙ্ঘাত : চীনা বিশেষজ্ঞের অভিমত

ঝাং শেং | Jun 19, 2020 05:50 pm
সীমান্ত সঙ্ঘাত : চীনা বিশেষজ্ঞের অভিমত

সীমান্ত সঙ্ঘাত : চীনা বিশেষজ্ঞের অভিমত - প্রতীকী ছবি

 

গালওয়ান উপত্যকায় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যকার সর্বসাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘর্ষ ছিল চীনা জনগণ ও সরকারের জন্য একটি অবাক করা খবর।
দুই দেশের সৈন্যদের মধ্যে উত্তেজনা চলছে মে মাস থেকে। উভয় পক্ষ উত্তেজনা যাতে পূর্ণ সংঘর্ষে পরিণত না হয়, সেজন্য বেশি কিছু ব্যবস্থা ও রীতিনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়েছে। ফলে সমঝোতা পরিষ্কারভাবে ভঙ্গ করে ভারতীয় সৈন্যরা যখন লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল (এলএসি) ঢুকে পিএলএ সৈন্যদের ওপর হামলা চালায় তখন চীনা পক্ষ খুবই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে।

যে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় ২০ ভারতীয় সৈন্য ধ্বংস হযে গেল তা এড়ানো যেত। চীনা পণ্য বয়কট করা কিংবা সীমান্ত সঙ্ঘাত বাড়িয়ে দেয়ার হুমকি প্রদান করা ভারতের উদ্দীপ্ত উগ্র-জাতীয়তাবাদীর জন্য উপযুক্ত সময় নয়।
বরং এখন ভারতের জন্য কল্যাণকর হলো তাদের পররাষ্ট্রনীতি পুনর্বিবেচনা করা এবং ভুল ধারণা ত্যাগ করা এবং ‘সীমান্ত আচ্ছন্নতা’ নামে অভিহিত বিষয়টি বাদ দেয়া।
ওই ঘটনার পর ভারতীয় ও পাশ্চাত্য মূলধারার মিডিয়া, বিশেষ করে মার্কিন মিডিয়া নির্বিচারে ও অযৌক্তিকভাবে চীনকে ঝামেলা সৃষ্টিকারী হিসেবে চিত্রিত করছে। চীনকে সংশোধনবাদী ক্ষমতালিপ্সু ও সম্প্রসারণবাদী দেশ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে।

কিন্তু এমন প্রচারণা বাস্তবতার পরিপন্থী। চীনের সাথে যে ১৪টি দেশের সীমান্ত রয়েছে, তাদের মধ্যে মাত্র দুটি দেশের সাথে তা মীমাংসিত হয়নি। একটি হলো ভারত ও অপরটি ভুটান।অবশ্য ভুটানের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হয় ভারতের মাধ্যমে। ভূখণ্ডগত সীমানা ইস্যুতে ভারত ও চীনের মধ্যে তীব্র মতভেদ রয়েছে।
চীনা দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী, ভূখণ্ডগত বিরোধ হলো চীন-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের সবচেয়ে বড় সমস্যা। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি কোনোভাবেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয় এবং কোনোভাবেই চীন-ভারত বন্ধুত্বে বাধা নয়।
চীনা পক্ষ এই সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুক্তি-তর্ক স্থগিত রেখে অভিন্ন বিষয়ে নজর দিতে চায়, উভয় পক্ষ সহযোগিতা করতে পারে, এমন সুযোগগুলো খুঁজতে চায়। চীন দুই দেশের মধ্যকার পারস্পরিক আস্থা বাড়ে, এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে চায়, যা হতে পারে সীমান্ত সঙ্ঘাত নিরসনের কঠিন সমস্যা সমাধানের সহায়ক।

অন্যদিকে ভারত অবাস্তবভাবে বিশ্বাস করে, চীনা বৈধ দাবি বাতিল করে সে তার সর্বোত্তম স্বার্থে ভূখণ্ডগত সমস্যার সমাধান করতে পারবে। আজকের সঙ্ঘর্ষের মূল কারণ এখানেই নিহিত রয়েছে।
আমি অবশ্যই সীমান্ত ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের বৃহত্তর প্রবণতা বা অবস্থানের দিকে সবার নজর আকর্ষণ করব। ভারতের মূলধারার মিডিয়া চীন সম্প্রসারণবাদী হানাদার হিসেবে চিহ্নিত করলেও তারা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই তথ্য এড়িয়ে যাচ্ছে যে বর্তমানে ভারতই এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ঝামেলা সৃষ্টিকারী এবং কেবল চীনের সাথে নয়, পাকিস্তান ও নেপালের সাথেও তাদের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে।

মোদি প্রশাসন একইসাথে লাদাখে চীনকে, কাশ্মিরে পাকিস্তানকে লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরায় নেপালকে উস্কে দিচ্ছে। তিন প্রতিবেশীর সাথে একইসাথে সঙ্ঘাতে জড়িয়ে পড়ার চেয়ে বড় আগ্রাসী ও সম্প্রসারণবাদী আর কেউ আছে কিনা সন্দেহ আছে।সীমান্ত আচ্ছন্নতায় আক্রান্ত ভারত সহিংস পন্থায় সীমান্তের স্থিতিবস্থা পরিবর্তন করতে চায়।
চীনের জনসাধারণ ভারতের সীমান্ত আচ্ছন্নতার বিষয়টি বুঝতে সমস্যায় পড়ছে। ১৮ জুন নাগাদ ভারতে করোনায় শনাক্ত চিহ্নিত হয়েছে ৩,৫৪,০৬৫ জন। চীন যেকোনো মূল্যে তার লোকজনকে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করতে চায়।কিন্তু মোদি কেন তার জনসাধারণকে কোভিড-১৯, পঙ্গপাল আর তাপদাহ থেকে রক্ষার বদলে অন্য দেশের ভূখণ্ডে হানা দিচ্ছে, তা বোঝা যাচ্ছে না।

সীমান্ত ইস্যুতে ভারতের আগ্রাসী নীতি গ্রহণের পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কারণ হলো এই যে ভারত মনে করে, বর্তমান বৈশ্বিক কোভিড-১৯ সঙ্কটের কারণে অন্যান্য দেশের বিপরীতে তার সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে।
তবে ভারতের উচিত হবে এসব কারণ পুনর্বিবেচনা করা। প্রথমত, চীনের বিরুদ্ধে ভারত সুবিধা করতে পারবে না। কারণ চীন অনেক শক্তিশাল দেশ এবং করোনাভাইরাস তাদের দুর্বল করতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, কোভিড-১৯ চীনের চেয়ে ভারতের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। তৃতীয়ত, ভারত চেষ্টা করছে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা থেকে জনসাধারণের দৃষ্টিকে সরিয়ে নিতে।
ভারতের আরেকটি ভুল ধারণা হলো, তারা এটি বিশ্বাস করে যে মার্কিন চাপের কারণে চীন উস্কানিতে শক্তি প্রয়োগ করে জবাব দেবে না। চীন যদিও তার পূর্বাঞ্চলের সামুদ্রিক সীমান্ত নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন, কিন্তু তবুও সে তার পশ্চিম দিকের সীমান্ত রক্ষায় কোনো ছাড় দেবে না।বর্তমান সঙ্ঘাত বাড়লে ক্রুদ্ধ চীনা জনসাধারণ দেশের সার্বভৌমত্ব ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বৈধ সব শক্তি ব্যবহারের চাপ প্রয়োগ করবে।
তাছাড়া ভারত মনে করে, চীনের সাথে সঙ্ঘাতের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে সহায়তা করবে। এটি পুরোপুরি ভুল ধারণা। যুক্তরাষ্ট্র এমন কাজ কখনো করবে না। বরং সে চাইবে, এশিয়ার দুটি শক্তি নিজেদের মধ্যে যেন দ্বন্দ্বে নিয়োজিত থাকে। তাতেই তার বেশি লাভ।

ভারত যদি তথাকথিত ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের আওতায় যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বাস করে, তবে ভুল করবে। কারণ সেক্ষেত্রে সে হয়ে যাবে আমেরিকান এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার।
সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি হসেন লং চলতি মাসে একটি প্রবন্ধ লিখে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় এশিয়ায় প্রাধান্য বিস্তার করতে চায়। আর চীন যে একটি বাস্তবতা তা এড়িয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। আগামী ৫০ বছর পর এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব থাকবে কিনা কেউ জানে না। কিন্তু ভারতের পাশে চীন রয়েছে হাজার বছর ধরে এবং ভবিষ্যতেও প্রতিবেশী হিসেবে থেকে যাবে।
আজ যদি একদিকে অভিন্ন শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যত এবং অন্যদিকে লোকরঞ্জক নেতাদের অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে প্রতিবেশী দেশগুলোকে উস্কানি প্রদানের সন্ধিক্ষণে বসবাস করি, তবে আমি প্রার্থনা করব আমরা, উভয় দেশের জনগণ, যেন আমাদের হাত থেকে জলপাই শাখা ফেলে না দেই।

লেখক : রিসার্চ ফেলো, চেঙ্গদু ইনস্টিটিউট অব ওয়ার্ল্ড অ্যাফেয়ার্স


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us