ভারতের কাছ থেকে বড় ছাড় দাবি চীনের?
মোদি ও শি - প্রতীকী ছবি
লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলজুড়ে (এলএসি) সোমবার রাত থেকে উত্তেজনা বেড়েছে। ওই দিন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় হাতাহাতি লড়াইয়ে ভারতীয় এক সেনা অফিসার ও ১৯ সৈন্য নিহত হয়। আরো কয়েকজন সৈন্যের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় মৃতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, উভয় পক্ষেরই হতাহত হয়েছে। চীনা সরকার এখন পর্যন্ত তাদের হতাহতের কোনো সংখ্যা প্রকাশ করেনি।
চীন সরকার মঙ্গলবার পুরো গালওয়ান উপত্যকাকে চীনা ভূখণ্ড হিসেবে দাবি করায় তা ভারতের জন্য মারাত্মক উদ্বেগের কারণ হয়েছে। এতে বলা হয়, চীনা সবসময় এই এলাকার উপর সার্বভৌমত্ব বজায় রেখেছে। তারা উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য ভারতকে দায়ী করে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই এলাকার স্থিতি অবস্থা একতরফাভাবে পরিবর্তনের জন্য বেইজিংকে দায়ী করেছে।
সোমবার রাতের সংঘর্ষে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত না হলেও সঙ্ঘাতটি ‘নৃশংস’ ছিল বলে খবর পাওয়া গেছে। ভারতীয় সূত্র জানায়, চীনা আক্রমণকারী দলটির হাতে লোহার রডের পাশাপাশি ছিল কাঁটাতারযুক্ত লাঠি। এগুলো প্রয়োগ করা হয় ভারতীয় সৈন্যদের ওপর।
সোমবার রাতের ঘটনাটি নয়া দিল্লি ও বেইজিং উভয়ের জন্য সতর্কঘণ্টা হওয়া উচিত। ১৯৬৭ সালে নাথু লায় সংঘর্ষের পর এটিই ভারত ও চীনের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী সঙ্ঘাত। তাছাড়া ১৯৭৫ সালের পর এই প্রথম এলএসির সংঘর্ষে সৈন্যরা প্রাণ হারাল।
বিরোধপূর্ণ সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমন করার জন্য ভারত ও চীনের সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলার মধ্যেই এই সঙ্ঘর্ষ হলো। মাত্র কয়েক দিন আগে ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ মুকুন্দ নারাভাবে বলেছিলেন যে এলএসির পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
ভারত ও চীনা সীমান্তের পুরোটাই বিরোধপূর্ণ এবং এলএসি হলো দুই দেশের মধ্যকার কার্যত সীমান্ত।ভারতের মতে, এলএসির দৈর্ঘ ৩,৪৮৮ কিলোমিটার আর চীন মনে করে মাত্র ২,০০০ কিলোমিটার। এলএসির দৈর্ঘ নিয়ে বিরোধের পাশাপাশি এটি কোন কোন স্থান দিয়ে গেছে তা নিয়েও বিরোধ রয়েছে। তাছাড়া উভয় দেশই অভিযোগ করছে যে অপর দেশ তার বিরাট অংশ দখলে রেখেছে।
পশ্চিম সেক্টরে ভারত আকসাই চিনের ৩৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার দাবি করে থাকে। ভারত একে তার বর্তমান লাদাখ কেন্দ্রীয় এলাকার অংশ মনে করে। চীন ১৯৬২ সালের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় দখল করে। ১৯৬৩ সালে চীনকে ছেড়ে দেয়া পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরের পাকিস্তানের ৫,১৮০ বর্গ কিলোমিটার এলাকাও নিজের বলে দাবি করে।
পূর্ব সেক্টরে বেইজিং প্রায় ৯০ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা নিজের বলে ধাবি করে। এটি ভারতের অরুনাচল প্রদেশের প্রায় পুরোটা। চীন এটিকে তাদের সাউদার্ন তিব্বত মনে করে। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের সময় চীন এই এলাকা দখল করে নিয়েছিল, তবে পরে সরে যায়। এলএসির মধ্যবর্তী সেক্টর তুলনামূলকভাবে কম বিরোধপূর্ণ।
গালওয়ান উপত্যকায় চীনা পদক্ষেপের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। গত এপ্রিলে এলএসিজুড়ে সৈন্য সমাবেশ বাড়াতে থাকে চীন। তারপর তারা ভারতীয় এলাকায় সৈন্যদের পাঠিয়ে দেয়।
এবারের সঙ্ঘর্ষ অন্যান্যবারের মতো নয়। অন্যান্য সময় চীনারা অল্প কিছু সৈন্য পাঠায়। কিন্তু এবার তাদের বিপুলসংখ্যক সৈন্য এতে জড়িত রয়েছৈ। চীনের তাঁবু, বাঙ্কার ও অন্যান্য অবকাঠামোও আনা হয়েছে এলএসিতে। ভারতের এক সেনা অফিসার জানিয়েছেন, তারা এখানে এসেছে থাকার জন্য। তারা গালওয়ান উপত্যকার কাছাকাছি এলাকায় সাজোয়া যানবাহনও এগিয়ে এনেছে। মনে হচ্ছে, তারা বড় ধরনের সঙ্ঘাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
চীন তার অবস্থান জোরদার করছে, আগ্রাসী নীতি অনুসরণ করলেও ভার কিন্তু তার আজকের পিছিয়ে পড়া অবস্থানের দায় এড়াতে পারে না।
গত এপ্রিলে লাদাখে চীনা শক্তি বাড়ানোর গোয়েন্দা প্রতিবেদন পাওয়ার সাথে সাথে ভারতের উচিত ছিল ওই এলাকায় তার সামরিক শক্তি বাড়ানো। কিন্তু তা করেনি। এর বদলে এমনকি ৫ মের সঙ্ঘর্ষের পরও ভারত সরকার চীনা আগ্রাসনের মাত্রাকে গুরুত্ব দিতে রাজি হয়নি। বস্তুত সেনাবাহিনী প্রধান নারাভানে লাদাখের ঘটনাকে সাময়িক ও স্বল্প মাত্রার ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন।
ভারত কেন এত দিন ধরে এলএসিজুড়ে আসন্ন সঙ্কটকে গুরুত্ব দেয়নি?
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) দীর্ঘ দিন ধরে বুক চাপড়ানো জাতীয়তাবাদের কথা বলে আসছে, তারা ভারতের প্রতিবেশীদের সাথে শক্তি প্রদর্শনের নীতি অনুসরণ করছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা ও ভূখণ্ডগত সার্বভৌমত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অভিভাবকের দাবি করে তারা কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে। তারা সীমান্তে চোখ বন্ধ করে ছিল।
এখন মুখ রক্ষার জন্য বিজেপি সরকার ‘জাতীয় গর্বের’ প্রতি তাদের দায়বদ্ধতার কথা বলছে। সোমবার রাতে ২০ ভারতীয় সৈন্য নিহত হওয়ার জন্য মোদি সরকারকে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া উচিত।
সীমান্ত ইস্যুতে দীর্ঘ নীরবতার পর মোদি বুধবার চীনকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন যে ভারত সমুচিত জবাব দিতে তৈরী। তিনি সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে শুক্রবার সর্বদলীয় সভাও আহ্বান করেছেন।
মোদির সরকার এখন ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা দখলদারিত্বের বিষয়টিতে কিভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, তাই এখন দেখার বিষয়।
২০০৭ ও ২০০৮ সালে নর্দার্ন কমান্ডের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং-ইন-চিফ লে. জেনারেল পানাগ (অব.) বলেছেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে চীন ৩৫-৪০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দখল করে নিয়েছে। চীনা দখলদারিত্বের কথা অস্বীকার করে মোদি সরকার দৃশ্যত চীনা অবস্থানকেই অনুমোদন করে নিচ্ছেন।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান আলোচনায় তাদের লক্ষ্য হলো চীনাদেরকে স্থিতিবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় রাজি করানো। তারা কি চীনাদেরকে তা করাতে রাজি করতে পারবে? কঠিন কাজ। কারণ চীনারা এখন সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।
ভারত সর্বোচ্চ যে প্রত্যাশা করতে পারে তা হলো, নয়া দিল্লির কাছ থেকে বড় ধরনের কোনো ছাড় নিয়ে চীনারা সরে যেতে পারে।
লেখক : ব্যাঙ্গালোরভিত্তিক সাংবাদিক, গবেষক। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে লেখেন