ইসলামী পোশাক : অর্থনীতির নতুন সম্ভাবনাময় খাত
ইসলামী পোশাক - প্রতীকী ছবি
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অর্থনীতির সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে বিকশিত হয়েছে ইসলামী পোশাক টুপি, হিজাব ও বোরকা। জানা গেছে, বর্তমানে দেশে বোরকা ও হিজাবের বাজার দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কারণ বিশ্ববাজারে বোরকা ও হিজাবের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তবে দেশে যেসব উন্নতমানের বোরকা ও হিজাব দেখা যায় তার সবই প্রায় পাকিস্তান, ইরানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানির মাধ্যমে আসে। অথচ এ খাতে উৎপাদন বাড়িয়ে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানির সুযোগ আছে বলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন।
গবেষণায়ও দেশে তরুণীদের হিজাব ও বোরকায় ঝুঁকে পড়ার বিষয়টি উঠে এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ মুসলিম তরুণীই হিজাব পরেন। তাদের অধিকাংশই হিজাবকে গুরুত্বপূর্ণ পোশাক মনে করেন।
ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সৌদি, দুবাই ও জর্দান থেকে আমদানি করা হিজাব ও বোরকা স্থানীয় বাজারে বিক্রি হচ্ছে। পোশাকটি আমদানি করা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীন থেকেও। চাহিদা বাড়ায় এখন স্থানীয়ভাবেও অনেকেই বোরকা তৈরি করছেন। একেকটি বোরকা সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
অন্য দিকে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের টুপিরও ব্যাপক সুনাম। মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কেবল টুপি রফতানি করেই বছরে আয় হয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা। টুপির মতো বোরকা এবং হিজাব রফতানির মাধ্যমে পাঁচ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। সবমিলিয়ে ইসলামী পোশাকের ব্যবসা অর্থনীতির একটি নতুন সম্ভাবনায় পরিণত হতে পারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর গবেষণা তথ্যের বিবেচনায় দেশে বোরকা ও হিজাব ব্যবহারকারী নারীর সংখ্যা প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ। এ পোশাক বাবদ একজন নারী বছরে গড়ে এক হাজার টাকা ব্যয় করলেও দেশে বোরকা ও হিজাবের বাজার দাঁড়ায় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি। এর ফলে দেশের বড় বড় শপিংমলগুলো ছাড়াও এ ব্যবসার প্রসার অনলাইন শপগুলোতে বেড়ে চলেছে। এ ছাড়া বর্তমানে এ খাত লাভজনক ব্যবসার পরিচিতি পাওয়ায় বাংলাদেশে এখন বোরকা ও হিজাবের নতুন নতুন কারখানা গড়ে উঠছে।
বিজিএমইএ বলছে, মধ্যপ্রাচ্যের বাজার এখনো ভালোভাবে ধরতে না পারার কারণে বোরকা ও হিজাব রফতানি করে আয় খুবই কম হচ্ছে। ওই বাজার বর্তমানে চীনের দখলে আছে, তবে রফতানি বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। টুপি রফতানি আয় অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছে। দেশে বোরকা ও হিজাবের কারখানা তুলনামূলক কম থাকলেও রফতানি বেড়ে গেলে কারখানাও বেড়ে যাবে।
‘বাংলাদেশ ইয়ুথ সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, সুইজারল্যান্ডের উন্নয়ন সংস্থা এসডিসি ও জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)। ওই গবেষণায়ও বাংলাদেশী তরুণীদের হিজাব ও বোরকায় আগ্রহের বিষয়টি উঠে আসে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ মুসলিম তরুণীই হিজাব পরিধান করে। তাদের অধিকাংশই হিজাবকে গুরুত্বপূর্ণ পোশাক মনে করেন। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, দেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ বোরকা ও হিজাব পরিধান করছেন। এর মধ্যে গ্রামীণ নারীদের প্রায় ৫০ শতাংশ পোশাকটি পরছেন। শহুরে নারীদের মধ্যে এ হার কিছুটা কম। তবে তা ৩০ শতাংশের নিচে নয়। অঞ্চলভেদেও হিজাব ও বোরকা পরার আগ্রহে তারতম্য রয়েছে। সিলেট ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায় ৭০ শতাংশ নারীই বোরকা বা হিজাব পরিধান করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য জেলা যেমনÑ নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনীতে ১৫ বছরের বেশি বয়সী প্রায় ৮০ শতাংশ নারীই বোরকা ও হিজাব পরেন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, দেশে নারীর সংখ্যা ৭ কোটি ৯৩ লাখ। এর মধ্যে ১৫ বছরের বেশি বয়সী নারীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি।
বাংলাদেশী নারী, বিশেষ করে তরুণীদের মধ্যে হিজাব ও বোরকার প্রতি ঝোকের বিষয়টি উঠে এসেছে বিভিন্ন গবেষণায়ও। যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক বাংলাদেশী ফাতেমা মোহসিনা ইসলাম গবেষণা করেছেন বাংলাদেশী তরুণীদের ইসলামী ফ্যাশন ও পোশাক নিয়ে। ‘আ কনসেপচুয়াল ফ্রেমওয়ার্ক অন দ্য স্টাডি অব ট্রেন্ডস অব ইসলামিক ফ্যাশন অ্যান্ড ক্লদিং প্র্যাকটিসেস অ্যামোংস্ট ইয়াং মুসলিম ফিমেল ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই গবেষণায় তিনি দেখিয়েছেন, ৫৬ শতাংশ তরুণীই ইসলামী পোশাক পরিধান করেন।
এ দিকে টুপি থেকে রফতানি আয় বাড়ার কারণে বাংলাদেশের গ্রামে ও শহরে টুপি তৈরির কারখানা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছে এ খাত থেকে। কর্মসংস্থানের পাশাপাশি রফতানি আয় বৃদ্ধিতে এ খাত ভূমিকা রাখছে। টুপি রফতানি হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, মরক্কো, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশে।
তবে বাজারে টুপির চাহিদা প্রায় ১২ লাখ। বাংলাদেশের টুপির মান এবং ডিজাইন আকৃষ্ট করে বলেই হজের মৌসুমে সৌদি আরবে আগত হাজীরা বাংলাদেশের টুপি কিনেন। আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, থাইল্যান্ড, কাতার, ওমান, মালয়েশিয়া, দুবাইয়ের হাজীরা বাংলাদেশী টুপির সবচেয়ে বড় ক্রেতা।