করোনার তাণ্ডবে অর্ধ উন্মাদিনীর হরতাল আহ্বান!
এক পাগলির কাহিনী - প্রতীকী ছবি
আমার শ্বশুরবাড়ির পাশে একজন আধা পাগলি বা অর্ধ উন্মাদিনী ছিল। আমার স্ত্রীর চেয়ে মেয়েটির বয়স চার-পাঁচ বছর কম। অস্বাভাবিক মোটা, বেঢপ আকৃতি এবং নিতান্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় মেয়েটির সামাজিক অবস্থা ছিল তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের। অধিকন্তু অর্ধ উন্মদিনী হওয়ার কারণে গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই তাকে এড়িয়ে চলত। সাধারণ অবস্থায় সে কাউকে জ্বালাতন করত না। তবে রেগে গেলে লঙ্কাকাণ্ড ঘটাত। অকথ্য ভাষায় গালাগাল দেয়ার পাশাপাশি সবাইকে জায়গা-বেজায়গায় কামড়ে দিত।
আমার যখন বিয়ে হলো তখন শ্বশুরবাড়ির সবাই আমাকে পাগলি সম্পর্কে সতর্ক করল এবং তার সম্পর্কে সত্যমিথ্যা বানিয়ে এমন কিছু বলল যাতে আমি ভয় পাই। সবাই আমাকে বিকেলে পুকুরপাড়ে যেতে নিষেধ করল। কারণ ওই সময়টাতে পাগলি ওখানে থাকে এবং গোধূলিলগ্নে তার পাগলামো বেড়ে যায়। নানাজনের নানা কথাবার্তায় আমি রীতিমতো ভড়কে গেলাম এবং কায়মনো বাক্যে প্রার্থনা করতে থাকলাম যেন ইহজনমে পাগলির সাথে দেখা সাক্ষাৎ না ঘটে। আমার শ্বশুরবাড়িতে অনেক লোকের বসবাস। একান্নবতী পরিবার আর আত্মীয়স্বজনে সারা বছর সরগরম থাকে। বাড়ির আয়তনও বেশ বড়। চার-পাঁচটি বাগান, সাত-আটটি পুকুর এবং প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশটি ঘরের বাসিন্দাদের সাথে আমার পরিচিত হতে অনেকটা সময়ের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার আগেই আমি আচানক পাগলির কবলে পড়ে গেলাম।
ঘটনার দিন বিকেলে আমি একাকী হাঁটছিলাম এবং অনেকটা আনমনে নিজের অজান্তে কথিত পুকুর পাড়ে চলে গেলাম। পাগলির কথা আমার মনে ছিল বটে কিন্তু সে কোন পুকুরের পাড়ে বিকেলে পাগলামো করতে আসে তা আমার জানা ছিল না। ফলে ভয় ও ভাবনার রসায়নে অনেকটা গা ছমছমে পরিবেশের নির্জন পুকুরপাড়ে যখন পেছন দিক থেকে কেউ এসে আমার ডান হাতটা চেপে ধরে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল, তখন আতঙ্কে আমার দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। পেছনে ফিরে আমি যখন পাগলিকে দেখলাম তখন আমার দুই হাঁটু এমনভাবে কাঁপতে আরম্ভ করল, যা দেখে মনে হলো পা দুটো আমার নয়। পাগলি তার কণ্ঠে অসম্ভব দরদ ঢেলে দিয়ে আরেক দফা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল এবং আমার ডান হাতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল- দুলাভাই কেমন আছেন। আম খাবেন! এই কথা বলেই আমার হাতে একটা পাকা আম গুঁজে দিয়ে ভোঁদৌড়ে পালিয়ে গেল। আম হাতে আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার পা তখনো কাঁপছিল। এবার লক্ষ করলাম যে, আমি প্রচণ্ড ঘামছি এবং আমার হাত দুটোও কাঁপছে। আমি খুবই বিব্রতবোধ করতে থাকলাম এই কথা ভেবে যে, আমার কয়েক ডজন শ্যালক-শ্যালিকা যদি জেনে যায় আমি পাগলির কবলে পড়েছিলাম তবে তারা আমাকে নিয়ে হাজারো গল্প ফাঁদবে এবং পাগলি আমার কোথায় কোথায় মেরেছে সেখানে মলম লাগানোর কথা বলে রঙতামাশা শুরু করে দেবে।
ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমি পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আমার হাতে গুঁজে দেয়া পাগলির আমটি দেখছিলাম এবং উঁকিঝুঁকি দিয়ে চার পাশটায় চোখ বুলিয়ে নিশ্চিত হতে চাইছিলাম যে, আমাকে কেউ দেখেনি। এরই মধ্যে আমি দ্বিতীয় দফায় বিপদে পড়লাম। পাশের ঝোপঝাড় থেকে পাগলি ঝড়ের বেগে ফের আমার সামনে এলো। এবার সে আমার হাত ধরল না কিন্তু খিলখিলিয়ে অনবরত হাসতে লাগল। তার ওমন বেঢপ শরীর-কুশ্রী চেহারা এবং উন্মাদিনীসংক্রান্ত অসুস্থতার মধ্যেও সে পবিত্র হাসির মাধুর্যময় সুরলহরি তার কণ্ঠ দিয়ে বের হচ্ছিল, সে দিকে মনোনিবেশ করামাত্র আমার সব ভয় কেটে গেল এবং এক অদ্ভুত মমতায় আমার হৃদয় পাগলির জন্য সমব্যথী হয়ে উঠল। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, মেয়েটির চিকিৎসা করাব।
কয়েক বছরের টানা চিকিৎসায় পাগলি পুরো সুস্থ হয়ে উঠল এবং বহু চেষ্টা-তদবির করার পর তার জন্য একটি বিয়ের ব্যবস্থাও করলাম। এ ঘটনার পর প্রায় কুড়ি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এখন আর কেউ তাকে পাগলি ডাকে না- সবাই তার পিতৃপ্রদত্ত নাম ফারজানা বলে ডাকে। ফারজানার দিনমজুর স্বামী এবং দু’টি ছেলে-সন্তানের সাথে আমি সবসময় যোগাযোগ রাখি। তারা যেবার ঢাকা বেড়াতে আসে তখন হয় আমার অফিস নতুবা বাসায় গিয়ে আমার সাথে দেখা করে যায়। করোনা সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করার পর অন্য সবার মতো আমিও অফিস বন্ধ করি। আবার সরকার ঘোষিত ছুটি শেষ হওয়ার পর অফিস খুলি। আমার জমজমাট অফিসটি করোনার কবলে পড়ে বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। কাজ নেই, কর্ম নেই এবং লেনদেনও নেই। করোনার ভয়ে কেউ অফিসে আসে না। কেবল আমি এবং আমার ব্যক্তিগত পিয়নটি সকাল থেকে রাত অবধি অফিসে বসে থাকি দীর্ঘ দিনের অভ্যাসের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য। এমনতর পরিস্থিতিতে একদিন দুপুরে হঠাৎ করে ফারজানা আমার অফিসে এসে উপস্থিত।
আমি ফাজানাকে দেখিনি প্রায় দুই বছর হয়ে গেছে। ফলে হঠাৎ করে বলা নেই, কওয়া নেই- করোনাকালে সে কেন আমার অফিসে এলো এমনটি যখন ভাবছিলাম, ঠিক তখনই সে কোনো রাখঢাক না করে বললÑ দুলাভাই বাথরুমে যাবো। আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এবং লক্ষ করলাম যে, সে আরো মোটা হয়ে উঠেছে। আমি কথা না বাড়িয়ে পিয়নটিকে ডাকলাম এবং ফারজানাকে টয়লেট দেখিয়ে দিতে বললাম। একটু পরে পিয়নের আর্তচিৎকার শুনে আমি আমার রুম থেকে দৌড়ে বের হয়ে দেখি রক্তারক্তি কাণ্ড। সে পিয়নটিকে আচ্ছামতো কামড়ে দিয়েছে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে। আমাকে দেখে ফারজানা আমার দিকে তেড়ে এলো এবং জঘন্য ভাসায় গালাগাল শুরু করল। আমি দ্রুত আমর রুমে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে কাঁপতে থাকলাম।
ফারজানা আমার দরজায় লাথি মারতে মারতে বলতে থাকল- দরজা খোল! নইলে সারা দেশে হরতাল ডাকব! তোরে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব। তারপর বলব, হারামজাদায় আমারে খাবার না দিয়ে নিজের বউবাচ্চা নিয়ে পোলাও কোর্মা হান্দায় আর বড় বড় কথা কয়...!
পাবলিকের বারোটা বাজায় আবার দোয়া চায়!
উপরোক্ত কাহিনীটির নায়ক দেশের নামকরা একজন ব্যবসায়ী এবং সিনিয়র সিটিজেন। গল্পের প্রথম অংশ অর্থাৎ পাগলির সুস্থ হয়ে ওঠা হলো বাস্তব এবং দ্বিতীয় অংশটি অর্থাৎ করোনাকালে ফারজানার আগমনটি মূলত তিনি স্বপ্নে দেখেছেন। ভদ্রলোকের দিবা-নিদ্রার অভ্যাস রয়েছে। প্রতিদিন দুপুরে তিনি নিয়মিত দুই ঘণ্টা ঘুমান। তার অফিসে ঘুমানোর চমৎকার আয়োজন রয়েছে। গত চল্লিশ বছর ধরে ঘুমাতে গিয়ে তিনি দিনের বেলায় একটি বারের জন্যও দুঃস্বপ্নের কবলে পড়েননি। কারণ তার পরিমিত জীবনবোধ, পরিচ্ছন্ন চরিত্র এবং হিসাব করে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অভ্যাসের কারণে তিনি তার কর্মজীবনে বা ব্যক্তিগত জীবনে জাগ্রত অবস্থায় ক্ষণিকের জন্যও বিব্রতকর অবস্থায় পড়েননি। ফলে তার ঘুম বা স্বপ্নও প্রকৃতিগতভাবে জাগ্রত অবস্থার মতোই ছিল। কিন্তু চলমান করোনা সঙ্কটে ভদ্রলোকের ব্যবসাবাণিজ্য তছনছ হয়ে গেছে। তার দীর্ঘ দিনের পরীক্ষিত কর্মচারীদের বিরাট অংশ বেঈমানি করেছে, কেউ কেউ তার সাথে তর্ক করার নামে বেয়াদবি পর্যন্ত করেছে যা, কোনো দিন তিনি কল্পনাও করেননি। ফলে চলমান সঙ্কটে তিনি কেবল আর্থিক নয়Ñ মানসিকভাবেও ভেঙে পড়েছেন; যার প্রতিক্রিয়ায় উল্লেখিত দুঃস্বপ্নের কবলে পড়েছেন।
আজকের নিবন্ধে রূপক অর্থে যে কাহিনীটি বললাম, সেটির বাস্তবতা যে কত নিষ্ঠুর ও নির্মম তা আপনি বুঝতে পারবেন বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে কথাবার্তা বললে। একজন ভিক্ষুক, ফুটপাথে রাত যাপনকারী রাজধানীর ছিন্নমূল নর-নারী, হকার, রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি যাদের কলকারখানায় ত্রিশ-চল্লিশ হাজার লোক চাকরি করে তারা সবাই করোনার প্রভাবে মানসিকভাবে একই কাতারে এসে পড়েছেন। মৃত্যু ভয়, বেইজ্জতি হওয়ার আশঙ্কা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা তাদের এমনভাবে তাড়া করেছে, যার কারণে তাদের খাওয়া-ঘুম-কথাবার্তা সব এলোমেলো হয়ে পড়েছে। নিজের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা এবং সমাজের অন্য সবার প্রতি বিশ্বাস ও নির্ভরতার যে পরিবেশ ও প্রতিবেশ যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল তা ভেঙেচুরে খান খান হয়ে গেছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে দুর্ভোগে পড়া অথবা মারা যাওয়া যে একজন ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য কতটা অবমাননাকর এবং দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে তা কেবল ভুক্তভোগীরাই বলতে পারবেন। রাজা-বাদশাহ, মন্ত্রী-আমলা অথবা মুটে-কুলি, মজুর আপনি যাই হোন না কেন, তাতে বর্তমান জমানায় কিছু আসে যায় না। আপনি যদি শতভাগ সুস্থ অবস্থাতেও থাকেন তাহলেও কেউ আপনার সাথে করমর্দন অথবা কোলাকুলি করতে রাজি হবে না। আর আপনি যদি করোনা আক্রান্ত হয়ে এই মর্মে চিৎসার করে ঘোষণা করেন যে, আমার হস্ত চুম্বনকারী অথবা কদম স্পর্শ করে সালামকারী দীর্ঘ দিনের ভক্ত-দালাল, শুভানুধ্যায়ী, সুবধাভোগীরা যদি তখন এসে আমার সঙ্গে অতীতকালের মতো মোসাহফা করে তবে তাকে এটা দেবো ওটা দেবো অর্থাৎ আপনি যদি রাজা হন তবে রাজত্ব হস্তান্তরের কথা বলবেন- ধনী হলে ধনদান করবেন এবং জ্ঞানী হলে জ্ঞান বিতরণ করবেন- এসব লোভনীয় প্রস্তাব পেয়েও কেউ আপনার নিকটবর্তী হবে না। কেবল সুসন্তান, পতিপ্রাণা স্ত্রী, দায়িত্ববান প্রেমিক স্বামী এবং তাকওয়া অধিকারী সাহসী ধার্মিক বন্ধুরাই বর্তমান সঙ্কটে কাজে লাগছে।
বাংলাদেশের মতো সমাজব্যবস্থায় করোনা সঙ্কট অন্যান্য দেশের চেয়ে বেশি মাত্রায় দুর্ভোগ দুর্দশা সৃষ্টি করেছে। কারণ এ দেশের ধনীদের বিরাট অংশ কৃপণ ও অসৎ। কর্তাব্যক্তি অনেকে মিথ্যুক এবং দাম্ভিক। লোক ঠকানো-ছলচাতুরী করা এবং অবৈধভাবে সব কিছু অর্জন করার যে বন্যরীতি অসভ্য সমাজে আদিমকালে চলত তা বর্তমানকালে আমাদের মন-মস্তিষ্ককে কিভাবে অক্টোপাসের মতো চেপে ধরে আসছে তা আমরা নিদ্রা এবং জাগরণে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আমরা করোনার জীবাণুকে দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর প্রাণীদের নড়াচড়া-অঙ্গভঙ্গি এবং হম্বিতম্বি আমাদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে কারো মুখের দিকে তাকিয়ে অথবা কারো পবিত্র জবানের দু’চারটি আশাব্যঞ্জক কথা শুনে যে একটু ভরসা পাবো তেমন পরিস্থিতি নেই।
মহাকাশে যখন কোনো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ অতীতকালে হানা দিত, তখনো বিশ্বাস ও ভালোবাসার অনেক নিয়ামক পৃথিবীতে ছিল, মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল, শ্রদ্ধার জায়গাগুলো অটুট ছিল এবং বেঁচে থাকার জন্য যে বিশ্বাস দরকার সেই বিশ্বাস সৃষ্টির সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্তম্ভগুলো ভাইরাসমুক্ত ছিল। ফলে প্রচুর প্রাণহানি ও সম্পদহানি সত্ত্বেও অতি অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীবাসী ঘুরে দাঁড়াতে পারত। কিন্তু বর্তমানের দুর্বোধ্য সময়ে একমাত্র ‘আসল সিঙ্গাপুর’ এবং ‘আসল কানাডা’র বৈধ প্রধানমন্ত্রীদের কর্মকাণ্ডের বাইরে আর কার কার কর্মকাণ্ড দুর্দশার মধ্যে আশার আলো সঞ্চার করছে তা আমার জানা নেই।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য